Explainer: সিন্ধু জল চুক্তি সংক্রান্ত কিছু ভুল ধারণা এবং সত্য: ভারত নয়, বরং এই দেশ থেকেই উৎপত্তি হয়েছে সিন্ধু আর শতদ্রুর, তারা কি জল বন্ধ করে দিতে পারে?
- Published by:Siddhartha Sarkar
- news18 bangla
Last Updated:
China May Stop Indus and Sutlej Water: সিন্ধু জল চুক্তিতে কী রয়েছে? দ্বিপাক্ষিক এই চুক্তিটি সিন্ধু অববাহিকার ৬টি নদী- সিন্ধু, ঝিলাম, চেনাব বা চন্দ্রভাগা, ইরাবতী বা রাভি নদী, বিয়াস বা বিপাশা এবং শতদ্রু নদীর জল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কীভাবে ব্যবহার এবং বণ্টন করা হবে, তা নিয়ন্ত্রণ করে।
Author-Sachin Srivastava: গত মাসেই জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে নিরীহ পর্যটকদের গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিরা। এই ঘৃণ্য জঙ্গি হামলার পাল্টা জবাব দিয়েছে ভারতও। এর ফলস্বরূপ ১৯৬০-এর সিন্ধু জল চুক্তি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। এর পরেই উঠতে শুরু করেছে একের পর এক প্রশ্ন। এর মধ্যে অন্যতম হল- ওই চুক্তিতে কী বলা হয়েছে? কোন দেশ এর থেকে সবথেকে বেশি লাভবান হবে? তাহলে জেনে নেওয়া যাক এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তরগুলি। (Image: AFP)
advertisement
সিন্ধু জল চুক্তিতে কী রয়েছে? দ্বিপাক্ষিক এই চুক্তিটি সিন্ধু অববাহিকার ৬টি নদী- সিন্ধু, ঝিলাম, চেনাব বা চন্দ্রভাগা, ইরাবতী বা রাভি নদী, বিয়াস বা বিপাশা এবং শতদ্রু নদীর জল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কীভাবে ব্যবহার এবং বণ্টন করা হবে, তা নিয়ন্ত্রণ করে। এটি পশ্চিমাঞ্চলীয় নদী (সিন্ধু, ঝিলাম এবং চন্দ্রভাগা) পাকিস্তানকে এবং পূর্বাঞ্চলীয় নদী (ইরাবতী, বিপাশা এবং শতদ্রু) ভারতকে বরাদ্দ করে। একই সঙ্গে, এই চুক্তি অনুযায়ী, প্রতিটি দেশকে অন্য দেশের জন্য বরাদ্দকৃত নদীর নির্দিষ্ট ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়। (File Photo: PTI)
advertisement
ভারত এবং পাকিস্তান ছাড়াও বিশ্ব ব্যাঙ্কও এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। যা এখনও পর্যন্ত রাজনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক উত্তেজনা এবং তিনটি যুদ্ধের মধ্য দিয়েও টিকে রয়েছে। একটি দেশ অন্য দেশের জন্য নির্ধারিত নদীতে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করতে পারে, যতক্ষণ না পর্যন্ত এটি ভাটার দিকে জলপ্রবাহ কমাচ্ছে কিংবা অবরুদ্ধ করছে।
advertisement
এই ৬টি নদীর মধ্যে ৪টি নদীর উৎপত্তি হয়েছে উত্তর ভারত থেকে। আর বাকি দুটির উৎপত্তি হয়েছে তিব্বত থেকে। বর্তমানে যা চিনের শাসনের আওতায় রয়েছে। এর মধ্যে ইরাবতী বা রাভি নদীর উৎপত্তি হয়েছে কুলু পর্বত থেকে। বিয়াস বা বিপাশার উৎপত্তি হয়েছে রোটাঙ্গ পাসের কাছে বিয়াস কুণ্ড থেকে। আবার ঝিলামের উৎপত্তি হয়েছে কাশ্মীরের ভেরিনাগ জলপ্রবাহ থেকে। আর হিমাচল প্রদেশের তান্ডির চন্দ্র এবং ভাগা নদীর সঙ্গমস্থল থেকে উৎপত্তি হয়েছে চন্দ্রভাগা নদীর। এদিকে আবার তিব্বতের রাক্ষসতাল হ্রদ থেকে উৎপত্তি হয়েছে শতদ্রু নদীর এবং মানসরোবর হ্রদ থেকে উৎপত্তি হয়েছে সিন্ধু নদীর। ভারত এবং পাকিস্তান উভয় দেশই এই নদীগুলির উপর বেশ কিছু বাঁধ এবং জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করেছে।
advertisement
পাকিস্তানের জন্য এটা কেন গুরুত্বপূর্ণ? তক্ষশিলা প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক এবং জিওস্প্যাশিয়াল রিসার্চ প্রোগ্রামের প্রধান ড. ওয়াই নিত্যানন্দম বলেন যে, পাকিস্তান এবং পাক অধিকৃত কাশ্মীরে (POK) ২০টিরও বেশি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প - কার্যকর এবং পরিকল্পিত - সিন্ধু নদের উপর নির্ভরশীল। পাকিস্তানের বিদ্যুতের এক-তৃতীয়াংশ আসে জলবিদ্যুৎ থেকে, যা তারবেলা, মঙ্গলা এবং অন্যান্য জলাধারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত জল থেকে উৎপাদিত হয়। যদি জোয়ারের প্রবাহ কমে যায় বা সঠিক সময়সীমা নির্ধারণ করা না হয়, তাহলে এর বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা কমে যেতে পারে।
advertisement
ভবিষ্যদ্বাণী: এই চুক্তিতে পাকিস্তানের জন্য নদীর জলের একটি পূর্বাভাসযোগ্য প্রবাহ বরাদ্দ রয়েছে। আর পাকিস্তানের সমগ্র সেচ, জ্বালানি এবং জলের ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা এই পূর্বাভাসযোগ্যতার উপর ভিত্তি করেই বানানো হয়েছে। আর এই পূর্বাভাসযোগ্য প্রবাহের উপর ভিত্তি করেই পাকিস্তানে বীজ বপন এবং খালের সময়সূচি নির্ধারণ করা হয়। এই স্থগিতাদেশের ফলে ভারত নদী প্রবাহ সংক্রান্ত তথ্য ভাগাভাগি করবে না, যা খরা এবং বন্যা উভয়ের জন্যই সংবেদনশীল হতে পারে। এদিকে এই সিন্ধু নদীর সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে জড়িয়ে রয়েছে ১৫.২ কোটিরও পাকিস্তানির জীবন। এটা খাদ্য উৎপাদন, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং আর্থিক সক্রিয়তার একটা উৎস। ফলে এই নদীই হয়ে উঠেছে অপরিহার্য জীবনরেখা। (File Photo: AP)
advertisement
কখন এর প্রভাব দেখা যাবে? বিষয়টা এমন নয় যে, ভারত একটা বোতাম টিপবে আর পরের দিন গোটা পাকিস্তানে খরা হয়ে যাবে। তবে হ্যাঁ, পাকিস্তানের জীবনযাত্রা বেশ কঠিন হয়ে উঠবে। ডা. নিত্যানন্দমের বক্তব্য, ভারতের দ্বারা যদি নদী পরিবর্তন বা নদীর প্রবাহে বড় ধরনের পরিবর্তনের মতো কোনও অন-গ্রাউন্ড পরিবর্তন হয়, তাহলে কমপক্ষে কয়েক বছর সময় লাগবে। পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীগুলি বিশাল। মে এবং সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে যখন বরফ গলে যায়, তখন বর্তমান পরিকাঠামোর সাহায্যে সমস্ত জল ধরে রাখা ভারতের পক্ষে মুশকিল। ভারতের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলির লাইভ স্টোরেজ খুবই সীমিত। (File Image/Reuters)
advertisement
পাকিস্তানের জন্য আরও চাপ: সিন্ধু অববাহিকার উপর গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, পাকিস্তানের নিম্নাঞ্চলে অতিরিক্ত জল উত্তোলন এবং নদীর প্রবাহ হ্রাস হচ্ছে। আগামী তিন দশকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঘরে ঘরে চাহিদা বৃদ্ধি এবং ক্রমবর্ধমান জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই সমস্ত এলাকায় ওয়াটার স্ট্রেস ইনডেক্স ২-এর ভ্যালু পার করে গিয়েছে। যা অতিরিক্ত ঘাটতির ইঙ্গিত করছে।পাকিস্তান এমনিতে স্থায়ী জল ব্যবহারের ক্ষেত্রে কম বিনিয়োগ করেছে। বর্তমানে পাকিস্তানের আর্থিক ক্ষমতা এবং পরিকাঠামো উভয়েরই অভাব রয়েছে, যা কার্যকর বিকল্প তৈরি করতে পারে। নদীর জলের সময়সীমার ঘাটতি বা পরিবর্তন আন্তঃপ্রাদেশিক উত্তেজনাকে আরও তীব্র করবে, বিশেষ করে পঞ্জাব এবং সিন্ধুর মধ্যে তো বটেই! যেখানে জল বণ্টন বিতর্ক ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক ভাবে আলোচ্য বিষয়।এই সিদ্ধান্তের কিছু খারাপ দিকও রয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের মতো নদীর উপর ভিত্তি করে তৈরি একটি ভাটার দেশ হিসেবে ভারত দীর্ঘদিন ধরে ভাটার অধিকারকে সম্মান করার নীতিকে সমর্থন করে আসছে। চুক্তি স্থগিত করে এবং একতরফা ভাবে কাজ করে এটি এমন একটি নজির স্থাপনের আশঙ্কা তৈরি করে, যা এর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যেতে পারে।
advertisement
এদিকে শতদ্রু আর সিন্ধু নদীর উৎপত্তি যেহেতু চিনে, তাহলে এর জল কি বন্ধ করতে পারে চিন? হ্যাঁ, এটা সত্যি যে, প্রযুক্তিহত ভাবে সিন্ধু এবং শতদ্রু নদীর জল বন্ধ করে দিতে পারে চিন। কারণ দুটোরই উৎপত্তি তিব্বত থেকে। আর এর উপর চিনের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। যদিও এর জন্য একাধিক প্রযুক্তিগত, ভৌগোলিক এবং ভূ-রাজনৈতিক বিষয়গুলিও বিবেচনা করতে হবে।
advertisement
চিন কীভাবে এটিকে সম্ভব করতে পারে? যেখান থেকে সিন্ধু নদের উৎপত্তি হয়েছে, সেখানে Senghe Tsangpo এবং Ngari Shiquanhe-র মতো জলবিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপন করেছে চিন। যা জলপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আবার শতদ্রু নদীর উপর চিন Zada Gorge-এ একটি ব্যারেজও নির্মাণ করেছে চিন। আর অন্যান্য জলবিদ্যুৎ প্রকল্প শুরু করেছে। আর এই বাঁধ এবং ব্যারেজের মাধ্যমে কিন্তু চিন জলের প্রবাহ কমাতে কিংবা বন্ধ করতে পারে। এমনকী, জলের প্রবাহের অভিমুখও বদলে দিতে পারে। (File Photo: PTI)
advertisement
বাঁধের মাধ্যমে এমনটা করতে পারে চিন: চিনের বড় বড় বাঁধগুলি জলের প্রবাহ বন্ধ করে তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে যে, খরার মরশুমে জল আটকে অথবা বর্ষার মরশুমে আচমকা জল ছেড়ে দিয়ে ভারত এবং পাকিস্তানের উপর প্রভাব ফেলতে পারে চিন। শুধু তা-ই নয়, চিন অন্যান্য এলাকায় জল প্রবাহের অভিমুখ বদলে দিতে পারে। যেমনটা তারা করেছিল সাউথ-নর্থ ওয়াটার ট্রান্সফার প্রজেক্টের ক্ষেত্রে। যদিও এখনও এই দুই নদীর উপর তা কার্যকর করা হয়নি। যদি চিন জল প্রবাহের তথ্য ভাগ করা বন্ধ করে দেয়, যেটা তারা করেছিল ২০১৭ সালে ব্রহ্মপুত্রের ক্ষেত্রে, তাহলে ভারতে বন্যা অথবা খরা পরিস্থিতি কঠিন হয়ে দেখা দিতে পারে।
advertisement
চিন এমনটা আগেও করেছে। ২০১৬ সালে একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য Yarlung Tsangpo (ব্রহ্মপুত্র) নদীর একটি উপনদী শিয়াকুর প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছিল চিন। এটিকে ভারতের বিরুদ্ধে একটি ভূ-রাজনৈতিক বার্তা হিসেবে দেখা হয়েছে। ২০২০ সালে গালওয়ান ভ্যালি কনফ্লিক্টের পরে চিন গলওয়ান নদী (সিন্ধু নদীর উপনদী)-র প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছিল চিন। এর জেরে ভারতে জলের ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। আবার ২০০৪ সালে শতদ্রু নদীর উপনদী পরেচু নদীর উপর একটি কৃত্রিম হ্রদ তৈরি করা হয়েছিল। ভারতের আশঙ্কা ছিল যে, এটা জল বোমা হতে পারে। যদিও চিন তখন সেই ডেটা ভাগ করে নিয়েছিল। যা কোনও বড় ক্ষতির সম্ভাবনা এড়াতে পেরেছে। (Image: AFP)
advertisement
জল আটকে রাখা যেন একটা হাতিয়ার: নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে জল আটকে রাখা একটি ভূরাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। গালওয়ান অথবা ডোকলামের সীমান্ত উত্তেজনার মতো ভারতের সঙ্গে অশান্তির মধ্যে চিন কিন্তু অস্ত্র হিসেবে জলকে ব্যবহার করতে পারে। চিন এবং পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের কারণে যদি ভারত সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করে দেয় অথবা পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ জলের পরিমাণ কমিয়ে দেয়, তাহলে চিন সিন্ধু অথবা শতদ্রু নদীর জল বন্ধ করে দিয়ে প্রতিশোধ নিতে পারে। এদিকে চিনে জল এবং জ্বালানির চাহিদা ক্রমবর্ধমান হওয়ার কারণে তারা এই নদীগুলির জল নিজস্ব ব্যবহারের জন্য সরিয়ে নিতে পারে। সম্প্রতি দাবি করা হয়েছে যে, ভারত চুক্তি স্থগিত করার পর পাকিস্তান চিনকে ব্রহ্মপুত্র ও শতদ্রু নদীর জল বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করেছিল। কিন্তু এই দাবিগুলিকে ভুয়ো বলে প্রমাণিত হয়েছে।