#হলদিয়া: ইন্ডিয়ান অয়েলস, টাটা কেমিক্যালস, হিন্দ লিভার, ...হলদিয়া শহরের ওপর দিয়ে গাড়ি ছুটতে থাকলে একে একে চোখে পড়ে কারখানার শেডগুলো৷ হলদিয়া টাউনশিপ, সিটি সেন্টার, দুর্গাচক মার্কেট কমপ্লেক্স নিয়ে হলদিয়া শহরের অলিতে গলিতে আধুনিকতার ছোঁয়া৷ কর্মব্যস্ত বন্দর শহরকে দেখতে আপাতভাবে শান্তিপূর্ণ লাগলেও হলদিয়ার ভিতরে ভিতরে যে ক্ষোভ জমছে, পরত পড়ছে হতাশার তা বোঝা যায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বললেই৷
সুতাহাটার মোড়ে পৌঁছতেই পাওয়া যেতে থাকে বন্দর শহরের আধুনিকতার আঁচ৷ একসময় এই সুতাহাটার মানুষের মূল জীবিকা ছিল চাষ আবাদ আর মাছ ধরা৷ হলদিয়া বন্দর তৈরি হওয়ার পর এখানে ছোটবড় মিলিয়ে ৪৫টা ছোটবড় ইন্ডাস্ট্রি তৈরি হয়েছে৷ ইন্ডিয়ান অয়েলের মতো রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা যেমন রয়েছে হলদিয়ায়, তেমনই রয়েছে টাটা কেমিক্যালস, রয়েছে হিন্দ লিভারের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা৷ হিন্দুস্তান ফার্টিলাইজারের মতো কেন্দ্রীয় সরকারের বড় প্রকল্প রয়েছে, রয়েছে এইচ পি এল৷ মিৎসুবিশির মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাও৷ মেদিনীপুরের শিক্ষিত সমাজকে আশার আলো যেমন দেখিয়েছিল, তেমনই কাজ পাওয়ার আশা করেছিল স্বল্প শিক্ষিত সাধারণ মানুষও৷ সেই আশা হারিয়ে এখন হলদিয়ার অধিকাংশ শিক্ষিত যুবকই পাড়ি দিচ্ছে রাজ্যের বাইরে৷ কাজের জন্য হা হুতাশ ছেড়ে ছোটখাট কোনও কাজ বেছে নিচ্ছে সাধারণ মানুষ৷
এই এলাকার প্রায় ১০০টি গ্রামের জমি অধিগ্রহণ করে একসময় হলদিয়া বন্দর গড়ে উঠেছিল৷ কিছু মানুষ হলদি নদী পেরিয়ে নন্দীগ্রামের দিকে চলে গিয়েছিল৷ যারা এখানে থেকে গিয়েছিল তাদের চাষের জমি কমেছিল অবশ্যই৷ একসময় হলদিয়া বন্দরের সহজ অপারেটিভ কাজগুলো এই জমি হারানো মানুষরাই করতো৷ এখন প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কারণেই মেশিনের ব্যাবহার বেড়েছে৷ কল কারখানার কাজে ব্যবহার করা হয় উন্নত মানের ক্রেইন৷ ফলে আগে যে কাজ করতে ১৫০ জন শ্রমিকের প্রয়োজন হতো, এখন মাত্র ১০ জন শ্রমিকই সেই কাজের প্রয়োজনীয়তা মিটিয়ে দিচ্ছে৷ তাই চাহিদা-জোগানের সমস্যায় জর্জরিত হলদিয়া৷ "বিএ সেকেন্ড ইয়ার পর্যন্ত পড়েছিলাম৷ আশা করেছিলামে এখানে কোনও কাজ পেয়েই যাবো৷ চাষবাস করতে আর ভাল লাগে না৷ সংসার তো করেছি, টানতে তো হবে বলুন?"-কথাগুলো বলতে বলতেই প্যাসেঞ্জার ভরে গিয়েছিল টোটোয়৷ ব্যস্ত হাতেই অ্যাকসিলেটরে চাপ দেয় যুবক৷
পূর্ব মেদিনীপুরের শিক্ষার মান বরাবরাই উন্নত৷ তমলুক, মহিষাদল, সুতাহাটা প্রতিটি অঞ্চলই রাজ্যের অন্যান্য একালার থেকে মাস এডুকেশন অর্থাৎ সার্বিক শিক্ষার দিক থেকে এগিয়ে রয়েছে অনেকটাই৷ ফলে শিক্ষিত যুবক-যুবতীর সংখ্যা যেহেতু বেশি, কাজের চাহিদাও বেড়েছে উত্তরোত্তর৷ হলদিয়া বন্দরে স্থায়ী, অস্থায়ী মিলিয়ে মোট ৭০ হাজার শ্রমিক রয়েছেন৷ এই মুহূর্তে হলদিয়া বিধানসভা এলাকার মোট ৩৬ হাজার মানুষ হলদিয়া বন্দরে কাজ করেন৷ প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে কাজের চাহিদা৷ মেদিনীপুরের শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়তে বাড়েই কর্মসংস্থানের জোগান দিতে ব্যর্থ হয়েছে হলদিয়া৷ ফলে এই এলাকায় নতুন করে ইন্ডাস্ট্রি না গড়ে উঠলে কাজ পাওয়ার কোনও আশাই প্রায় দেখছে না হলদিয়ার যুব সমাজ৷
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়াও৷ অধিকাংশ সংস্থাতেই কন্ট্রাক্টচুয়াল অর্থাৎ চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগ করা হয় এখন৷ ফলে এক সময় যে বন্দরে ২০ হাজার শ্রমিকের স্থায়ী চাকরি ছিল, সেখানে এখন স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ২-৩ হাজারে৷ "নোটবন্দির পর মোদি সরকার ২ কোটি চাকরির আশ্বাস দিয়েছিল৷ বদলে এখন ৪ কোটি ১৭ লক্ষ মানুষ বেকার৷ ৪৫ বছরের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে..." ক্ষোভ ঝরে পড়ছিল সিটি সেন্টারের সিঁড়িতে বসে আড্ডারত এম.এ পাশ যুবতীর কথায়৷ মোদি সরকার বিরোধী হাওয়া কিন্তু হলদিয়ার আনাচে কানাচে৷ নগরায়নের ফলে হলদিয়ায় বেড়েছ জীবনযাত্রার মান৷ বেড়েছে দৈনন্দিন খরচ৷ ফলে মূল্যবৃদ্ধি নিয়েও ক্ষোভ জমছে প্রতিদিন৷
তমলুক লোকসভা কেন্দ্রের অন্যতম বিধানসভা কেন্দ্র হলদিয়া৷ ১২ মে ভোটগ্রহণ এখানে৷ সুতাহাটা, হলদিয়া দুই বিধানসভা মিলিয়ে ভোটার সংখ্যা ৪ লক্ষের উপর৷ ভোটের লড়াইয়ে তৃণমূলের দিব্যেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে কংগ্রেস প্রার্থী দুঁদে রাজনীতিক লক্ষ্মণ শেঠ৷ একসময় বিপুল জনপ্রিয়তা থাকলেও নন্দীগ্রাম কান্ডের পর দুর্নীতির অভিযোগ, দলবদল নিয়ে লক্ষ্ণণ শেঠের ওপর থেকে আস্থা হারিয়েছিল সাধারণ মানুষ৷ তবে বহুবছর পরে এবার লোকসভা ভোটের আগে সেই নন্দীগ্রামেই সভা করতে দেখা গিয়েছে লক্ষ্ণণ শেঠকে৷ আবার এই লোকসভা কেন্দ্রেরই অন্যতম বিধানসভা কেন্দ্র সুতাহাটা এখনও বামেদের শক্ত ঘাঁটি৷ ফলে লড়াইয়ে রয়েছেন বাম প্রার্থী ইব্রাহিম আলিও৷ অন্যদিকে, দলীয় রাজনীতির উপরে গিয়ে ব্যক্তি লক্ষ্মণ শেঠকে নিয়েও কিন্তু হলদিয়াবাসীর আবেগ রয়েছে৷ ফলে তমলুক লোকসভার এই দুই বিধানসভায় অন্তত লড়াই ত্রিমুখীই বলা যেতে পারে৷
সুতাহাটার দিকে এগোল বেকারত্বের যে ছবিটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে সেই ক্ষোভের আঁচ কিন্তু তমলুক বা মহিষাদলে অতটা প্রকট নয়৷ হয়তো কারখানার কালো চিমনিগুলো এত কাছ থেকে দেখা যায় বলেই হতাশা বাড়ে সুতাহাটা, হলদিয়ার৷"আমার এখানে কারখানা হল, এদিকে আমার ছেলেটাই কাজ পেল না..." হলদি নদীর বাঁধানো ঘাটের হাওয়ায় মিলিয়ে যায় এমনই বহু বাবার দীর্ঘশ্বাস৷ ঘন হয় চিমনির কুন্ডলী পাকানো কালো ধোঁয়া৷
নিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।
Tags: Elections 2019, Loksabha Elections 2019, Sixth Phase Voting, Special Story, West Bengal Lok Sabha Elections 2019