আর এই সব তথ্যের অভাবের কারণে অধিকাংশ মানুষ নিজে থেকে আয়কর গণনা করা এড়িয়ে যান। দারস্থ হন, কোনও আয়কর বিশেষজ্ঞের। এটি একটি বড় সমস্যা। বেতনের উপর আয়কর কী ভাবে গণনা করতে হবে, তা সহজ ভাবে জানতে হলে এই নিবন্ধে চোখ রাখতে হবে।
আয়কর কী?
আয়কর আইন, ১৯৬১ অনুসারে, প্রত্যেক বেতনভোগী ব্যক্তিকে তাঁদের বেতন থেকে একটি পরিমাণ ট্যাক্স বা কর হিসাবে দিতে হবে। এই পরিমাণ ট্যাক্সকে বলা হয় আয়কর। আইনে অনেক সংশোধনী এবং বৈচিত্র্য রয়েছে যেখানে কর প্রদানের বিবরণ, করে পাওয়া ছাড় এবং গণনার বিবরণ রয়েছে। উপধারা ৮০সি থেকে ৮০ইউ পর্যন্ত প্রচুর ছাড় পাওয়া যায়।
advertisement
আয়কর গণনার উপাদান
আয়কর গণনা করার সময়, কয়েকটি মৌলিক পরিভাষা মনে রাখা উচিত। নিচে দেওয়া তালিকায় একবার চোখ বুলিয়ে নিলে বিষয়টা কিছুটা সহজ হবে:
কর বছর: কর বছর হল আগের আর্থিক বছর যার জন্য আয়কর গণনা করা হয়। আর্থিক বছর ১ এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে পরের বছরের ৩১ মার্চ শেষ হয়। সুতরাং যদি ২০২৩ সালে আয়কর গণনা করা হয়, তবে ১ এপ্রিল ২০২২ থেকে ৩১ মার্চ ২০২৩ পর্যন্ত পাওয়া বেতনের মূল্যায়ন করতে হবে।
মূল্যায়ন বছর: মূল্যায়ন বছর শব্দটা অনেক মানুষকে বিভ্রান্ত করে। মনে রাখতে হবে, মূল্যায়ন বছর আর্থিক বছরের মতো নয়। এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। পূর্ববর্তী আর্থিক বছর শেষ হওয়ার পর শুরু হয় মূল্যায়ন বছর। যদি ২০২১-২২ আর্থিক বছরের জন্য বেতনের আয়কর গণনা করা হলে, মূল্যায়ন বছর হবে ২০২২-২৩ এবং আয়কর রিটার্ন ফাইল করার শেষ তারিখ হবে ২০২২ সালের জুলাই মাস।
আরও পড়ুন: আয়কর নিয়মে পরিবর্তন, বাজেটে কি সুখবর দেবে কেন্দ্রীয় সরকার
বেতনের বিবরণ: বেতনের বিবরণ আয়কর গণনা করার প্রথম ধাপ। মাসের বেতন পাওয়ার সময় যে পে স্লিপ বা বেতন বিবৃতি পাওয়া যায় সেখানে বেতনের বিবরণ থাকে। বিবৃতিটি ভাল ভাবে দেখতে হবে। বুঝতে হবে বেতনের প্রধান উপাদান এবং মৌলিক কাঠামো। এখানেই বোঝা যাবে বেতন থেকে কাটা যাওয়া টাকার পরিমাণ, যেমন এইচআরএ (বাড়ি ভাড়া ভাতা), ডিএ (মহার্ঘ ভাতা) ইত্যাদি জানা যাবে এবং কর গণনার সময় সহায়ক হবে।
করযোগ্য আয়: একবার বেতন থেকে বিধিবদ্ধ অর্থ বিচ্ছেদ হয়ে গেলে, করযোগ্য আয় গণনা করতে হবে। করযোগ্য আয় হল সেই আয় শুধু যার উপর আয়কর দিতে হবে। মনে রাখা দরকার, করযোগ্য আয়ের মধ্যে কিন্তু বেতন ছাড়াও অন্যান্য উৎস থেকে পাওয়া আয়ও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
আয়ের উৎস:
বেতন থেকে আয়: বেতন, ছুটির পরিবর্তে পাওয়া অর্থ, ভাতা ইত্যাদির মতো চাকরি থেকে পাওয়া সমস্ত আয়।
সম্পত্তি থেকে আয়: বাড়ি বা জমি থেকে আয়। ভাড়া থেকে পাওয়া আয়ও এর মধ্যে আসবে।
আরও পড়ুন: বিরাট স্বস্তি! বাজেটে মধ্যবিত্তদের বড় 'গিফট' দিতে পারে মোদি সরকার
ব্যবসা/পেশা থেকে আয়: পার্ট টাইম চাকরি বা পেশা থেকে আয়।
লাভ থেকে আয় : কোনও মূলধন সম্পদ বিক্রি থেকে উপার্জন।
অন্যান্য উৎস থেকে আয়: উপরের আয় ছাড়াও ফিক্সড ডিপোজিট, উপহার, পেনশন ইত্যাদি থেকে উপার্জন আসবে অন্যান্য উৎস থেকে আয়-এর মধ্যে।
গণনার পদ্ধতি:
করযোগ্য আয় হল মোট আয় থেকে ডিডাকশন বাদ দিয়ে পড়ে থাকা অর্থ।
করযোগ্য আয় গণনা করার সময় সেরা বন্ধু হতে পারে ধারা ৮০। এই ধারায় মিউচুয়াল ফান্ডে করা বিনিয়োগ, জীবন বিমা পলিসি, সঞ্চয়ের সুদ, পিপিএফ, এনএসসি, এসআইপি, মিউচুয়াল ফান্ড রিটার্ন, হোম লোন ইত্যাদির মতো সব ধরনের ছাড় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কোনও ব্যক্তি প্রতি বছর ২.৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ছাড় পেতে পারেন। তাই বিনিয়োগের পরিকল্পনা যত্ন সহকারে করলে বার্ষিক আয়ের অনেকাংশ সঞ্চয় করা যেতে পারে।
উৎসে কাটা কর বা ট্যাক্স ডিডাক্টেড অ্যাট সোর্স (TDS) হল সেই কর যা সরাসরি বেতন থেকে কেটে নেওয়া হয়। আসলে ঝঞ্ঝাট মুক্ত কর ব্যবস্থা বজায় রাখার জন্য, বেশিরভাগ নিয়োগকর্তা TDS ব্যবহার করেন। চিন্তা করার দরকার নেই, এটা ফেরত বা রিফান্ড পাওয়া যায়।
এবার চূড়ান্ত ধাপ হল, প্রদেয় কর গণনা করা। সমস্ত প্রযোজ্য ডিডাকশন এবং উৎসে কাটা কর বাদ দেওয়ার পরে, যে পরিমাণ অর্থ পাওয়া যাবে, তার উপর নির্ভর করবে আয়করের পরিমাণ। মোট আয় ২.৫ লাখের কম হলে কোনও আয়কর দিতে হবে না। এই সীমার বাইরে, বেতন স্ল্যাব অনুযায়ী আয়কর দিতে সকলে দায়বদ্ধ।
৬০ বছরের কম বয়সী বেতনভোগী ব্যক্তির জন্য করের হার:
আয় | করের হার |
২.৫ লক্ষ পর্যন্ত | কোনও আয়কর প্রযোজ্য নয় |
২.৫ লক্ষ থেকে ৫ লক্ষ | ২.৫ লক্ষ থেকে বাড়তি পরিমাণের ১০% |
৫ লক্ষ থেকে ১০ লক্ষ | ৫ লক্ষ থেকে অতিরিক্ত পরিমাণের উপর ২০% |
১০ লক্ষের উপরে | অতিরিক্ত পরিমাণের 30% |
আয়কর সঞ্চয়
প্রত্যেক নাগরিক চান আয় বাড়াতে কিন্তু কম কর দিতে। এটি করার কয়েকটা উপায় আছে। কর বাঁচানোর সবচেয়ে জনপ্রিয় কিছু পদ্ধতি হল:
ইক্যুইটি লিঙ্কড সেভিংস স্কিম (ELSS) হল স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সহ ইক্যুইটি মিউচুয়াল ফান্ড। এর ফলে ১.৫ লাখ পর্যন্ত ছাড় পাওয়া যায়। এদের ৩ বছরের লক-ইন পিরিয়ড আছে এবং প্রায় প্রতিটি মিউচুয়াল ফান্ড ইক্যুইটি লিঙ্কড সেভিংস স্কিম অফার করে।
পিপিএফ বা পাবলিক প্রভিডেন্ট ফান্ড (PPF) বিনিয়োগের খুব জনপ্রিয় পদ্ধতি। সরকারি যোজন হওয়ায় এটি মানুষের আস্থার জায়গা। পিপিএফ একটি নির্দিষ্ট হারে সুদ দেয় যা বর্তমানে ৭.৯%। পিপিএফ-এ বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সীমা হল ১.৫ লক্ষ৷ এর ১৫ বছরের লক-ইন পিরিয়ড আছে।
ইউলিপ বা ইউনিট লিঙ্কড ইন্স্যুরেন্স প্ল্যান (ULIP) হল বিমা পরিকল্পনা এবং বাজার-সংযুক্ত বিনিয়োগের একটি হাইব্রিড। ৫ বছরের লক-ইন পিরিয়ড থাকলেও, এটি সুরক্ষার পাশাপাশি সঞ্চয় করতে সাহায্য করে।
ধারা ৮০-র অধীনে অনেকগুলি ছাড় পাওয়া যায় যা ব্যক্তির করযোগ্য আয় কমিয়ে আনে এবং ফলত আয়কর কম হয়। এর মধ্যে ইক্যুইটি লিঙ্কড সেভিংস স্কিম, পিপিএফ, ইউলিপ, প্রফিডেন্ট ফান্ডে কর্মচারীর শেয়ার, এলআইসি-র প্রিমিয়াম, শিশুদের টিউশন ফি, হোম লোনের মূল পরিশোধ, ৫ বছরের আমানত স্কিম, সিনিয়র সিটিজেন’স সেভিংস স্কিম, মিউচুয়াল ফান্ড দ্বারা প্রতিষ্ঠিত পেনশন তহবিল , এলআইসি-র বার্ষিক পরিকল্পনা, ন্যাশনাল হাউজিং ব্যাঙ্কের হোম লোন অ্যাকাউন্ট স্কিমের সাবস্ক্রিপশন-এর মতো অনেক কিছু অন্তর্ভুক্ত।
মনে রাখা দরকার বাড়ি ভাড়ার ভাতা বা এইচআরএ, শিক্ষা ঋণের সুদ, নিজের, পত্নী এবং সন্তানদের চিকিৎসা বিমা, ৬০ বছরের বেশি বয়সী বাবা-মায়ের চিকিৎসা বিমা, প্রতিবন্ধী-নির্ভরশীলদের চিকিৎসা বা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নেওয়া অর্থ, রাজনৈতিক দলগুলিতে দেওয়া অবদান-এও ছাড় পাওয়া যেতে পারে।
আয়কর গণনা:
আয়কর গণনা করা আসলে খুব সহজ। সূত্রটি হল:
মূল বেতন
+ বাড়ি ভাড়ার ভাতা বা এইচআরএ
+ বিশেষ ভাতা
+ পরিবহন ভাতা
+ অন্য কোনও ভাতা
------------------------------
বেতন থেকে প্রাপ্ত মোট আয়
(-) ডিডাকশন বা কর্তন
----------------------------
মোট আয়
উদাহরণ
ধরা যাক, মালিনী মজুমদারের মূল বেতন প্রতি মাসে ২৫০০০ টাকা। যার সঙ্গে প্রতি মাসে ৪৫০০ টাকা মহার্ঘ ভাতা, ২২৫০ টাকা বিনোদন ভাতা পান তিনি। পেশাদার করের হিসেবে ৩৫০০ টাকা বছরে কেটে নেওয়া হয়। তা হলে তাঁর করযোগ্য আয় নিম্নরূপ গণনা করা হবে:
মূল বেতন | ২৫০০০ x ১২ | ৩০০০০০ |
মহার্ঘ ভাতা | ৪৫০০ x ১২ |
|
বিনোদন ভাতা | ২২৫০ x ১২ |
|
মোট আয় | = ৩৮১০০০ | |
পেশাদার কর |
| |
মূল আয় | = ৩৭৭৫০০ |
তাঁর করযোগ্য আয় দাড়াবে ৩৭৭৫০০ টাকা। তিনি ২.৫ লক্ষ থেকে ৫ লক্ষ আয়করের স্ল্যাবে পড়েন। ফলে তাঁকে মূল আয়ের ১০% আয়কর হিসাবে দিতে হবে।
অর্থাৎ তাঁকে আয়কর দিতে হবে ৩৭৭৫০০ টাকার ১০% বা ৩৭৭৫০ টাকা।
আয়কর রিটার্ন জমা করার জন্য মূল্যায়ন বছরের শুরুতে সমস্ত বিনিয়োগ জানিয়ে দেওয়া অপরিহার্য, যাতে পরিশোধ করা ট্যাক্স সঠিকভাবে গণনা করা যায়। ভুল ট্যাক্স প্রদান এবং মিথ্যা তথ্য প্রদান করা আইনত অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। কর জালিয়াতি করার ফলে মোটা অঙ্কের জরিমানা এবং কারাদণ্ডের মতো আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে।