সন্ধি পুজোর ধোঁয়ায় ঢেকে যায় দেবীর মুখ, মা আসেন কৃষ্ণনগরের রাজবাড়িতে

Last Updated:
#কৃষ্ণনগর: বাগান, দীঘি আর বিশাল মাঠের মাঝখানে সুবৃহৎ রাজবাড়িটা কয়েক শতকের ইতিহাসকে পরম যত্নে জড়িয়ে রেখেছে অলিন্দের গোপন কুঠুরিতে । সে ছিল এক যুগ । যশোররাজ প্রতাপাদিত্যকে পরাস্ত করতে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরকে সাহায্য করেছিলেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র। আর তাতেই খুশি হয়ে কৃষ্ণচন্দ্রকে রাজা করেছিলেন জাহাঙ্গির । আজ সেই রাজাও নেই, নেই তাঁর রাজত্বও । শুধু কালের স্মৃতিকে আজও ধরে রেখেছে কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ি।
শোনা যায়, এই পরিবারে নাকি আগে দেবী অন্নপূর্ণা পুজোর চল ছিল । পরে কৃষ্ণচন্দ্রই সর্বসাধারণের জন্য দুর্গোৎসবের প্রচলন করেন । আজও পুজোর এক মাস আগে থেকে সেজে উঠতে থাকে সুবিশাল এই রাজবাড়ির আনাচ-কানাচ । ঘর রং থেকে শুরু করে পাহাড় প্রমাণ হোমের কাঠ জোগাড়, ঝাড়ামোছা, রাস্তায় মাটি ফেলা, টুকিটাকি কাজ সেরে প্রস্তুত হতে থাকে রাজবাড়ি ।
advertisement
উল্টোরথের দিন কাঠামো পুজো । তারপর ষষ্ঠীর দিন হয় বোধন । নাটমন্দিরের পিছনেই রয়েছে মায়ের বোধন ঘর । মনে করা হয়, ওই বোধন ঘরেই রয়েছে মায়ের প্রাণ । তাই সেই ঘরের সামনেটা কখনও আটকানো যায় না । ওই দিনই পাটে তোলা হয় দেবীকে ৷ পাটে তোলা অর্থাৎ বেদীতে তোলা ৷ বেয়ারাদের কাঁধে চড়ে পাটে ওঠেন মা রাজরাজেশ্বরী ৷ সেই সময় সাঁই বাঁশ আর কাছি দড়ি দিয়ে তোলা হয় মা’কে ৷
advertisement
advertisement
 এই দরবার হল থেকেই রাজ্যপাট চালাতেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় ৷ নিজস্ব চিত্র ৷
এই দরবার হল থেকেই রাজ্যপাট চালাতেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় ৷ নিজস্ব চিত্র ৷
তবে এই পরিবারের রীতি অনুযায়ী আজও মহালয়ার পরের দিন থেকে শুরু হয় হোম । সমস্ত নদিয়াবাসীর মঙ্গলের জন্য নিবেদন করা হয় এই হোমের আগুন । মহালয়া থেকে নবমী পর্যন্ত সারা দিন-রাত জ্বলতে থাকে হোমের আগুন । রাজবাড়ির বর্তমান রানি শ্রীমতি অমৃতা রায় শোনালেন সেই হোমের গল্প । নবমীর নিশিতে যখন গঙ্গাজল, মধু, ঘি, কলা, পানের আহুতি দিয়ে হোম নেভানো হয়, তখনও বারবার প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে সেই শিখা । পবিত্র অগ্নির মধ্যে দিয়ে যে তিনি এসেছিলেন, তা যেন স্পষ্ট বোঝা যায় ।
advertisement
রাজবাড়ির দুর্গা প্রতিমা, রাজরাজেশ্বরী মা এখানে যুদ্ধবেশে আবির্ভূতা । দেবীর গায়ে বর্ম । হাতে অস্ত্র । ঘোটকাকৃতি সিংহের উপর উপবিষ্টা তিনি । মা রাজরাজেশ্বরীর সামনের দু’টো হাত বড় । পিছনের ৮টি হাত ছোট । প্রতিমার পিছনে রয়েছে অর্ধ চন্দ্রাকৃতি ছটা । তাতে আঁকা রয়েছে দশমহাবিদ্যা । সাবেকী প্রতিমার মতো এখানে কিন্তু ডাকের সাজ নেই । দেবী এখানে ‘বেদেনি ডাক’-এর সাজে সজ্জিতা । আগে নাটমন্দিরেই ছিল চিকের আড়াল । বাড়ির মেয়েরা সেখান থেকে বসেই পুজো দেখত । আজ যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উঠে গিয়েছে সেই প্রথা । তেমনই উঠে গিয়েছে বলি প্রথাও । আগে ১০৮টা ছাগ বলি হতো এখানে । পরে তা বন্ধ হয়ে প্রতীকী হিসাবে ১টি ছাগ বলি হত । শেষ পর্যন্ত অবশ্য তাও বন্ধ হয়ে যায় । এখন চালকুমড়ো আর আখ বলি হয় ।
advertisement
কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির পুজোর প্রধান আকর্ষণ অষ্টমীর সন্ধিপুজো আর দশমীর সিঁদুর খেলা । আজও ১০৮ ঘিয়ের প্রদীপ আর ১০৮টি প্রস্ফ‌ুটিত পদ্মে সন্ধি পুজো হয় দেবীর । প্রতি বছর, এক মুহূর্তের জন্য হলেও সুগন্ধি ধুনোর ধোঁয়ায় সম্পূর্ণ ঢেকে যায় মায়ের মুখ । প্রচলিত বিশ্বাস, ওই সময়ই মা আসেন । আগে ১০৮টা নীল পদ্মে সাজানো হত পুষ্পপত্র । আজ সেই নীল পদ্ম অতীত ।
advertisement
কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির বর্তমান রানিমা শ্রীমতি অমৃতা রায় ৷ নিজস্ব চিত্র ৷
কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির বর্তমান রানিমা শ্রীমতি অমৃতা রায় ৷ নিজস্ব চিত্র ৷
এই পরিবারে আগে সিঁদুর খেলার রেওয়াজ ছিল না । বর্তমান রানিমার হাত ধরেই বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে রাজবাড়ির সিঁদুর খেলার অনুষ্ঠান । লোকমুখে প্রচলিত আছে, রাজবাড়ির নাটমন্দিরে সিঁদুর খেললে সিঁথির সিঁদুর অক্ষয় হয় । দূর দূরান্ত থেকে তাই ১০-১৫ হাজার মানুষ দশমীর দিন ভিড় জমান রাজবাড়ির সামনে । সিঁদুর খেলার শেষে ঘরে যাওয়ার পথে পরিবারের সদস্যদের বিশেষ কয়েকটা জিনিস দর্শন করতে হয় ৷ যেমন- সবৎস্য ধেনু, বৃষ, গজ, গণিকা, ঘোড়া, নৃপ ইত্যাজি ৷ দশমীর দিন প্রতিমা নিরঞ্জনের পর হয় যাত্রামঙ্গল অনুষ্ঠান ৷
advertisement
তবে আজও বাড়ির মেয়েদের অনুমতি নেই বিসর্জনে যাওয়ার । নাটমন্দির থেকে বেরিয়ে যখন মা রাজবাড়ির দীঘির উদ্দেশ্যে রওনা দেন, তখন দূরে মূল বসতবাড়ির ফ্রেঞ্চ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকেন রানিমা । বারান্দার সামনে এসে ক্ষণিকের জন্য দাঁড়ান রাজরাজেশ্বরী । দূর থেকে তাঁকে প্রণাম করে রানি বলেন, ‘‘আবার এসো মা । সাবধানে যেও ।’’ তখন আবার বেয়ারাদের কাঁধে চেপে শ্বশুরঘরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন দেবী ।
কৃষ্ণনগরের মা রাজরাজেশ্বরী ৷ ছবি: সৌমাভ ভট্টের ফেসবুক পেজের সৌজন্যে ৷
কৃষ্ণনগরের মা রাজরাজেশ্বরী ৷ ছবি: সৌমাভ ভট্টের ফেসবুক পেজের সৌজন্যে ৷
অতীতে বিসর্জনের পর ঘাট থেকে উড়িয়ে দেওয়া হত নীলকণ্ঠ পাখি । বিশ্বাস, এই পাখিই কৈলাসে গিয়ে শিবকে খবর দেয় মর্ত্যলোক থেকে যাত্রা শুরু করেছেন মা । কিন্ত নীলকণ্ঠ পাখির সেই রেওয়াজ আজ আইনের গেড়োয় আটকে । তাই এই রীতিও আজ আর নেই । তবে এখনও বিসর্জনের পর মায়ের বিড়ে তুলে দেওয়া হয় অমৃতাদেবীর হাতে । সেই বিড়ে রেখে দিতে হয় এক বছর । পরের বছর এক বিড়ে বিসর্জন দিয়ে অন্য বিড়ে ধারণ করার নিয়ম ।
বিসর্জনের পর রয়েছে আরও একটি রীতি । রাজ্যে আমোদ-উৎসবের পর রাজাকে তাঁর কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন করে দিতে নকল শত্র‌ু বানাতেন প্রজারা । প্রতিমা নিরঞ্জনের পর রাজাবাবু তীর-ধনুক দিয়ে সেই শত্র‌ু বধ করে প্রজাদের আশ্বাস দিতেন । সেই রেওয়াজ আজও মেনে চলেন বর্তমান রাজা সৌমিশচন্দ্র রায় ।
বাংলা খবর/ খবর/ফিচার/
সন্ধি পুজোর ধোঁয়ায় ঢেকে যায় দেবীর মুখ, মা আসেন কৃষ্ণনগরের রাজবাড়িতে
Next Article
advertisement
পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ক্লাব এর সদস্যর এক আত্মীয়র! তারপরেই, এই এলাকার পুজোর থিম দেখলে অবাক হবেন!
পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ক্লাব এর সদস্যর এক আত্মীয়র! অন্যরকম থিম এই এলাকায়
VIEW MORE
advertisement
advertisement