লেপ বানাতে কেন ব্যবহার করা হয় 'লাল কাপড়'...! পিছনে রয়েছে চমকে দেওয়া অজানা কারণ!

নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহের শুরুতেই শীতের কামড়। পারদ নামতেই শীতের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে। আর এই শীতকালেই ধুম পড়ে যায় লেপ-তোষক বানানোর। যতই রংবাহারি ব্ল্যাঙ্কেটের চল বাড়ুক, বাঙালির শীতে মাঙ্কি টুপির মতোই আজও লেপের আলাদাই কদর।

তাই শীত পড়তে না পড়তেই লেপ তোষকের দোকানে ক্রেতাদের ভিড় ও তোড়জোড় বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। আগামী দু-তিন মাস এই লেপ বানানোর কারিগর ও ব্যবসায়ীদের রীতিমতো পোয়াবারো।

কনকনে ঠান্ডার পারদ যত নামবে, ঠিক ততই বাড়বে শীত-পোশাক থেকে লেপ-কম্বলের চাহিদা। শীতের মরশুমি ব্যবসার এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইছেন না দোকানিরাও। শীত আসার আগেই দেখা যায় লেপ ও তোষকের দোকান ছেয়ে যায় লাল আভায়!

একটি প্রাচীন প্রবাদ আছে, 'যে লেপের নীচে ঘুমায় সে ভালোবাসার আরাম পায়।' তাই শীতের শুরুতে প্রতি বছর যখন উত্তরের ঠান্ডা বাতাস বইতে থাকে এবং চারিদিক শীতল হয়ে যায় তখনই লেপের সঙ্গে আমাদের ভালোবাসা আরও জমে ওঠে।

প্রযুক্তিগতভাবে বলতে গেলে, 'লেপ' (বাংলায়) বা 'রাজাই' (হিন্দিতে) এক নয়। 'লেপ' হল একটি বিছানার অংশ যা আফগানিস্তান, পাকিস্তান, উত্তর ভারত, বাংলাদেশ এবং নেপালে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।

বাংলা-সহ দেশের অন্যান্য প্রান্তে ব্যবহৃত রাজাই বা লেপের সাধারণত একটি সিল্ক বা মখমলের আবরণ থাকে যা তুলো দিয়ে ভরা থাকে। এগুলি খুব বেশি ঠান্ডা আবহাওয়াতেও প্রচুর উষ্ণতা দেয়। মূলত তুলো ও উলের মধ্যে আটকে থাকা বাতাসের অন্তরক প্রভাবের কারণেই উষ্ণতা দেয় এই লেপগুলি।

কিন্তু কখনও কি ভেবে দেখেছেন কেন লেপ-কভারের রঙ সবসময় লাল হয়? পৃথিবীতে আরও অনেক রঙ আছে কিন্তু কেন লেপ-কার্ডার বা ধুনুরিরা তাদের বিশাল বস্তায় প্রচুর পরিমাণে ইটে লাল কাপড় রাখেন মজুত করে যা তাঁরা দক্ষতার সঙ্গে বের করে আনেন আর বানিয়ে ফেলেন লেপ।

লক্ষ্য করে দেখবেন, বাঙালির শীতকালের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত এই লেপ মানেই যেন তুলায় মোড়ানো লাল কাপড়। আচ্ছা বলুন তো, বেশিরভাগ লেপে কেন লাল কাপড়ই ব্যবহার করা হয়? কী কারণ আছে এর পিছনে? আসল কারণ জানলে কিন্তু চমকে উঠবেন!

ইতিহাস বলে, এক সময় মুর্শিদাবাদের জনপ্রিয় এই শিল্পের নামডাক ছিল সর্বত্র। লম্বা আঁশের কার্পাস তুলোকে বীজ ছাড়িয়ে লাল রঙে চুবিয়ে শুকিয়ে ভরা হত মোলায়েম সিল্ক এবং মখমলের কভারে। তখন থেকেই সেই মখমলের রঙ কিন্তু ছিল 'লাল'।

সেই লেপে সুগন্ধের জন্যে দেওয়া হতো আতর। এখন অবশ্য উচ্চমূল্যের কারণে মখমলের কাপড় ব্যবহার হয় না। কিন্তু চিরায়ত সেই লাল কাপড়েই কিন্তু বানানো হয় লেপ। কিন্তু হঠাৎ হলুদ, সবুজ, নীল ছেড়ে কেন রং হল লাল? এর পিছনে কি আছে বড় কোনও কারণ?

শোনা যায়, বাংলা, বিহার, ওড়িশা-সহ অবিভক্ত বাংলার প্রথম নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ-এর আমল থেকেই রীতি অনুযায়ী লাল মখমলের কাপড় ব্যবহার করে লেপ সেলাই করা হত।

এরপর মুর্শিদকুলি খাঁর মেয়ের জামাই নবাব সুজাউদ্দিন মখমলের পরিবর্তে এই লেপের কভারে সিল্ক কাপড় ব্যবহার শুরু করেন। তবে রঙের কোনও পরিবর্তন হয়নি।

তবে মখমল ও সিল্কের কাপড়ের মূল্য জনসাধারণের হাতের নাগালে না থাকার কারণে, পরবর্তীতে সাধারণ কাপড় ব্যবহারের চল শুরু হয়। তবে তখনও কাপড়ের রঙ লালই থেকে যায়।

এদিকে এই বিষয়ে বাংলাদেশের পুরনো ঢাকার লেপ ব্যবসায়ীরা জানান, লেপে এই রীতি ও রঙের ব্যবহার নবাবরাও অনুসরণ করতেন। সেই থেকে লাল কাপড়ে লেপ বানানোর রীতি চলে আসছে।

তবে এর পিছনে রয়েছে আরও কিছু কারণ। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, লেপ কখনও ধোয়া যায় না। অথচ ব্যবহার হয় বছরের পর বছর। আর লাল কাপড় ব্যবহারের ফলে সহজে ময়লা চোখে পরে না। আর সেই কারণেই লেপের তুলোর কভারগুলি লাল করা হয়। তবে এ ক্ষেত্রেও মতান্তর রয়েছে।