আধুনিক নগরজীবনে আবারও ফিরে আসছে সেই ‘পাড়া’ সংস্কৃতি, মানুষের মধ্যে বাড়ছে মেলামেশা, সৌজন্যে রয়েছে সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত ভাবে তৈরি কমিউনিটি
- Published by:Siddhartha Sarkar
Last Updated:
এখনকার সুচিন্তিত এবং সুপরিকল্পিত ভাবে তৈরি রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্স এবং ইন্টিগ্রেটেড টাউনশিপগুলি পাড়ায় বসবাস করার সেই অনুভূতিটা ফিরিয়ে আনছে। অর্থাৎ এই ধরনের প্রজেক্টগুলি সচেতন ভাবে ঐতিহ্যবাহী পাড়া সংস্কৃতির সেই চিরচেনা ধারাকে পুনঃপ্রবর্তন করার চেষ্টা করছে।
এমনিতে বৈচিত্র্যপূর্ণ ইতিহাস এবং প্রাণবন্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ কলকাতা শহর। তবে পুরনো এই শহরের প্রাণ হল এখানকার ‘পাড়া’ সংস্কৃতি। আসলে পাড়া এমন একটা জায়গা, যেখানে প্রতিবেশীদের মধ্যে আলাপচারিতার মাধ্যমে একটা অনন্য আত্মীয়তার বন্ধন তৈরি হয়ে যায়। ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন পটভূমি থেকে উঠে আসা মানুষের মধ্যেও সমন্বয় ঘটায় পাড়া। বলা ভাল, সকল জাতি-ধর্ম, বর্ণ আর বয়স নির্বিশেষে বিভিন্ন ধরনের মানুষকে এক করে একটা পাড়া। আবার একটা ক্লান্তিকর দিনের শেষে যেন এই পাড়াই মানুষের মনে একঝলক টাটকা বাতাস বয়ে নিয়ে আসে। যদিও আজকাল উন্নয়ন এবং আধুনিকতার যুগে দাঁড়িয়ে নগরায়ন ক্রমেই বাড়ছে। যা ‘পাড়া’ সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটা প্রভাব ফেলছে। (Representative Image)
advertisement
সুপরিকল্পিত কমিউনিটির বিকাশ: ইতিমধ্যেই একটা নতুন ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে। আসলে এখনকার সুচিন্তিত এবং সুপরিকল্পিত ভাবে তৈরি রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্স এবং ইন্টিগ্রেটেড টাউনশিপগুলি পাড়ায় বসবাস করার সেই অনুভূতিটা ফিরিয়ে আনছে। অর্থাৎ এই ধরনের প্রজেক্টগুলি সচেতন ভাবে ঐতিহ্যবাহী পাড়া সংস্কৃতির সেই চিরচেনা ধারাকে পুনঃপ্রবর্তন করার চেষ্টা করছে। এই সমস্ত রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্সের বাসিন্দাদের জমায়েত এবং আড্ডার জন্য একটা নির্দিষ্ট জায়গা রাখার উপরে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে সুচিন্তিত ভাবে তৈরি ওই জায়গা আবাসিকদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করে। এর ফলে কমিউনিটি ইভেন্টের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। (Representative Image)
advertisement
কমিউনিটি বা বাসিন্দাদের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি: কলকাতার প্রাণ পাড়া সংস্কৃতির কথা মাথায় রেখে আধুনিক সময়ের রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্সগুলিতে সেলিব্রেশন স্পেস, অ্যাম্পিথিয়েটার, সিনিয়র সিটিজেনদের বসার জায়গা, জমায়েতের জন্য নির্দিষ্ট জোন রাখার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। দূরদর্শী স্থপতি প্রয়াত বালকৃষ্ণ দোশির তৈরি অম্বুজা নেওটিয়ার Udayan প্রকল্পের মতো পথ প্রদর্শকদের থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করে স্থপতিরা একটি প্রাণবন্ত সামাজিক বাস্তুতন্ত্র তৈরির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। যা একসঙ্গে থাকার সেই অনুভূতি আবার ফিরিয়ে এনেছে। (
advertisement
এই রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্সগুলিতে আড্ডা দেওয়ার পকেট তৈরির উপর জোর দেওয়া হয়েছে। এর জন্য উঠোনের মতো লনে বসে আড্ডা দেওয়ার কিংবা গল্প করার জায়গা তৈরি করা হচ্ছে। এরপরেই রয়েছে অ্যাম্ফিথিয়েটার। বড়সড় কোনও জমায়েত, অনুষ্ঠান, উৎসব উদযাপনের জন্য এটি ব্যবহার করতে পারেন বাসিন্দারা। পাড়ায় যেমন অনুষ্ঠানের জন্য একটা নির্দিষ্ট জায়গা থাকে, এই অ্যাম্ফিথিয়েটার ঠিক সেরকমই। শুধু তা-ই নয়, এই কমপ্লেক্সগুলিতে আজকাল সুচিন্তিত ভাবে পরিকল্পনা করেই বসার জায়গা কিংবা আড্ডা দেওয়ার জায়গা রাখা হয়। এখানে তথ্য-সংস্কৃতির আদানপ্রদানের মাধ্যমে একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে আবাসিকদের মধ্যে। আর এই আড্ডায় সঙ্গী হয় গাছে ঘেরা সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যও। আনাগোনা করতে পারে বিশুদ্ধ বাতাসও। আর এই বিষয়গুলিই সামাজিক বন্ধন গড়ে তুলতে অনেকটাই সহায়ক। সেই সঙ্গে এটি পাড়া সংস্কৃতিকেও উদযাপন করে। (Representative Image)
advertisement
কেস স্টাডি: তত্ত্ব যখন প্রাণ পায় বড় মাপের রেসিডেন্সিয়াল প্রজেক্টগুলির সঙ্গে কীভাবে কমিউনিটি লিভিং একাত্ম হয়ে উঠেছে, তার পরিচায়ক হিসেবে ধরা যেতে পারে Utalika-র মতো রেসিডেন্সিয়াল প্রজেক্ট। আর এই ধরনের প্রজেক্টের মূল উপজীব্য হল দুর্দান্ত সুন্দর সুদৃশ্য বাগান, ক্লাব, কমিউনিটি হল। যেখানে জমায়েত করে আড্ডা দিতে পারেন এখানকার বাসিন্দারা। শুধু আড্ডাই নয়, একেবারে ঐতিহ্যবাহী পাড়ার মতোই বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও আয়োজিত হয় এখানে।
advertisement
এই প্রসঙ্গে অম্বুজা নেওটিয়ার চেয়ারম্যান হর্ষবর্ধন নেওটিয়া (Harshavardhan Neotia) বলেন যে, অম্বুজায় শুধুমাত্র স্থাপত্য নির্মাণই আমাদের লক্ষ্য নয়। বরং স্থাপত্যই মেলবন্ধন গড়ে তোলে। আসলে আমাদের কমিউনিটিগুলি শুধুমাত্র মানুষের বসবাসের জন্যই তৈরি করা হয় না। বরং তাঁদের একসঙ্গে একাত্ম করে তোলার জন্যই তৈরি করা হয়। বাংলার মধ্যে নিহিত থাকা পাড়া সংস্কৃতির থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েই এগুলি তৈরি। আসলে পাড়ার প্রত্যেকটা জায়গা, দোকানপাট এবং বসার জায়গা আলাপচারিতা এবং আড্ডার সুযোগ দিয়ে থাকে। আর আমাদের প্রজেক্টগুলিও সেই চেতনার একটি আধুনিক পুনর্কল্পনা।
advertisement
তিনি আরও বলে চলেন যে, ডিজাইনের ভাবনার মাধ্যমে আমরা লে-আউটের বাইরে গিয়ে চিন্তা করেছি। আর নিজেদের এক গভীর প্রশ্ন করেছি যে, মানুষের মধ্যে কীভাবে আলাপ-সাক্ষাৎ হবে? কীভাবেই বা গড়ে উঠবে একে অপরের সঙ্গে বন্ধুত্বের বন্ধন? আর এর উত্তর হল - বাগানে গড়ে উঠতে পারে দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্ব, উঠোনের মতো জায়গা ভরে উঠতে পারে বাসিন্দাদের হাসির আওয়াজে, আবার ছাদে দাঁড়িয়ে মিলতে পারে একসঙ্গে সূর্যাস্ত দেখার অনুভূতিও। এমনকী ক্লাবহাউজগুলি হয়ে উঠবে নিজের বাড়ির লিভিং রুমের মতো, যেখানে আড্ডা দিলে মনে হবে নিজেরই পরিবারের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া হচ্ছে। তাই আমরা শুধু বাড়িই বানাচ্ছি না, আমরা পাড়ার মতো একটা জায়গা তৈরি করছি, যেখানে সম্পর্ক গড়ে উঠবে এবং জীবনযাপনও হবে সুন্দর।
advertisement
বাসিন্দা এবং কমিউনিটির উপর প্রভাব: রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্সগুলিতে এই ধরনের জায়গা তৈরি করার ফলে তা বাসিন্দাদের শরীর এবং মনের উপরেও ভাল প্রভাব ফেলছে। মানুষের মধ্যে মেলামেশার বোধ জাগ্রত হচ্ছে। স্থানীয় শিল্পকলা এবং রবীন্দ্র জয়ন্তী, দুর্গা পূজা অথবা দীপাবলির মতো সাংস্কৃতিক উৎসব উদযাপনের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সম্পর্কের বন্ধন আরও গাঢ় হচ্ছে। বিভিন্ন শ্রেণীর, বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষকে এক জায়গায় নিয়ে আসছে। আর সবথেকে বড় কথা হল, এর ফলে স্থানীয় ঐতিহ্যগুলিকেও বাঁচিয়ে রাখা যাচ্ছে। যা আমাদের দৈনন্দিন শহুরে জীবনের ব্যস্ততা থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। সর্বোপরি বলা যেতে পারে যে, কমিউনিটি স্পেসগুলি নিরাপত্তা, সুরক্ষার বোধ নিশ্চিত করছে। সেই সঙ্গে সমস্ত বয়সের মানুষই আড্ডা-মেলামেশায় যোগদানও করতে পারছেন। আবার কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতির উদ্রেক হলে একে অপরের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারছেন বাসিন্দারা। ফলে সব মিলিয়ে একটা নিরাপত্তার বোধও কাজ করে তাঁদের মধ্যে।
advertisement
কলকাতার রিয়েল এস্টেটের পরিস্থিতি: ২০২৫ সালে অর্থাৎ চলতি বছরে দাঁড়িয়ে কলকাতার রিয়েল এস্টেটের পরিস্থিতি মিশ্র প্রকৃতির। বরং বলা ভাল, সাধারণ ভাবে এক্ষেত্রে একটা ইতিবাচক প্রবণতাই দেখা যাচ্ছে। যদিও রেসিডেন্সিয়াল সেলসের পরিমাণ বার্ষিক ভিত্তিতে ১১ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। আবার বাণিজ্যিক রিয়েল এস্টেটের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সম্পত্তির গড় দাম বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এর প্রাথমিক কারণ হল সল্টলেক এবং রাজারহাটের মতো এলাকায় তথ্যপ্রযুক্তি এবং নমনীয় কর্মক্ষেত্রের বিকাশ। অন্যদিকে আবার যে বিষয়গুলি রেসিডেন্সিয়াল রিয়েল এস্টেটের ক্ষেত্রে গ্রাহকদের চাহিদা বৃদ্ধি করেছে, তার মধ্যে অন্যতম হল - জায়গাক প্রয়োজন, কমিউনিটি লিভিংয়ের প্রয়োজনীয়তা। এমনকী সমমনস্ক মানুষদের একসঙ্গে থাকার চাহিদাও এই বিষয়টায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এছাড়াও জিমন্যাসিয়াম, ক্লাব এবং স্পোর্টস অ্যাক্টিভিটির জন্য নির্দিষ্ট জায়গার মতো ওয়েলনেস সেন্টারের চাহিদা রয়েছে মানুষের মধ্যে। কারণ এগুলি কমিউনিটির বাসিন্দাদের একটা সুস্থ এবং সুন্দর জীবন উপহার হিসেবে প্রদান করছে। (Representative Image)
advertisement
এর ভবিষ্যৎ কোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে? চিন্তাভাবনার সঙ্গে সমন্বিত কমিউনিটি স্পেস তৈরি করা কেবলমাত্র একটি নান্দনিক প্রচেষ্টাই নয়, বরং এটি ভারতীয় সংস্কৃতির একটি অংশ হিসাবে কমিউনিটি রূপে বসবাসের আগেকার সেই অনুভূতিকে ফিরিয়ে আনার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আর হর্ষবর্ধন নেওটিয়ার মতো দূরদর্শী ব্যক্তিত্বদের হাত ধরে কমিউনিটি লিভিংয়ের ধারণাটি আবারও নগর জীবনে প্রত্যাবর্তন করেছে। আর আমরা এমন একটা সময়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি, যেখানে শহর জুড়ে শুধু উঁচু উঁচু ইমারতের ছড়াছড়ি। সঙ্গে ইঁদুর দৌড়ের ব্যস্ত জীবনযাত্রা তো রয়েছেই। সেখানে এই রেসিডেন্সিয়াল প্রজেক্টগুলি সোশ্যাল স্পেস বা সামাজিক মেলামেশার জন্য জায়গা তৈরি করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।