রবি ঠাকুরের হাত ধরে এ দেশে নৃত্যকলার প্রসার ঘটেছিল
Last Updated:
#কলকাতা: ‘‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে
তাতা থৈ থৈ, তাতা থৈ থৈ, তাতা থৈ থৈ ।’’
নাচ আর রবীন্দ্রনাথ, জড়িয়ে রয়েছে অঙ্গাঙ্গীভাবে ৷ নৃত্যশিল্পী হিসেবে সেভাবে আত্মপ্রকাশ না হলেও বঙ্গদেশে নৃত্যের জগতে দু’জন বাঙালির বিশেষ অবদান রয়েছে ৷ প্রথমজন হলেন শ্রীচৈতন্য দেব ৷ আর অন্যজন হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৷
advertisement
কলকাতায় তখন বাবুশ্রেণীর বাড়বাড়ন্ত ৷ বাবু সংস্কৃতি ভাবাপন্ন মানুষেরা ক্রমশই দেশীয় সংস্কৃতি-ঐতিহ্যকে খাটো নজরে দেখতে শুরু করেন ৷ আর এর ফলস্বরূপ নৈতিকতার অবনমন ঘটেছিল অনেক ক্ষেত্রেই ৷ মধ্যবিত্ত অভিজাত সমাজ থেকে সুচারুরূপে নৃত্যকলার সমাদর বর্জিত হল ৷ অবশ্য এ শুধু বাংলারই ছবি নয়, প্রায় গোটা ভারতবর্ষের ছবি ছিল এটাই ৷ সে সময়ে রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব ও প্রচেষ্টার আগে পর্যন্ত শিক্ষিত সমাজে নৃত্যকলার কোনও শ্রদ্ধার আসন ছিল না ৷ স্বভাবই নৃত্যশিল্পের মান ক্রমশই তলানিতে গিয়ে ঠেকে ৷ আর নৃত্যকলার মতো উৎকৃষ্ট শিল্পের প্রদর্শন শুধু পণ্যশুল্কা বারবধূশিল্পীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে ছিল ৷
advertisement
সে জায়গাতে রবি ঠাকুর শিক্ষার অন্যতম বাহনরূপে ললিতকলার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন ৷ তিনি বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে লিখেছিলেন-‘ব্যাপকভাবে এই সংস্কৃতি অনুশীলনের কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে দেব, শান্তিনিকেতন আশ্রমে এই আমার অভিপ্রায় ছিল ৷ আমাদের দেশের বিদ্যালয় পাঠ্যপুস্তকের পরিধির মধ্যে জ্ঞানচর্চার যে সংকীর্ণসীমা নির্দিষ্ট আছে কেবলমাত্র তাই নয়, সকলরকম কারুকার্য, শিল্পকলা, নৃত্যগীতবাদ্য, নাট্যাভিনয় এবং পল্লীহিত সাধনের জন্যে যে সকল শিক্ষা ও চর্চার প্রয়োজন সমস্তই সংস্কৃতির অন্তর্গত বলে স্বীকার করব ৷ চিত্তের পূর্ণ বিকাশের পক্ষে এই সমস্তই প্রয়োজন আছে বলে আমি জানি ৷’
advertisement
এ সকলে সহমত হবেন যে তৎকালীন সমাজে রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই শিক্ষার অঙ্গ হিসেবে নৃত্যকলার স্বীকৃতি-এই প্রয়াসই আজকের নৃত্যকলার অনুশীলন ও প্রসারের মূল কারণ ৷ এই কলা প্রসারের জন্য সমাজের সমস্ত প্রতিবন্ধকতা, সংবাদপত্রের আক্রমণ নীলকন্ঠের মতো কন্ঠে ধারণ করে দৃঢ় পদক্ষেপে অবিচল চিত্তে নির্ভীকভাবে কাজ করে যান ৷ যার জন্যই আজ নৃত্যচর্চা করতে পারছি আমরা ৷
advertisement
‘জাভা যাত্রীর পত্র’তে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন-‘মানুষের জীবন বিপদ-সম্পদ-সখ-দুঃখের আবেগে নানাপ্রকার রূপে ধ্বনিতে-স্পর্শে লীলায়িত হয়ে চলেছ, তার সমস্তটা যদি কেবল ধ্বনিতে প্রকাশ করতে হয় তাহলে সে একটা বিচিত্র সঙ্গীত হয়ে ওঠে, তেমনি আর সমস্ত ছেড়ে দিয়ে সেটাকে কেবলমাত্র যদি গতি দিয়ে প্রকাশ করতে হয় তাহলে সেটা হয় নাচ ৷ ছন্দোময় সুরই হোক আর নৃত্যই হোক তার একটা গতিবেগ আছে, সেই বেগ আমাদের চৈতন্যে রসচাঞ্চল্য সঞ্চার করে তাকে প্রবলভাবে জাগিয়ে রাখে ৷ কোনও ব্যাপারকে নীবিড়ভাবে উবলব্ধি করাতে হলে আমাদের চৈতন্যকে এইরকম বেগবান করে তুলতে হয় ৷’
advertisement
এই চৈতন্যকে গতিশীল করার সাধনায় ছন্দ প্রয়োগের প্রথম প্রয়াসেই যে নৃত্যের উৎস তাও রবি ঠাকুর সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করে গিয়েছেন ৷ কোথাও তিনি বলেছেন, ‘‘মানুষ তার প্রথম ছন্দের সৃষ্টিকে জাগিয়েছে আপন দেহে ৷ কেননা তার দেহ ছন্দ রচনার উপযোগী ৷ আবার নৃত্যকলার প্রথম ভূমিকা দেহসঞ্চালনে অর্থহীন সুষমায় ৷ তাতে শুধুমাত্র ছন্দের আনন্দ ৷’
advertisement
আবার কোথাও লিখছেন, ‘‘আমাদের দেহ বহন করে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ভার, আর তাকে চালনা করে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গতিবেগ ৷ এই দুই বিপরীত পদার্থ যখন পরস্পরের মিলনে লীলায়িত হয় তখন জাগে নাচ ৷ দেহের ভারটাকে দেহের গতি নানা-ভঙ্গিতে বিচিত্র করে-জীবিকার প্রয়োজনে নয়-সৃষ্টির অভিপ্রায়, দেহটাকে দেয় চলমান শিল্পরূপ ৷ তাকে বলি নৃত্য ৷’
অর্থাৎ গুরুদেব এই ধরনের নান উদ্ধৃতির মধ্য দিয়ে নৃত্যকলার প্রতি তাঁর প্রগাঢ় অনুরাগ ও শ্রদ্ধা প্রকাশ পায় ৷ এই কারণে কবিগুরুর কাছে নৃত্যকলা মর্যাদা পেয়েছিল দেহের চলমান শিল্পরূপে ৷ তাঁর মনকে অনাবিল আনন্দে আমোদিত করেছে এর ছন্দের আনন্দে ৷ আর সেই কারণে তিনিই আধুনিক ভারতে প্রথম গড়ে তুলেছিলেন শান্তিনিকেতনে নাচের একটি প্রাণবান আন্দোলন ৷ তাঁর সময় যে সব শাস্ত্রীয় নৃত্যগুলি সদ্য পুনর্গঠিত হয়েছিল তিনি সেই সব নৃত্যকলার পৃষ্ঠপোষক করেন এবং তাঁর জন্যই ভারতীয় শাস্ত্রীয় ও লোকনৃত্য উভয় ধারাই মর্যাদার অভাব দেখা দিয়েছিল প্রবলভাবে উনবিংশ শতক থেকে নগরবাসী শিক্ষিত সমাজে ৷ সেখানে নৃত্যকলা ছিল শুধুমাত্র সস্তা-চটুল বিলাসের সামগ্রী মাত্র ৷ নিম্নস্তরের বিলাস ছাড়া যে মানবচিত্তে নৃত্যের যে অন্য কোনও স্থান থাকতে পারে সে বোধও হারিয়েছিল তৎকালীন শিক্ষিত সমাজ ৷
advertisement
শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে ৷ ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গা থেকে নৃত্য শিক্ষাগুরু আনিয়ে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে নৃত্যশিক্ষা ও চর্চার উন্মুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলেন ৷
শোনা যায় তৎকালীন কোচিন রাজ্যের রাজা গুরুদেবের অনুরোধে কল্যাণী আম্মা নামে একজন ‘নর্তকী’কে শান্তিনিকেতনে পাঠান ৷ তাঁর খরচ বহন করতেন কোচিনের রাজাই ৷ কল্যাণী আম্মা তখন মধ্যবয়সী ৷ কোচিনে দেবদাসী নৃত্যে এক সময় তিনি বেশ নামী শিল্পী হিসেবে পরিচিত ছিলেন ৷ তিনি এসে শান্তিনিকেতনে শিখিয়েছিলেন স্বরম, কইকুট্টিকলি ও কলামুল্লি নামে কয়েকটি নাচ ৷ কথাকলির নৃত্যগুরুও এসেছিলেন কেরালা থেকে ৷ কল্যাণী আম্মা কেরলে ফিরে যাওয়ার পর কোচিনের রাজা ভেলায়ুম মেনন নামে একজন নৃত্যশিল্পীকে পাঠিয়েছিলেন ৷
শাস্ত্রীয় নৃত্যের পাশাপাশি লোকানৃত্যের ধারাকে গুরুদেব সম মর্যাদার আসনে বসিয়েছিলেন ৷ তিনি শান্তিনিকেতনের ছাত্র-ছাত্রীদের ময়ূরভঙ্গ ছৌ শেখানোর জন্য বারিপদা থেকে শিক্ষক আনাবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন ৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি ৷ ১৯২৪ সালে শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক জাহাঙ্গীর ভকিলের স্ত্রী বিশ্বভারতীর মেয়েদের গুজরাতি গরবা শেখান ৷ গুরুদেবের অনুরোধে গুরুসদয় দত্ত সিউড়ি থেকে রায়বেঁশে নাচের শিক্ষক পাঠান ৷ নানা প্রচেষ্টায় গুরুদেব শান্তিনিকেতনে গড়ে তুলতে পেরেছিলেন নাচের একটি প্রাণবন্ত আন্দোলন ৷
১৯১১ সালের বৈশাখে ‘রাজা’ নাটক হয় বিদ্যালয়ের ছাত্র-অধ্যাপকদের সহযোগ ৷ তাদের মধ্যবর্তী ঠাকুরদারূপী কবিগুরুর নৃত্য সবাইকে মুগ্ধ করেছিল ৷ ১৯১৪ সালের বৈশাখে ‘অচলায়তন’-এর অভিনয় হয় ৷ ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে শান্তিনিকেতনে এবং ১৯১৬ সালে কলকাতায় ‘ফাল্গুনী’ নাটকে অভিনয়ে অন্ধ বাউলের ভূমিকায় গুরুদেব খুবই দক্ষতার সঙ্গে নাচ করেছিলেন ৷ তবে এটাই প্রথম নয় বিভিন্ন লেখালেখি থেকে জানা যায়, ১৯ বছর বয়সে রবি ঠাকুর প্রথমবার ইংল্যান্ডে যান ৷ সে দেশে তিনি ছিলেন প্রায় দেড় বছর ৷ সে সময় তাঁকে ইংল্যান্ডের সামাজিক নৃত্য শিখতে হয়েছিল ৷ পার্টিতে সেই ধরনের নৃত্যে অংশগ্রহণ করতে হয়েছিল ৷ পরবর্তীকালে এই নাচের আঙ্গিকেই ‘আয় তব সহচরী হাতে হাতে ধরি ধরি’ নৃত্যটি তৈরি হয়েছিল ৷
শান্তিনিকেতনের নৃত্যধারায় দেশি-বিদেশি, শাস্ত্রীয়, লোক বিভিন্ন ধরনের নৃত্যের সংমিশ্রন হয়ে নতুনরূপ পরিগ্রহ করে এবং আধুনিক নৃত্যধারার জন্ম দেয় ৷ সুবিখ্যাত শান্তিদেব ঘোষ দেশে-বিদেশে বিভিন্ন জায়গায় গুরুদেববের প্রেরণায় নাচ শেখার জন্য ভ্রমণ করেছিলেন ৷ তিনি কেরালা যান কথাকলি শিখতে , সিংহল যান ক্যান্ডি শিখতে, জাভা-বলিদ্বীপ যান সেখানকার নৃত্যকলা ‘রামপোয়ে’ শিখতে ৷ অর্থাৎ বিভিন্ন নৃত্যশৈলীকে এক ছাঁচে ফেলে অন্য একটি ধারা তৈরি করতে চেয়েছিলেন রবি ঠাকুর ৷ তিনি ব্যক্তিগতভাবে নৃত্যশিল্পী হিসেবে পরিচিত নন কিন্তু ভারতবর্ষে নাচের একটা নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে গিয়েছেন ৷ তবে এই কাজ করতে গিয়ে পড়তে হয়েছে অনেকের বিরোধিতার সামনেই ৷ তবে নিজের লক্ষ্যে স্থির ছিলেন তিনি ৷ তাই তো তিনি বলেছেন-‘‘আমি বিচিত্রের মধ্যে দূত ৷ নাচি নাচাই, হাসি হাসাই, গান করি, ছবি আঁকি, যে আবির বিশ্বপ্রকাশের অহেতুক আনন্দে অধীর আমি তাঁরই দূত ৷ যে বিচিত্র বহু হয়ে খেলে বেড়াল দিকে দিকে সুরে গানে নৃত্যে চিত্রে বর্ণে বর্ণে রূপে রূপে সুখ দুঃখের আঘাতে সংঘাতে ভাল মন্দের দ্বন্দ্বে-তাঁর বিচিত্র রসের বাহনের কাজ আমি গ্রহণ করেছি ৷ এই আশ্রমের নীলাকাশ উদয়াস্তর প্রাঙ্গণে এই সুকুমার বালক-বালিকাদের লীলা সহচর হতে চেয়েছিলাম ৷ লীলাময়ের লীলার ছন্দ মিলিয়ে এই শিশুদের নাচিয়ে গাইয়ে এদের চিত্তকে আনন্দে উদ্বোধিত করার চেষ্টাতেই আমার আনন্দ, আমার সার্থকতা ৷’’
ছবি: দেবমাল্য দাস ও নিলাদ্রি শঙ্কর রায় ৷
view commentsLocation :
First Published :
August 07, 2018 10:45 AM IST