আয় নেহাত মন্দ নয়, তবু কেন আজ অবলুপ্তির পথে বাংলার 'বাতাসা' শিল্প?
- Published by:Simli Raha
Last Updated:
নতুন প্রজন্ম আগ্রহ হারিয়েছে, ফলে অবলুপ্তির পথে বাংলার 'বাতাসা' শিল্প
রুদ্র নারায়ন রায়, দক্ষিণ ২৪ পরগনা: হিন্দু ধর্মে গ্রাম বাংলার নাম সংকীর্তন অনুষ্ঠানে হরিলুঠ দেওয়া হয় বাতাসা ছড়িয়ে। কিম্বা ধরা যাক, গরমের দিনে এক টুকরো বাতাসা আর এক গ্লাস ঠান্ডা জল পান করে ক্লান্তি, অবসাদ দূর করার কথা। কিন্তু 'বাতাসা' পাবেন কোথায় ? গ্রাম বাংলার এই কুটির শিল্প তো আজ প্রায় অবলুপ্তির পথে। তবুও বাতাসার কদর অপরিসীম। যে কোন শুভ কাজে, মন্দিরে- মসজিদ-গুরুদ্বার কিম্বা পূজো –অর্চনা, মাঙ্গলিক কাজে বাতাসার ব্যবহার হয়। ইদানিং রাজনৈতিক তরজাতেও বাতাসার নাম বার বার উঠে এসেছে। ভাঙড়ের কাশীপুর, মিনাখার মালঞ্চ, জীবনতলা, বারুইপুরে কিছু জায়গায় এখনো বাতাসা তৈরি হয়। ছোট ছোট হাঁড়ি, শীতল পাটির চাটাই আর কাঠ কয়লার উনুনে প্রান্তিক বাতাসা শিল্পীরা আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন গ্রামীণ বাতাসা শিল্পকে।
কাশীপুর থানার পাশ দিয়ে সরু ইটের রাস্তা দিয়ে আধ কিলোমিটার গেলে দাস পাড়া। সেখানেই ১৯ বছর ধরে নিজের বাড়িতে কারখানা তৈরি করে বাতাসা তৈরি করে আসছেন সুভাষ দাস ও তাঁর পরিবার। সুভাষ বাবুর কথায়, ‘কয়লার গন গনে আঁচের পাশে বসে গুড়, চিনি জ্বাল দিতে হয়। গরম কড়াই থেকে ফুটন্ত রস চাটাইতে ঢালতে হয়। ঘাড় মুখ গুঁজে আট দশ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। তাই এখনকার প্রজন্ম আর এ সব কাজ শিখতে আগ্রহী নয়। কিছুদিন পর বাতাসা লুপ্তপ্রায় শিল্পের পর্যায়ে চলে যাবে।
advertisement
জল, গুড় ও চিনির সঠিক সংমিশ্রনে বাতাসা তৈরি করা হয়। মূলত প্রমান সাইজের অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে দেড় কেজি চিনি, ২০০ গ্রাম ভেলিগুড় ও এক লিটার জলের সংমিশ্রণ গনগনে আঁচে ফোটাতে হয়। সেই জল উদ্বায়ী হয়ে গেলে গাড় রসে পূর্ণ হাঁড়িটি আঁচ থেকে নামিয়ে নেওয়া হয়। তারপর কাঠ বা বাঁশের তাড়ু (খুন্তি জাতীয়) দিয়ে হাঁড়িটিকে ভাল ভাবে নাড়া চাড়া করলে বীজ বা গেঁজালো রস তৈরি হয়। এরপর হাঁড়িটিকে সাঁড়াশি জাতীয় যন্ত্রের সাহায্যে ধরে শীতল পাটির চেটাই এর ওপর রসের ছোট ছোট ফোটা ফেলা হয়। রসালো ফোটা গুলিই হাওয়ার সংস্পর্শে ঠান্ডা হয়ে বাতাসার রুপ পায়। এতো গেল গুড় বাতসা তৈরির প্রক্রিয়া।
advertisement
advertisement
একই রকম ভাবে শুধু চিনি এবং তাঁর সঙ্গে পরিমাপ মতো রাসায়নিক দ্রব্য, রেডির তেল, রিঠে ফলের রস দিয়ে সাদা বাতাসা বা চিনির বতাসা তৈরি হয়। এছাড়া ইদানিং কালে বিভিন্ন রকম রাসায়নিক রঙ মিশিয়ে লাল, সবুজ, হলুদ বাতাসা তৈরি করা হচ্ছে। সুভাষ দাসের কথায়, ‘গুড়ের তৈরি বাতসা খেলে যে পরিমান উপকার পাওয়া যায় সেটা অন্য কোন বাতাসায় মেলে না। বাতাসার কারখানা তৈরি করবো বলে ১৯ বছর আগে রায়দীঘি থেকে দুজন কারিগর নিয়ে এসেছিলাম। বছর খানেক কাজ করার পর তাঁরা চলে যায়। তখন থেকেই নিজেই বাতাসা তৈরি করে আসছি। এই কারখানার আমিই মালিক, আমিই কর্মচারী।‘
advertisement
তবে বাতসা তৈরির সময় প্রয়োজনীয় জল, উনুন ধরিয়ে দেওয়া, সেগুলি প্যাকেটজাত করার কাজে সাহায্য করেন তাঁর স্ত্রী অনিতা ও বড় মেয়ে সুপর্ণা দাস। সুভাষ বাবু জানালেন, এই ব্যবসায় আয় নেহাত মন্দ নয়। এক কেজি বাতাসা ৫২ টাকা দরে পাইকারী হিসাবে বিক্রি করেন তিনি। মুদি দোকানে তা খুচরো বিক্রি হয় ৬০ টাকা কেজি দরে। প্রতিদিন সাত আট ঘণ্টা কাজ করলে একজন কর্মচারী কম বেশি ১০০ থেকে ১২০ কেজি বাতাসা তৈরি করতে পারে। যা করতে খরচ ৫০০০ টাকা। আর বিক্রি ? ছয় থেকে সাড়ে ছয় হাজার টাকা। অর্থ্যাৎ বাজারে চাহিদা থাকলে এক থেকে দেড় হাজার টাকা আয় করতে পারবেন একজন কর্মী।
advertisement
যদিও ভাঙড়ের সুভাষ দাস, বিজয় গঞ্জের প্রভাস নস্কর কিংবা জীবনতলার আলিম উদ্দিনের আক্ষেপ সরকার ক্ষুদ্র শিল্প বাঁচানোর কথা বললেও স্থানীয় নেতা বা ব্লক প্রশাসনের কোন হেলদোল নেই এই শিল্প বাঁচানোর ক্ষেত্রে। স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান তানিয়া বিবি বলেন, সুভাষ বাবু দীর্ঘদিন ধরে সফলতার সঙ্গে এই ব্যবসা করছেন জানি। ওঁর বাতাসা ভাঙড়ের বাইরে বাংলাদেশ, দুবাইতেও গিয়েছে বলে শুনেছি। ভাঙড় দু নম্বর ব্লকের বিডিও কার্তিক চন্দ্র রায় বলেন, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ট্রেনিং ও আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য সরকারের প্রচুর প্রকল্প আছে। সুভাষ দাসের জন্য কি করা যায় আমরা ভাবনা চিন্তা করে দেখছি।‘
advertisement
তাই বলা যায়, দক্ষ কর্মীর অপ্রতুলতা ও নতুন প্রজন্মর এই কাজের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার ফলে অবলুপ্তির পথে বাংলার বাতাসা শিল্প।
view commentsLocation :
First Published :
August 17, 2021 11:46 AM IST
