রক্তিম হালদার। যিনি বর্তমানে জার্মানির হ্যানোভার শহরে কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানে পোস্ট ডক্টরেট করছেন। রক্তিম জানান , ‘মার্চের শুরুতে যখন জার্মানিতে আক্রান্তের সংখ্যা একশ ছাড়াল তখনও এদেশে কোনও হেলদোল লক্ষ্য করা যায়নি । এশিয়ানদের নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপও শুনতে পাওয়া গেল যে, এরা ফ্লু-এর ভয়ে মুখোস এঁটে বাড়িতে বসে থাকে। হঠাৎ ইতালিতে মৃত্যুমিছিল চালু হল। অনেক দেরিতে ঘুম ভাঙল জার্মান প্রশাসনের। এদিকে আমরা কিন্তু রোজ অফিস করে চলেছি। ছ’দিনে সংখ্যাটা ছাড়াল একশো থেকে এক হাজার। অফিস বাথরুমের বেসিনের পাশে কাগজে পড়ল, হাত ধোয়ার নিয়মাবলী, জার্মান ভাষায়। তখন আক্রান্তের সংখ্যাটা ৩৬৭৫।’
advertisement
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জার্মানি থেকে এক সাক্ষাৎকারে রক্তিম বলেন, ‘আসলে এর প্রায় দশগুণ, যা এক সপ্তাহের পরে ধরা পড়ল। তবে ইউনিভার্সিটি, বাস-ট্রাম কিছুই অফিসিয়ালি বন্ধ হল না। আমাদের হল ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’। বাড়িতে সবাই বলল অনেক হয়েছে, ফিরে আয়। গেলাম না। কারণ বিমানে আক্রান্ত হয়ে এয়ারপোর্টে করোনা পজিটিভ হলে সেটা আমার বাড়ির লোকেদের জন্য খুব একটা ভাল হবে না।’ লোকডাউন ঘোষণার দিন রাতেই ছুটেছিলেন বাজারে, মাস্ক, স্যানিটাইজার, সাবান কিনতে। সব ততক্ষনে শেষ। বাড়ির পরামর্শে এক মাসের চাল ডাল, কেক, বিস্কুট এসব আগেই কেনা ছিল। কাজের চাপে প্রথম সপ্তাহের এই আকস্মিক ছুটি ভালোই লাগছিল। নিজের ঘরে আপন মনে গবেষণার কাজ করা । সময়ের কোনও বাধ্যবাধকতা নেই । রান্না শেখা, বন্ধুদের সাথে চ্যাটে আড্ডা, কোয়ান্টাম মেকানিক্স, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিত বিনায়ক বন্দোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক বই, নেটফ্লিক্স, ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ, অনলাইনে নিউজ ১৮ খবরের চ্যানেলে চোখ রাখা।
আর মিনিটে মিনিটে করোনা আপডেট দেখেই এখন দিন কাটছে প্রবাসী এই বাঙালি গবেষকের। একদিন বিকালে তার বাড়ির ঠিক উল্টোদিকে থাকা বয়স্ক প্রতিবেশীকে অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে গেলো কিছু মানুষ। তিনি বলছেন, ‘খুব ভয় পেয়ে গেলাম। সবসময়েই অনিশ্চয়তা তাড়া করতে লাগল। যদি এরপর খাবার-দাওয়ার না পাওয়া যায়?’ কথা প্রসঙ্গে রক্তিম বললেন, ‘লকডাউনের তৃতীয় সপ্তাহে, মুখে রুমাল বেঁধে ভয়ে ভয়ে সুপারমার্কেটে গিয়েছিলাম। নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী আবার পাওয়া যাচ্ছিল। জার্মানরা সবাই দু–মিটার দূরত্ব বজায় রেখে কেউ কারওর দিকে না তাকিয়ে লাইন দিয়ে বাজার করে চলে যাচ্ছিলেন। আমিও নিয়ম মেনেই বাজার করলাম।’
রক্তিমের কথায়, ‘চারিদিক নিস্তব্ধ এখন। এদিকে কোনও মতে বাজার করে দৌড়ে বাড়ি এসে চলল এক ঘন্টা ধরে হাত-পা, চুল, জ্যাকেট, জুতো আর দরজার হাতল ধোয়ার পালা। কেনা জিনিসপত্র ফেলে রাখলাম তিনদিন। অফিসের বন্ধুদের দেখা করার জন্য মন কেমন করতে লাগল। ভিডিও কলের মাধ্যমেই চলল কথাবার্তা।’
কলকাতার দমদমের বাসিন্দা রক্তিম। ছেলে বিদেশে থাকায় বাড়ির লোকের চিন্তা স্বাভাবিক। কলকাতাতেও করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে চলায় বাড়ির লোকজনের জন্য উদ্বিগ্ন রক্তিমও। তাই প্রায় প্রতিদিনই নিয়ম করে কলকাতায় বাড়ির লোকেদের সঙ্গে কথা বলেন আইআইটি খড়গপুরের এই প্রাক্তনী। চারিদিকে রাস্তাঘাট শুনশান। চেনা শহর রাতারাতি কেমন যেন পাল্টে গিয়েছে। এখনও চলছে লকডাউন। এপ্রিলে কলকাতায় বাড়ি ফেরার কথা ছিল তরুণ এই গবেষকের। কিন্তু লকডাউনে তা আর হল না। তাঁর আশঙ্কা, ‘দুর্গাপুজোতেও ফিরতে পারব কিনা জানি না।’
Venkateswar Lahiri
