

হাওড়া থেকে তারকেশ্বর লোকালে চাপতেই চোখ চলে গেল জানালার ধারে বসে থাকা এক বয়স্কার দিকে। ধবধবে সাদা শাড়ি, মাথা ভরতি পাকা চুল। বার বার কপালে হাত ঠেকাচ্ছেন আর বলছেন, ভোলানাথ সবই তোমার দয়া! জয় বাবা ভোলানাথ। কথাগুলো বলে হঠাৎ করে চেয়ে বললেন, সবই তাঁর ইচ্ছে। তিনি চাইলে তাঁর দর্শন পাবই। বলেই আবার কপালে হাত ঠেকিয়ে বিড়বিড় করতে লাগলেন। ততক্ষণে ট্রেন অনেক গুলো স্টেশন ছাড়িয়েছে। ভিড়ও হয়েছে বেশ। হঠাৎ ভিড় ঠেলে মাথায় জটা নিয়ে, গায়ে বাঘ ছাল, হাতে ত্রিশূল ও ডমরু নিয়ে স্বয়ং ভগবান শিব এসে হাজির। বয়স্কা ভদ্রমহিলার চক্ষু চড়কগাছ। এ কাকে দেখছেন তিনি। শিব বাবাজি ততক্ষণে তার হাতের থালাটা সবার দিকে এগিয়ে দিয়েছে। কেউ তাতে ১ টাকা ২ টাকা দিচ্ছে। কেউ কেউ আবার কানে ইয়ারফোন গুঁজে জানালর দিকে তাকিয়ে থাকতেই ব্যস্ত। কিন্তু চোখের সামনে শিবকে দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারলেন না বয়স্কা ভদ্র মহিলা। তিনি তারকেশ্বর যাচ্ছিলেন পুজো দিতে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে নিজের পুটুলি খুলে যা নিয়ে যাচ্ছিলেন পুজোর জন্য সব ট্রেনের শিবের ঝোলায় ঢেলে দিলেন। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে যাবেন, এমন সময় শিব ভদ্র মহিলার হাত ধরে ফেলে বলল,ছি, ছি এ কী করছেন? আমি শিব নই! আমি ছিনাথ বহুরূপী। আমি ট্রেনে শিব সেঁজে ভিক্ষে করি মা। ভদ্রমহিলা অবাক হলেন। হা করে শিব ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ছিনাথ বহুরূপী নামটা শুনেই শরৎচন্দ্রের লেখা শ্রীনাথ বহুরূপীর কথা মনে পড়ে গেল। মেজদার কঠোর তত্ত্বাবধানে ভাইদের পড়াশোনা চলছে। বারান্দায় বসে বৃদ্ধ রামকমল আফিম খেয়ে ঢুলছেন। হঠাৎ করে এক পেল্লাই বাঘের হামলা। মেজদাদা তো একেবারে ভিরমি খেলেন। শ্রীকান্তদের পড়াশোনা সব লাটে উঠল। একেবারে হুলস্থুল অবস্থা। ভয় পেয়ে বাঘ বেচারাও ডালিম গাছের আড়ালে গিয়ে লুকিয়েছে। তখনই সাহসী ইন্দ্র এসে হাজির। সব শুনে প্রথমে সেও একটু চমকায়। তারপর আলো আর লাঠি নিয়ে ডালিম গাছের দিকে যেতেই কাঁদো কাঁদো গলায় বলে ওঠে,আমি বাঘ-ভালুক নই। ছিদাম বহুরূপী। ইন্দ্র হো হো করে হেসে উঠল। কেটে দেওয়া হল বাঘ বাবাজির কাপড়ের লেজ।photo source collected


কিন্তু এই ট্রেনের মিষ্টি শিব বাবার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তারা কয়েক ঘর বহুরূপী তারকেশ্বরে থাকে। ভোরবেলা রং মেখে সং সেঁজে বেড়িয়ে পড়ে তারা। দুটো রোজগারের আশায়। যা জোটে তাই দিয়ে চলে সংসার। ছিদামই বলল, 'তারকেশ্বর যাচ্ছেন যখন পারলে একবার আমাদের গ্রাম থেকেও ঘুরে আসবেন। কালীপদ দাদু আমাদের গুরু।" যাক এতক্ষণে তাও এই যাত্রা পথের একটা মানে দাঁড়াল।তারকেশ্বর স্টেশন থেকে দশ মিনিট হাঁটলেই দেখা মেলে ছিদামদের গ্রামের। ওখানেই থাকেন কালীপদ পাল। মাটির দালান পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই চোখে পড়ল এক ভদ্রমহিলা আটপৌরে শাড়ি পরে কাঠের আঁচে রান্না করছেন। এটাই কালীপদ বহুরূপীর বাড়ি। বাড়ির মাটির দেওয়ালে লেখা 'বহুরূপী সেন্টার'। ভদ্রমহিলা নিয়ে গেলেন ঘরের ভিতর খাটে বসে থাকা ৮৫ বছরের কালীপদ পালের কাছে। তিনি খাটের ওপর বসে একটা বাঘের মুখোশ পড়ে নানা রকম ভঙ্গীতে অভিনয় করছেন। ভদ্রমহিলা বললেন, 'বাবা এখন তো আর বাইরে যেতে পারেন না। তাই ঘরে বসেই এই সব পাগালামি করে। কিছু মনে করবেন না।' কথাটা বলেই মহিলা বাইরে চলে গেলেন। কলকাতা থেকে লোক এসেছে শুনে কালীপদবাবু মুখোশটা খুলে রেখে। কানে একটা যন্ত্র গুঁজে চাকা ঘোরাতে লাগলেন। সারা ঘরে হনুমানের গদা, ত্রিশূল, পোষাক, নানা রকম ঠাকুর দেবতার মুখোশ সাঁজানো।photo source collected


কানের আওয়াজটা অ্যাডজাস্ট করে বললেন, 'কেন এসেছেন এখানে?' কী চাই আমার কাছে? আপনারা শহরের লোকেরা তো কাজ ছাড়া আসেন না আমাদের কাছে! আমি কিন্তু কোনও কাজ পয়সা ছাড়া করি না।' বলেই একটা বিড়ি বার করে ধরালেন। এই প্রশ্নের কোনও উত্তর তো আর হয় না। কেমন আছেন? একটু আপনার কথা শুনব? এবার হো হো করে হেসে ফেললেন কালীপদবাবু। 'গল্প শুনবেন তাও আমার? কীসব যে বাজে কথা বলেন। কী দরকার আপনার বলুন তো? আমার কথা কেউ শোনে না। আমাদের কথা কেউ শোনে না। আমরা বেঁচে আছি কিনা তার খবরই কেউ রাখে না। আর এসেছেন গল্প শুনতে। পেটে খিদে থাকলে কী আর গল্প হয় বাবু!'' তারপর নিজের পেটে হাত দিয়ে বললেন, 'পেটের জ্বালা কী জানেন? আমরা খেতে পাই না দু বেলা ভাল করে। আগে টাকা দেন তবে কথা বলব।" এ একেবারে শক্ত মাটি। তারপর আবার বললেন, 'একবার এক বাবু এসেছিল টিভি থেকে। এসে ছবি তুলে নিয়ে গেল। তারপর বলল অনেক টাকা দেবে। কিন্তু এক টাকাও দিল না। আমাদের তো কেউ শিল্পী ভাবে না। ভিখারি ভাবে। তাই ভিক্ষা করেই পেট চালাতে হয় আমাদের। একটা টাকা ছাড়া আমি কোনও কথা বলবো না।' কথাগুলো শেষ করে নিজেই হাউ হাউ করে কঁদে ফেললেন। কান্না থামিয়ে বললেন,'এমন ব্যবহার বাড়িতে আসা অতিথির সঙ্গে করতে নেই। তাও যে কেন করি! ধম্মে সইবে না আমার।' বলেই খাট থেকে নেমে পাশের ঘরে নিয়ে গেলেন। একটা অ্যালবাম বের করে এনে এক বিদেশী ভদ্র মহিলার ছবি দেখিয়ে বললেন, 'এই মানুষটা সৎ ছিলেন। আমাদের নিয়ে কাজ করেছিলেন। উনি আমাকে এই বাড়িটা বানিয়ে দিয়েছিলেন। আর কাউকে আমি এমন সৎ পাইনি।' তারপর হঠাৎ কী হল কে জানে। রেগে গিয়ে বললেন, 'যান এবার আসতে পারেন। যদি আমাদের কথা শুনতে হয় তবে আগে থেকে বলবেন, আমার ছেলেদের সবাইকে বাড়ি থাকতে বলব। তবে টাকা আনবেন।' কী আর করা কিছুই শোনা হল না। কাল মুখ করে বেরোতে যাব এমন সময় পিছন থেকে আবার ডাকলেন, ' দিদি যাবেন না। আমারে ক্ষমা করে দেন। মাথার ঠিক নাই। আসেন একটা জিনিস দেখাই আপনারে। বলে ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন। সেখানে মনসা ঠাকুরের পুজো করছেন তাঁর বউমা। কাঠের বাক্স খুলে বার করলেন নানা রকম পোষাক, মুখোশ। বললেন, 'এই গুলো কী জানেন? এই পোষাকগুলো পড়ে আমরা বহুরূপী সাঁজি। আর এগুলো বানাতে খরচা হয় তিন হাজার টাকা। কেউ আমাদের সাহায্য করে না। সরকার থেকেই আমরা কোনও টাকা পাই না। আমাদের বহুরুপীদের লাইসেন্স ও করাতে হয়। লাইসেন্স না থাকলে পুলিশ ধরে আমার ছেলে মেয়েদের। খুব খারাপ অবস্থা।'photo source collected


অথচ এক সময় বাংলায় বহুরূপীদের কদর একেবারেই অন্য ছিল। তাদেরকে নানা অনুষ্ঠানে ডাকা হত। তখন সবাই মাথা পিছু হাজার দুয়েক করে রোজগার করতেন। কিন্তু আজকাল বিয়ে বা বাচ্চার জন্মদিনে ডাকা হয় সেখানে কোনও পারফরমেন্স করতে দেওয়া হয় না। কেবল সং সাজিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হয় বহুরূপীদের। যা তাদের কাছে লজ্জার। আগে তারা নানা গ্রামে মেলায় গিয়ে নানা রকম খেলা দেখাতেন। আজকাল তা আর করতে দেওয়া হয় না। এখন রোজগারের একটাই রাস্তা শিব বা হনুমান সেঁজে ট্রেনে করে কলকাতা এসে ভিক্ষে করা। কালীপদ বাবুর কাছে এখনও জনা দশেক ছেলে বহুরূপী সাজতে আসে। তারাই দিনের শেষে দশটাকা করে দিয়ে যায়। এইতেই চলে সংসার। তবে এখন বেশিরভাগ ছেলেরাই আর বহুরূপী সাজতে চায় না। তারা কল কারখানা বা চায়ের দোকানে কাজে ঢুকে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে গোটা একটা শিল্পীরদল। চলে আসার সময় কালীপদবাবু হা করে নিজের মুখ দেখিয়ে বললেন,' দেকেন একটাও দাঁত নাই আমার। কিন্তু এই দাঁত গুলো আমি অল্প বয়সে নিজে নিজেই তুলে ফেলেছিলাম। কেন জানেন?' কথা শেষ করে একটা লোহার মাকালীর জিভ নিয়ে এসে বললেন, ' এই জিভটা খুব ভারি। সারাক্ষণ দাঁত দিয়ে চেপে রাখতে হত। এতে দাঁতে লাগত। তাই দাঁত তুলে ফেলি। তারপর আর লাগত না। আর এখন আমাদের এই কষ্টের কোনও দাম নেই। লোকে আমাদের ভিখারি ভাবে।' কথা শেষ করেই আবার কান্নায় ভেঙে পড়লেন কালীপদবাবু। সত্যিই মুখে আর কথা আসছিল না।photo source collected