এলআইসি-র ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্কও বিশাল। ১.৫ লক্ষের বেশি বিমা এজেন্ট, অংশিদারী এবং অনলাইন সেলস চ্যানেল নিয়ে গঠিত। এলআইসি-র এনডাউমেন্ট ভিত্তিক পলিসি, ইউলিপ, টার্ম ইনসিওরেন্স প্ল্যান, মানি ব্যাক পলিসি এবং পেনশন প্ল্যান সবচেয়ে জনপ্রিয়।
আরও পড়ুন: নতুন বছরে এই ৮ স্টকে বাজি ধরা যায়, দু’হাত ভরিয়ে দিতে পারে বিনিয়োগকারীদের!
মৃত্যুর আশঙ্কা সবচেয়ে বড় আশঙ্কাগুলোর একটা। কোনও দুর্ঘটনা বা দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতিতে যদি পরিবারের উপার্জনকারী সদস্যের মৃত্যু হয় তাহলে পরিবার ‘ক্ষতিপূরণ’ পেতে পারেন, সেখানেই জীবন বিমা আসে।
advertisement
এলআইসি-র পলিসি কেনা উচিত: দীর্ঘকাল ধরেই এলআইসি পলিসি সবচেয়ে নিরাপদ বিমা প্রকল্প। কয়েক দশক ধরে মানুষের বিমা চাহিদা মেটাচ্ছে। গ্রাহকদের প্রতি এলআইসি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। দাবি নিষ্পত্তির অনুপাতও অন্যদের থেকে অনেক বেশি। বছরের পর বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে আসছে। ২০২০-২১ অর্থ বছরে এলআইসি-র দাবি নিষ্পত্তির অনুপাত ৯৮.৬২ শতাংশ। এই তথ্য জানিয়েছে সিএসআর। এই সংখ্যা মৃত্যু এবং অন্যান্য দাবি নিষ্পত্তিতে বিমা কোম্পানির নির্ভরযোগ্যতা প্রমাণ করে। তাই এলআইসি করলে পলিসি হোল্ডার নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন যে তাঁর মৃত্যুতে পরিবার সেই সুবিধাগুলি পাবে যা তাঁরা পাওয়ার অধিকারী।
আরও পড়ুন: ওয়াইফাই ও মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কের সমস্যা এ-বার দূর হবে; বড়সড় পদক্ষেপ সরকারের!
এলআইসি-তে বিনিয়োগ কী: এলআইসি-তে বিনিয়োগের কথা উঠলে মানি ব্যাক অথবা এনডাওমেন্ট পলিসির কথাই বলা হয়। এগুলোতে বিমা এবং বিনিয়োগ মাধ্যম, দুধরণের বিকল্পই রয়েছে। পলিসিধারীর মৃত্যুতে কিংবা মেয়াদপূর্তিতে এইআইসি অর্থ প্রদান করে। পলিসির মেয়াদ ১০, ১৫, ২০ বছর অথবা একটা নির্দিষ্ট বয়স সীমা পর্যন্ত হতে পারে। এই পলিসিগুলো এলআইসি এজেন্টরা বিক্রয় করেন। এর বদলে তাঁরা উচ্চ কমিশন পান। এই পলিসিগুলোতে মূলত ৩টি সুবিধা পাওয়া যায়। ক) সুরক্ষা খ) বিনিয়োগের উপর রিটার্ন গ) ট্যাক্স ছাড়। আগে যখন বিনিয়োগ বিকল্প কম ছিল তখন তখন এই পলিসিগুলো রমরমিয়ে চলত। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এইআইসি-তে বিনিয়োগ করা আর বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এলআইসি পলিসি কিনলে বিমা এবং বিনিয়োগ পরিকল্পনা দুটোই কিনতে হয়। কিন্তু আর্থিক বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলছেন, বিমা এবং বিনিয়োগ, এই দুটো কখনও একসঙ্গে মেশানো উচিত নয়।
এছাড়া যদি কেউ সঞ্চয় বাড়ানোর পরিকল্পনা করেন এবং বিনিয়োগে উচ্চ রিটার্ন পেতে চান, তাহলেও এলআইসি গ্রাহকের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে পারে না। এর কারণ হল প্রথাগত এনডাওমেন্ট পলিসিতে দেওয়া অভ্যন্তরীন রিটার্ন হার মাত্র ৪ থেকে ৫ শতাংশ যা মুদ্রাস্ফীতিকে কভার করতে পারে না।
এটা মোকাবিলা করার জন্য এলআইসি ইউলিপ চালু করেছে। এতে বিমা এবং বিনিয়োগ উভয় সুবিধা পাওয়া যায়। কিন্তু স্টক, বন্ড এবং মিউচুয়াল ফান্ডের মতো বিনিয়োগ মাধ্যমগুলো থেকে আরও ভাল আয় করা যায়। যদি মাঝারি থেকে বেশি ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা থাকে তাহলে এলআইসি-র বদলে এই বিনিয়োগমাধ্যমগুলোকেই বেছে নেওয়া উচিত। পলিসি সুবিধার জন্য সরাসরি বিমায় বিনিয়োগ করা যায়। কিংবা কম ঝুঁকি কিন্তু ভাল রিটার্ন চাইলে ডেবট ফান্ডেও বিনিয়োগ করা যায়।
দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে এলআইসি পলিসি হোল্ডারের নমিনি বা তার পরিবারকে আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করে। তাই রিস্ক ম্যানেজমেন্ট করতে পোর্টফোলিওতে একটা বা দুটো এলআইসি পলিসি নেওয়া যায়।
এলআইসি পলিসি থেকে যে সুবিধাগুলি পাওয়া যায়: সরকারি মালিকানাধীন – এলআইসিতে কেন্দ্রীয় সরকারের অংশিদারীত্ব রয়েছে। ফলে এখানে বিনিয়োগ নিরাপদ এবং নির্ভরযোগ্য।
ট্যাক্স বেনিফিট - পলিসিধারীরা আয়কর আইন ১৯৬১-এর অধীনে প্রিমিয়ামের পরিমাণের উপর কর ছাড় পান। সমস্ত সুবিধাও ধারা ১০ (১০ডি)-এর অধীনে কর ছাড় যোগ্য। যাইহোক এই কর ছাড় যে কোনও বিমা কোম্পানির থেকে কেনা বিমা পলিসি, পাবলিক প্রভিডেন্ট ফান্ড ফিক্সড ডিপোজিটের মতো সঞ্চয় স্কিমগুলোতেও প্রযোজ্য।
অতিরিক্ত রিটার্ন – এলআইসি পলিসিধারীদের কাছ থেকে সংগৃহীত প্রিমিয়াম পুল করে সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করে। অতিরিক্ত উপার্জনের একটা শতাংশ তারা গ্রাহকদের বোনাস আকারে দেয়।
আর্থিক নিরাপত্তা – এলআইসি-র জীবন বিমা প্রকল্পে সাধারণ মানুষের বিনিয়োগ করার একমাত্র কারণ হল তাঁদের নির্ভরশীলদের আর্থিকভাবে রক্ষা করা এবং পলিসিধারকের কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে তাঁদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করা।
এলআইসি পলিসির খামতি: রিটার্নের হার কম। বাজার সংযুক্ত যে কোনও বিনিয়োগ মাধ্যমে এলআইসি-র চেয়ে অনেক বেশি রিটার্ন পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, মেয়াদ শেষে পলিসিধারী যে পরিমাণ টাকা হাতে পাবেন তা পাবলিক প্রভিডেন্ট ফান্ড বা ফিক্সড ডিপোজিটে যা পাওয়া যায় তার থেকেও কম। এখানেই এলআইসি পিছিয়ে পড়ছে। এগিয়ে যাচ্ছে অন্যান্য বিনিয়োগ বিকল্প। এলআইসি থেকে লাভের হার এতটাই কম যে মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে সুরক্ষাও নিশ্চিত করতে পারে না। এর তুলনায় মিউচুয়াল ফান্ড অনেক এগিয়ে। কীভাবে?
আদতে এলআইসি এবং মিউচুয়াল ফান্ড এঁকে অপরের থেকে আলাদা। কিন্তু বিনিয়োগের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখলে দুটোর তুল্যমূল্য বিচার করাই যায়। মিউচুয়াল ফান্ড এবং এলআইসির বৈশিষ্টগুলি আলাদা ভাবে বুঝতে হবে। তাহলেই ফারাকগুলো স্পষ্ট হয়ে যাবে।
অর্থ - এলআইসি একটি বিশুদ্ধ সুরক্ষা পরিকল্পনা। যা পলিসিধারীর অকাল মৃত্যুতে তাঁর পরিবারকে আর্থিক ভাবে সুরক্ষিত করবে। অন্য দিকে, মিউচুয়াল ফান্ড বিশুদ্ধ বিনিয়োগ মাধ্যম। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তির বিনিয়োগের পুল দিয়ে তৈরি।
উদ্দেশ্য - একটি সাধারণ জীবন বিমা পলিসির মূল উদ্দেশ্যই হল, পলিসিধারীর অকালমৃত্যু হলে তাঁর পরিবারকে আর্থিকভাবে সুরক্ষিত রাখা। আর মিউচুয়াল ফান্ডের মূল উদ্দেশ্য হল, দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক লক্ষ্য পূরণের জন্য মোটা রিটার্ন জেনারেট করা।
লিকুইডিটি – এলআইসি পলিসিতে ঋণের সুবিধা পাওয়া যায়। মিউচুয়াল ফান্ডে ঋণ সুবিধা পাওয়া যায় না, তবে বিনিয়োগকারী যে কোনও সময় বিনিয়োগ করা অর্থ তুলে নিতে পারেন।
ঝুঁকি – এলআইসি-তে ঝুঁকি নেই বললেই চলে। এটা নিরাপদ বিনিয়োগ মাধ্যম ধরা হয়। মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ বাজারের সঙ্গে জড়িত। তাই এখানে ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে বেশি।
মেয়াদ – এলআইসি-তে বিভিন্ন পলিসির মেয়াদ বিভিন্ন। মিউচুয়াল ফান্ডে সেভাবে কোনও মেয়াদ নেই। যে কোনও সময় যে কোনও পরিমাণ বিনিয়োগ করা যায়।
রিটার্ন – এলআইসিতে রিটার্ন পলিসির উপর নির্ভর করে। তবে রিটার্নের পরিমাণ সাধারণত কমই হয়। মিউচুয়াল ফান্ডে দীর্ঘ মেয়াদে রিটার্ন উল্লেখযোগ্য ভাবে বেশি।
রাইডার বেনিফিট – এলআইসিতে অতিরিক্ত রাইডার বেনিফিট পাওয়া যায়। মিউচুয়াল ফান্ডে কোনও রাইডার বেনিফিট প্রদান করা হয় না।
বৈচিত্র্য – যখন শুধুমাত্র একটা পরিকল্পনাতেই অর্থ বিনিয়োগ করা হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই বৈচিত্র্য বলে কিছু থাকে না। মিউচুয়াল ফান্ডে অনেক সিকিউরিটিজ থাকে। তাই বিনিয়োগকারীর পোর্টফোলিওকে বৈচিত্র্যময় করে তোলে।
ট্যাক্স বেনিফিট – আয়কর আইন ১৯৬১-এর ধারা ৮০সি-র অধীনে ১,৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত প্রিমিয়ামে কর ছাড় পাওয়া যায়। অন্য দিকে, ইএলএসএস মিউচুয়াল ফান্ড শুধুমাত্র আয়কর আইন ১৯৬১-এর ধারা ৮-সি-র অধীনে কর ছাড়ের জন্য যোগ্য।
বিনিয়োগ করার সময় প্রতিটি ব্যক্তিরই নির্দিষ্ট চিন্তাভাবনা থাকে। মানসিকতাও আলাদা আলাদা হয়। কেউ কেউ আর্থিক সিকিউরিটিজ চান, তো কেউ ভাল রিটার্ন। তাই এলআইসি হোক কিংবা মিউচুয়াল ফান্ড যে কোনও জায়গায় বিনিয়োগ করার আগে আর্থিক লক্ষ্য বোঝাটা গুরুত্বপূর্ণ। কষ্টার্জিত অর্থ ঢালার আগে কোথায় ঢালা হচ্ছে সেটা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকাটাও জরুরি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিমা এবং বিনিয়োগকে একসঙ্গে মেশালে চলবে না। আর্থিক পরিকল্পনার সময় এই দুটোকেই সমান গুরুত্ব দেওয়া উচিত। মাথায় রাখতে হবে, এলআইসিতে পলিসিধারীর মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারের আর্থিক সুরক্ষার জন্য যথেষ্ট সুবিধা প্রদান করে। কিন্তু সম্পদ সৃষ্টির জন্য পর্যাপ্ত রিটার্ন তৈরি করতে পারে না। তাই পৃথক উদ্দেশ্যের জন্য আলাদা আলাদা আর্থিক উপকরণেই বিনিয়োগ করা উচিত।
আর্থিক বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন, এলআইসি পলিসি করার চেয়ে একটা টার্ম ইনসিওরেন্স নেওয়া এবং বাকিটা ইক্যুইটি মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ অনেক বেশি স্মার্ট আর্থিক পছন্দ হতে পারে। ইএলএসএস এবং লাইফ ইনসিওরেন্স, উভয়েই বার্ষিক দেড় লক্ষ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগে ট্যাক্স ছাড় পাওয়া যায়। তাই বিচক্ষণতার সঙ্গে চিন্তা করে সাবধানে বিনিয়োগ করার পরামর্শ দেওয়া হয়।