ত্রিপুরা: এই শেষ। এই শেষবার। ১৬ ফেব্রুয়ারির পরে আর তাঁদের কাছে ভোটভিক্ষা করতে আসবেন না তাঁদের 'বুবাগ্রা' (ত্রিপুরার রাজা) । এই রাজনীতি তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে। দূরে সরিয়ে দিয়েছে অনেকের থেকে। অনেকেই তাঁকে ভুল বুঝেছেন। অথচ, তিনি তো নিজের জন্য রাজনীতির ময়দানে আসেননি। এসেছিলেন ত্রিপুরার সাধারণ মানুষের জন্য। তাঁদের সুখ, দুঃখ, দাবিদাওয়ার কথা ভেবে। ২০২৩-এর ত্রিপুরা নির্বাচনই তাঁর শেষ রাজনৈতিক সংগ্রান। শেষ নির্বাচনী প্রচারে ত্রিপুরার মানুষের কাছে এই ভাবেই নিজেকে হাট করে মেলে ধরেছেন প্রদ্যোৎ কিশোর মাণিক্য দেববর্মা। হয়ত তিনিও ভাবছেন। এই শেষ। এই শেষ সুযোগ।
প্রদ্যোৎ কিশোর মাণিক্য দেববর্মা। ত্রিপুরার জনজাতির আদরের রাজা, 'বুবাগ্রা'। ত্রিপামোথা-র মাথা। সেই তিপ্রামোথা, যা ভোটের আগে রীতিমতো রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে বিজেপির বাঘা বাঘা নেতাদের। ক্ষমতায় ফিরতে যে তিপ্রামোথার দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে বাম-কংগ্রেস। কিন্তু, ঠিক কীভাবে ত্রিপুরা রাজনীতিতে এতটা জায়গা করে নিল মাত্র দু-তিন বছর পুরনো একটা দল? কী কারণে তেইশের বিধানসভা নির্বাচনে এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল এই দল? সেই অঙ্ক বুঝতে হলে, হিসাব করতে হবে অনেক সিঁড়ি ভাঙা ইতিহাস।
আরও পড়ুন: আদিবাসীরা বিমুখ, ত্রিপুরা ধরে রাখতে বিজেপি-র ভরসা বাঙালি ভোট! অঙ্ক এবার কঠিন
পিছিয়ে যাওয়া যাক ষাট কিংবা সত্তরের দশকের শুরুতে। সেই সময় ত্রিপুরায় চলছে কংগ্রেস রাজ। তখন নিজেদের দাবিদাওয়া আদায়ে কমিউনিস্ট পার্টির উপরেই ভরসা রাখত ত্রিপুরার জনজাতির মানুষেরা। যেমন, ১৯৭২-এ ত্রিপুরার বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের দিকে নজর রাখলে দেখা যাবে, গোটা রাজ্যে দুই তৃতীয়াংশ আসন জিতলেও, জনজাতি অধ্যুষিত এলাকার দুই তৃতীয়াংশ আসনই গিয়েছিল সিপিএম-এর দখলে।
এরপর ১৯৭৭-এ জনজাতি এলাকার মানুষের সুবিধা-অসুবিধা তুলে ধরার জন্য তৈরি হয় নতুন সংগঠন। ত্রিপুরা উপজাতি যুব সমিতি, TUJS। মূলত, তাদের সমর্থনে ভর করেই ত্রিপুরায় ক্ষমতায় আসে বামেরা। কিন্তু, ১৯৮৯-তেই জোট বদল। বাম ছেড়ে কংগ্রেসের হাত ধরে TUJS। কংগ্রেস ফেরে ক্ষমতায়।
অর্থাৎ, ইতিহাস বলছে, ত্রিপুরার নির্বাচনে সবসময়েই নির্ণায়ক ফ্যাক্টর হিসাবে কাজ করেছে ত্রিপুরার জনজাতির ভোট। যখন যে দিকে তাঁদের সমর্থন গিয়েছে, রাজনীতির ময়দানে তারাই পেয়েছে বাড়তি মাইলেজ।
এরপরে ত্রিপুরা রাজনীতির অঙ্ক বোঝার আরেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হয়ে ওঠে TTADC। ত্রিপুরা ট্রাইবাল অটোনোমাস ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল। ১৯৭৯ সালে জনজাতি অধ্যুষিত এলাকার প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে তৈরি হয় এই কাউন্সিল। ভৌগোলিক ভাবে এই TTADC-র নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়ে ত্রিপুরার দুই তৃতীয়াংশ এলাকা। বিধানসভার নিরিখে যা ২০ বিধানসভা আসনের সমান।
২০০১ সাল নাগাদ হারিয়ে যায় সাতাত্তরের ত্রিপুরা উপজাতি যুব সমিতি। পরিবর্তে জন্ম হয় জনজাতিদের দুই নতুন সংগঠনের। এক, ইনডিজেনাস ন্যাশনালিস্ট পার্টি অফ তিপ্রা (INPT) এবং, দুই , ইনডিজেনাস পিপলস ফ্রন্ট অফ ত্রিপুরা (IPFT)। এই দুই দলের মধ্যে ভাঙাচোরার খেলা চলতে থাকে।
এরপরে, কাট টু, ২০১৮ সাল। ত্রিপুরা বিধানসভা নির্বাচন। বঙ্গে বামেদের অবক্ষয় ভাঙনের সূচনা করেছিল আগেই। ত্রিপুরাতেও বামেদের একচেটিয়া রাজত্বে ধীরে ধীরে চিড় ধরছিল জনসমর্থনে। কর্মসংস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা, যোগাযোগের মতো পরিকাঠামো নিয়ে ধিকি ধিকি ক্ষোভ জন্মাচ্ছিলই। তারমধ্যেই, মোদি ঝড়। বহুদিন ধরে ফাঁকা পড়ে থাকা ত্রিপুরার বিরোধীদের জায়গায় জমিয়ে বসল বিজেপি। তারপরে, নির্বাচনে বাজিমাত। ২০১৮-র বিধানসভা নির্বাচনে জনজাতি সংগঠন IPFT-কে সঙ্গী করে সরকার গড়ে বিপ্লব দেব-এর বিজেপি।
কিন্তু, একসময়, কাছের মানুষদের সমর্থন হারাতে থাকে এই IPFT। IPFT-র নির্মাণের মূল ভিত্তি ছিল কিন্তু একটাই দাবি। গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড। ৭০ শতাংশ 'বহিরাগত'দের মাঝে কোণঠাসা হয়ে পড়া জনজাতির ৩০ শতাংশ মানুষের জন্য পৃথক রাজ্য। কিন্তু, সেই দাবিতে কখনও কর্ণপাতই করল না IPFT-এর শরিক দল। যার ফল ভুগতে হল IPFT-কে। তাছাড়া, জনজাতিদের মধ্যে বিজেপি বিরোধিতার বীজ রোপনে CAA-র মতো ইস্যুও যথেষ্ট দায়ী ছিল। ঠিক এই সময়েই CAA বিরোধিতায় ত্রিপুরার অন্যতম মুখ হয়ে ওঠেন রাজা প্রদ্যোৎ কিশোর মাণিক্য। সুপ্রিম কোর্টে মামলাও করেন।
দীর্ঘদিন কংগ্রেসের সঙ্গে থাকার পরে ২০১৯ সালে হঠাৎই দল ছেড়ে দিয়েছিলেন। শুধুমাত্র, জনজাতির মানুষের সুবিধা-অসুবিধা দূর করতেই তৈরি করেছিলেন সাধারণ একটা সমিতি। একুশের Tribal Autonomous District Council (TTADC)-র নির্বাচনে আগে সেই সমিতিই রাজনৈতিক রূপ দেন ত্রিপুরারাজ প্রদ্যোৎ কিশোর। নাম দেওয়া হয়, Tipraha Indigenous Progressive Regional Alliance, অর্থাৎ, TIPRA। এই তিপ্রা মোথা ফের জাগিয়ে তোলে ত্রিপুরার জনজাতির পুরনো সেই দাবি। পৃথক রাজ্যের দাবি। গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ডের দাবি।
আরও পড়ুন: হাতের রং এবার লাল, গেরুয়া হঠাতে জোটের জোর কত? ক্ষোভ নিভিয়ে জয় খুঁজছে 'বামগ্রেস'
IPFT, INPT-র উপর থেকে ভরসা চলে যাওয়ার পরে অবশেষে আবারও নির্ভর করার মতো রাজনৈতিক দল খুঁজে পায় ত্রিপুরার জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ। ত্রিপুরা ট্রাইবাল অটোনোমাস ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল, TTADC-র নির্বাচনে ভোটের জোয়ার আসে। ৪৭ শতাংশ ভোট নিয়ে ১৬টি আসনে জয়লাভ করে তিপ্রা। শূন্য হয়ে যায় বিজেপির জোটসঙ্গী IPFT এবং বাম।
আগেই বলা হয়েছে, ত্রিপুরার দুই তৃতীয়াংশ ভৌগোলিক এলাকার জনজাতির মানুষের স্বার্থে তৈরি হয়েছিল এই TTADC কাউন্সিল। তাই এই নির্বাচনী ফলে ভৌগোলিক দিক থেকেও ত্রিপুরার ব্যাপক অংশে, তিপ্রা-র প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়। যা চিন্তায় ফেলে দেয় বিজেপি-কে। তেইশের বিধানসভা নির্বাচনের ভোটবাক্সে যে এর কিছুটা হলেও প্রভাব পড়বে, তা বুঝতে আর বাকি থাকে না পদ্মশিবিরের।
বিধানসভা নির্বাচনের আগে তাই তিপ্রামোথার সঙ্গে সমঝোতার পথে যেতে বিন্দুমাত্র লুকোছাপা করেনি বিজেপি। কিন্তু, দিল্লিতে অমিত শাহের সঙ্গে মাণিক্যের বৈঠক ব্যর্থ হয়। শাহের সামনেও সেই একই দাবি রাখেন তিপ্রামোথার মাথা। লিখিত রূপে পৃথক রাজ্যের দাবিতে সিলমোহর দিতে হবে বিজেপি-কে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রদ্যোৎ কিশোরের সেই দাবি মানতে পারেনি বিজেপি। তাই বিজেপি-র মাথাব্যথার কারণে হিসাবে সেই থেকেই .যায় তিপ্রামোথা। সেই কারণেই, ত্রিপুরায় নির্বাচনী প্রচারে এসে বারবার তিপ্রামোথার বিরুদ্ধে তোপ দাগতে দেখা যায় অমিত শাহ, রাজনাথ সিং-দের।
আরও পড়ুন: দুই মানিকের পর এবার মাণিক্যর পালা! ত্রিপুরা দখল করবেন তাঁরাই, দাবি মহারাজার
৬০ বিধানসভা আসনের ত্রিপুরা বিধানসভার ২০টিই জনজাতি অধ্যুষিত। আর এই ২০টিতেই ভাল প্রভাব রয়েছে প্রদ্যোৎ কিশোরের তিপ্রামোথা পার্টির। কিন্তু, বিষয়টা এই পর্যন্ত থেমে থাকলেও নয় কথা ছিল। সমস্যাটা হচ্ছে, এই কুড়ি আসনের বাইরেও আরও ২২টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে প্রদ্যোতের পার্টি। অর্থাৎ, এই এলাকায় বসবাসকারী জনজাতি ভোটারের ভোট অনায়াসেই চলে যেতে পারে তাঁদের রাজার দিকে।
ঠিক এই কারণেই, শুধু বিজেপি নয়, তিপ্রামোথা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বাম-কংগ্রেস জোটের কাছেও। জনজাতিদের মধ্যে বিজেপি বিরোধী ভোট জোটের দিকে যাওয়ার একটা বড় সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু, তিপ্রামোথা থাকায়, সেই আশা অনেকটাই ক্ষীণ হয়ে এসেছে। অন্যদিকে, যে সমস্ত এলাকা জনজাতি অধ্যুষিত নয়, সেখানকার জনজাতি ভোটারদের ভোট পাওয়ার আশাও এখন অস্তাচলে।
বিষয়টা এমন দাঁড়াচ্ছে, যদি বিজেপি বিরোধী ভোটারদের যাবতীয় ভোট বাম-কংগ্রেস জোট পায় এবং জনজাতির সমস্ত ভোট গিয়ে পড়ে তিপ্রামোথার বাক্সে, তাহলে ত্রিপুরায় বিজেপি-র ফিরে আসার সম্ভাবনা কিন্তু বড়ই ক্ষীণ। সেক্ষেত্রে, ত্রিশঙ্কু ফলাফল হওয়ার কথাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞেরা।
তাছাড়া, তিপ্রামোথার জন্য উত্তরপূর্বের এই রাজ্যে ক্ষমতা হারালে চব্বিশের নির্বাচনের আগে জাতীয় রাজনীতিতেও চূড়ান্ত অস্বস্তিতে পড়তে হবে বিজেপি-কে। উল্টে, বিজেপি বিরোধী সরকার গড়ার ক্ষেত্রে 'ত্রিপুরা মডেল' পেয়ে যেতে পারে কংগ্রেস'।
তাই, ত্রিশঙ্কু পরিস্থিতি তৈরি হলে বিজেপি না বাম-কংগ্রেস জোট, কোন দিকে ঝুঁকবে তিপ্রামোথার সমর্থন, সেটাই ত্রিপুরার ভাগ্য নির্ণায়ক হয়ে উঠবে। তখন ত্রিপুরার 'কিং'-ই হয়ে উঠবেন ত্রিপুরার 'কিংমেকার'।
সব সর্বশেষ পড়ুন ত্রিপুরা বিধানসভা নির্বাচন 2023 এখানে খবরনিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।
Tags: Tipra Motha, Tripura Assembly Election, Tripura Assembly Election 2023