জানবাজারের রানি রাসমণীর বাড়ির ঠাকুরের আদলেই তৈরি হয়েছিল ‘দেবী’র পোস্টার
Last Updated:
রানির আমলে এই পুজোর ধূমধাম ছিল চোখে পড়ার মতো ৷ তবে সে সময়ের অন্যান্য বড় বাড়ির পুজোর মতো এখানে কোনওদিন বাঈ নাচের আসর বসেনি, হাওয়ায় টাকা ওড়েনি, মদ-মাংসের ফোয়ারা ছোটেনি ৷ বরাবরই এই পুজো ছিল জনসাধারণের মনের পুজো ৷ আজও রানির সেই ভাবধারাকে সঙ্গী করে, নিষ্ঠা ভরে পুজো হয় এখানে ৷
#কলকাতা: পুরুষ-শাসিত তখনকার কলকাতা ৷ ব্রিটিশরাজ সে সময় জাঁকিয়ে বসেছে এ শহরের অলিতেগলিতে ৷ সেটা ১৭৯০ সাল ৷ সমাজে মেয়েদের অবস্থান তখন অন্দর মহলের গভীরে আরও গভীরে যেতে যেতে মাঝপথে যেন হারিয়েই গিয়েছে ৷ সেই যুগে মধ্য কলকাতার সুবৃহৎ হলদে-রঙা জানবাজারের প্রাসাদপম বাড়িটায় শুরু হল একেবারে ছক ভাঙা এক পুজো ৷ এই পুজো যেমন মায়ের আরাধনা, তেমনই মহিলাদের সম্মান প্রদর্শনও ৷ ১৮৩৬-এ স্বামী রাজচন্দ্র দাসের মৃত্যুর পর নিজের কাঁধে পুজোর সমস্ত দায়িত্ব তুলে নিলেন তিনি ৷ লোকমাতা রানি রাসমণি শুরু করলেন দেবী দুর্গার আরাধনা ৷ রানির দাপটের কথা সে সময় লোকমুখে ফিরত ৷ তাঁর কাছে জব্দ ছিল খোদ ইংরেজরাও ৷ নারী স্বাধীনতায় তলানিতে পৌঁছে যাওয়া মধ্যযুগীয় কলকাতা দেখেছিল বিধবা জমিদার গিন্নির তেজ কাকে বলে ৷
সুন্দরী হওয়ায় মাত্র ১১ বছর বয়সে জানবাজারের জমিদার প্রীতরাম দাস মাড়ের ছেলে রাজচন্দ্রের সঙ্গে বিয়ে হয় রাসমণি দেবীর ৷ সুখে-সমৃদ্ধিতে ভরা সংসার ৷ কিন্তু দুঃখ একটাই ৷ একটাও ছেলে হল না তাঁদের ৷ চার মেয়ে এল রাজচন্দ্র আর রাসমণির পরিবারে ৷ এত বড় জমিদারি দেখবে কে ? শেষ পর্যন্ত অবশ্য মেয়ে-জামাতার মধ্যেই ভাগ হয়েছিল রাজচন্দ্রের জমিদারি ৷ আর সেই কারণেই আজও তিনটি ভাগে চলছে এই পুজো ৷
advertisement
আজও এই বাড়িটার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে পুরাতনী সুবাস ৷ পলেস্তরা-খসা হলদেটে থাম, চিলেকোঠায় গজিয়ে ওঠা অশ্বত্থ চারা, কাঠামো বের করা টানা বারান্দার মধ্যে আজও সেই তেজ, সেই দৃঢ়তা, সেই প্রতিপত্তির গন্ধ পাওয়া যায় ৷ রাসমণির চার মেয়ে ৷ পদ্মমণি, কুমারী, করুণাময়ী আর জগদম্বা ৷ এই করুণার সঙ্গেই বিয়ে হয়েছিল মথুর মোহন বিশ্বাসের ৷ মথুরবাবুকে নিজের ছেলের মতোই ভালবাসতেন রানিমা ৷ ভরসাও করতেন ৷ বিয়ের বছর দু’য়েকের মধ্যেই মারা যান করুণা ৷ তারপর করুণার বোন জগদম্বার সঙ্গে বিয়ে হয় মথুরমোহনের ৷ জগদম্বা আর মথুরের এক ছেলে ৷ ত্রৈলোক্যনাথ বিশ্বাস ৷ তাঁর আবার চার ছেলে ব্রজগোপাল, নিত্যগোপাল, শ্রীগোপাল আর মোহনগোপাল ৷ ব্রজগোপালের দুই মেয়ে ৷ বিদ্যুৎলতা ও লাবণ্যলতা ৷ লাবণ্যলতার বিয়ে হয়েছিল বিজয়কৃষ্ণ হাজরার সঙ্গে ৷ সেই থেকে আজও জানবাজারের মূল বাড়িতে এই পুজোর দায়িত্ব সামলাচ্ছেন হাজরা পরিবারের সদস্যরাই ৷
advertisement
advertisement
জোরকদমে চলছে মায়ের মূর্তি গড়ার কাজ ৷ নিজস্ব চিত্র ৷
অন্যদিকে, ত্রৈলোক্যনাথের আর এক পুত্র নিত্যগোপালের দুই সন্তান, সুশীল কুমার বিশ্বাস আর সুনীল কুমার বিশ্বাস। সুনীল কুমার বিশ্বাসের ছেলেরাই বর্তমানে ১৮ রানি রাসমণি রোডে, রানি রাসমণি ভবনের দুর্গাপূজা পরিচালনা করেন যা বিশ্বাস বাড়ির পুজো নামেই পরিচিত। পদ্মামণির স্বামীর নাম রামচন্দ্র দাস ৷ পদ্মমণির বংশধরেরা বাড়ির যে অংশে থাকেন, সেই অংশেও একটা ঠাকুরদালান আছে ৷ সেখানেও আরেকটা দুর্গাপুজো হত ৷ কুমারীর স্বামী প্যারীমোহন চৌধুরীর বংশধরেরা বাড়ির যে অংশে থাকেন, সেই অংশেও একটা ঠাকুরদালান আছে এবং সেখানেও আরেকটা দুর্গাপুজো হয় যা চৌধুরী বাড়ির পুজো নামে খ্যাত ৷
advertisement
মুছে গিয়েছে সেই জৌলুস ৷ তবু ঐতিহ্যের সাক্ষী এই বাড়ি ৷ নিজস্ব চিত্র ৷
advertisement
বরাবরই এই পুজোয় মহিলাদের প্রাধান্য ৷ এই বাড়ির পুজোয় মহিলাদের অমানুষিক খাটুনি, সবার শেষে খাওয়া, সাধ্যাতীত পরিশ্রম করার রেওয়াজ এখানে নেই ৷ এখনও পুজোর কোনও জোগাড়ে হাত লাগান না বাড়ির মহিলা সদস্যরা ৷ সমস্ত কিছুর ভার দাস-দাসীদের ৷ তাঁরা পুজোর সময় ঠাকুর দালানে আসেন, বসে পুজো দেখেন, আমোদ-ফূর্তি করেন ৷ এ বাড়িতে মেয়েদের খাওয়া শেষ হলে তবে খেতে বসেন পুরুষরা ৷ আজও এই ধারাই বজায় আছে ৷ প্রতিপদ থেকে শুরু হয় পুজো ৷ প্রথমে বোধন ঘরে হয় বোধন ৷ বোধন ঘরেই রয়েছে হোমকুণ্ড ৷ ঠাকুর দালানের থেকে তিন সিঁড়ি নীচে এই বোধন ঘর ৷ রানিমার পুজোর অন্যতম বিশেষত্ব হল, এই পুজোয় রোজই হয় কুমারী পুজো ৷ আরও একটা বিষয় হল, কুমোররা নয় পুজোয় ঠাকুর গড়েন চিত্রকররা ৷ তবে মায়ের মুখের কোনও নির্দিষ্ট ছাঁচ নেই ৷ বংশপরম্পরায় চিত্রকররাই হাতের আদলে জীবন্ত করে তোলেন মায়ের মুখ ৷ দেবীর গাত্র বর্ণ হয় শিউলি ফুলের বোঁটার মতো ৷ আটচালায় আঁকা থাকে নানা পৌরাণিক কাহিনীর ছবি ৷
advertisement
মায়ের মুখ, রং, চালচিত্রের অলঙ্করণ...সবেতেই রয়েছে বিশেষত্ব ৷
রানির আমলে এই পুজোর ধূমধাম ছিল চোখে পড়ার মতো ৷ তবে সে সময়ের অন্যান্য বড় বাড়ির পুজোর মতো এখানে কোনওদিন বাঈ নাচের আসর বসেনি, হাওয়ায় টাকা ওড়েনি, মদ-মাংসের ফোয়ারা ছোটেনি ৷ বরাবরই এই পুজো ছিল জনসাধারণের মনের পুজো ৷ আজও রানির সেই ভাবধারাকে সঙ্গী করে, নিষ্ঠা ভরে পুজো হয় এখানে ৷
advertisement
এই পুজোতেই শাড়ি পরে, সখী বেশে মায়ের পুজো করতে এসেছিলেন রামকৃষ্ণদেব ৷ পাছে লোকের তাঁকে চিনে ফেলে হৈ-চৈ বাঁধিয়ে দেয়, সে কারণেই ছদ্মবেশ ধরতে হয়েছিল পরমহংসদেবকে ৷ যখন গাড়ি থেকে নেমে মথুরবাবুর স্ত্রী-র পাশে দাঁড়িয়ে মা’কে চামর দুলিয়ে তিনি হাওয়া করছেন, তখনও তাঁকে দেখে কেউ চিনতেই পারেননি ৷ এমনকী মথুরবাবুও নাকি পরে স্ত্রী জগদম্বাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘উনি কে গো ? ঠিক চিনতে পারলুম না ৷’ জগদম্বা তখন তাঁকে বলেছিন, ‘ও যে আমাদের ছোট ঠাকুর ৷’
মুছে গিয়েছে পুরনো সেই জৌলুস... দিন যাপনের ক্ষণের মধ্যে ফিকে হয়েছে গরিমা ৷ রয়ে গিয়েছে পুরনো যুগের আস্তরণ আর সেকালের গল্পগুলো ৷ এই ঠাকুরের মুখের আদলেই ‘দেবী’র পোস্টার এঁকেছিলেন সত্যজিৎ রায় ৷ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিধন্য এই পুজো ৷ এখনও ৫২ জনের যৌথ পরিবার কোমর বেঁধে নামে সেই পুজোর প্রস্তুতিতে ৷
ছবি: রানি রাসমণিবাড়ির সৌজন্যে ৷
Location :
First Published :
October 05, 2019 10:20 AM IST