স্মরণে সত্যজিৎ: মহারাজা তোমারে সেলাম

Last Updated:

শতবর্ষে পা

#কলকাতা: উপেন্দ্রকিশোর রায়ের নাতি। সুকুমার রায়ের রায়ের একমাত্র সন্তান। যদি শুধু লেখকই হতেন, তাহলেও হয়তো বেশ মানাত। কিন্তু ঈশ্বর তাঁর অজান্তেই তাঁকে দিয়ে রেখেছিলেন গুরুদায়িত্ব। বাংলা ছবির ব্যাকরণ তৈরি করার ভার।  ঈশ্বর প্রদত্ত দায়িত্বই বটে। সত্যজিৎ রায়। তিনি ছবি বানানোর আগে, বাংলায় ভাল ছবি যে হত না, এমনটা নয়। তবে সত্যজিৎ রায় আনলেন এক অন্য মাত্রা। যে ডায়মেনশনে সিনেমা হয়ে উঠল একটা জার্নি। একটা দর্শন। এই লকডাউনের সময় তিনি থাকলে, নিশ্চয়ই তাঁকে ভাবাতো আশপাশ। তিনি থাকলে, বর্তমান পরিস্থিতি প্রভাব ফেলত তাঁর সৃষ্টিতে। ১০০ বছরে পা দিলেন সত্যজিৎ।গ্র্যান্ড সেলিব্রেশন হচ্ছে না ঠিকই। তবে সিনে প্রেমীদের মনে তিনি চিরকালই গ্র্যান্ড।
বিজ্ঞাপন সংস্থায় ৮০ টাকা বেতনের চাকরি দিয়ে কর্মজীবন শুরু। ভিজ্যুয়াল ডিজাইনার ছিলেন, যাকে এখন আমরা গ্রাফিক ডিজাইনার বলে থাকি। তারপর একটি প্রকাশনা সংস্থার জন্য বইয়ের প্রচ্ছদ ডিজাইন করা শুরু করেন। তাঁর হাত থেকেই বেরোয় অনবদ্য কিছু প্রচ্ছদ। ইলাস্ট্রেশন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পথের পাঁচালী'-র ছোটদের জন্য সংস্করণ 'আম আঁটির ভেঁপু' র প্রচ্ছদের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। তখনই মনে মনে ঠিক করে ফেলেছিলেন, সুযোগ পেলে এই গল্প নিয়ে ছবি বানাবেন। কারণ ততদিনে ওয়ার্ল্ড সিনেমার চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছে। ভিন্ন ধারায় ছবি বানানোর স্বপ্ন দেখছেন সত্যজিৎ। সেই স্বপ্ন থেকেই চিদানন্দ দাশগুপ্ত ও আরও কয়েকজনের সঙ্গে মিলে সত্যজিৎ খুলে ফেলেন 'ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি'। বহু বিদেশি ছবির স্ক্রিনিং করালেন।  সেই সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। চারিদিকে উত্তাল পরিস্থিতি। সত্যজিৎ ঠিক করলেন তাঁকে গল্প বলতে হবে। নিজের মতো করে বলতে হবে। নিজের জন্য বলতে হবে।
advertisement
সুযোগ আসে বিদেশ যাওয়ার। কোম্পানি সত্যজিৎকে লন্ডনে পাঠায়। স্বপ্ন পূরণের রাস্তা যেন পরিষ্কার দেখতে পান সত্যজিৎ। ছবি বানানোর মুন্সিয়ানা শেখার জন্য পাগলের মত ছবি দেখতে থাকেন । ৬ মাসে ১১ টি ছবি দেখে ফেললেন সত্যজিৎ।  ফিরে এসেই শুরু করলেন 'পথের পাঁচালী' বানানোর কাজ। কিন্তু অর্থের অভাবে বহু বছর ধরে চলে পথের পাঁচালি বানানো। তখন কেউ কি বুঝেছিলেন, ছবি নয় ইতিহাস বানাচ্ছেন সত্যজিৎ!  এই ছবি-ই হবে কালজয়ী।
advertisement
advertisement
সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে কোনও নির্দিষ্ট প্যাটার্ন আছে কি? তর্কের বিষয়। তবে বৈচিত্র্য নিয়ে সন্দেহ থাকতে পারে না। অপু ট্রিলজি, প্রতিদ্বন্দ্বী, অশনি সংকেত, গুপী গাইন বাঘা বাইন, ফেলুদা, নায়ক--সবকটা ছবি-ই একে অপরের থেকে ভিন্ন। তবে সব ছবিগুলো গাঁথা হয়েছে একটি এমন সুতো দিয়ে, যার নাম বিষয়। সত্যজিৎ মনে করতেন, জীবনে অনেক অবাক হওয়া রয়েছে।  যেমন 'পথের পাঁচালী'- তে আমরা গল্পটা সর্বজয়ার চোখ দিয়ে দেখছি না। দুর্গার চোখ দিয়েও দেখছি না। সবচেয়ে প্রবীণ মানুষ ইন্দির ঠাকুরুনের চোখ দিয়েও নয়। আমরা দেখছি অপুর নিষ্পাপ চোখ দিয়ে। আমরা বিস্মিত হচ্ছি, অবাক হচ্ছি। একইভাবে সত্যজিতের শেষ ছবিতে যখন বাচ্চাটি বলছে,  'এক নম্বরি, দুই নম্বরি, তিন নম্বরি' তখন তাঁর দাদু দুঃখ পাচ্ছেন। তবে বিস্মিত তার চেয়ে অনেক বেশি হচ্ছেন।
advertisement
সত্যজিৎ রায়ের কথা বলতে গেলেই উঠে আসে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গ। আমজনতা থেকে সিনে প্রেমী অনেকেই মনে করেন সৌমিত্রর প্রতি সত্যজিৎ রায়ের একটি বিশেষ ভাললাগা ছিল। সেটা যে খুব ভুল, তা হয়তো নয়। সত্যজিৎ রায়ের চিন্তাভাবনা, রুচিবোধ, অনেক কিছুর সঙ্গেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মিল ছিল। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে ভালোবাসতেন ঠিকই। তবে সে ভালোবাসা একেবারেই নিঃস্বার্থ ছিল, এমনটা নয়। সত্যজিৎ রায় যে বাজেটে ছবি বানাতেন তাতে কাউকেই তেমন একটা পারিশ্রমিক দেওয়া সম্ভব নয়। প্রথম সারির কোনও নায়ককে নিয়ে ছবি করা তাঁর পক্ষে মুশকিল ছিল। অন্য দিক থেকে ভাবলে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যে মানের ছবি করেছেন সত্যজিতের সঙ্গে, তা তিনি অন্য কারও সঙ্গে করতে পারতেন না। সত্যজিৎ রায় ছবির গল্পের সঙ্গে কখনও আপোষ করেননি। 'গুপি গাইন বাঘা বাইন' বানানোর সময় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এই ছবিতে কাজ করার জন্য বহু চেষ্টা করেছিলেন। সত্যজিৎ রাজি হননি। পরিচালক মনে করেছেন, সৌমিত্রর চেহারার মধ্যে যে শহুরে ভাব রয়েছে তা এই ছবির জন্য একেবারেই বেমানান। তিনি নিয়েছিলেন তপেন চট্টোপাধ্যায়কে। আবার 'মহানগর' বা 'পোস্টমাস্টার' করার সময় তিনি নিলেন অনিল চট্টোপাধ্যায়কে।
advertisement
আর এক সুপারস্টারের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক নিয়ে  কথা শোনা যায়। উত্তম কুমার, দ্য আল্টিমেট সুপারস্টার। 'জতুগৃহ' বা 'যদুবংশ' -র মতো অনেক ছবি আছে যেখানে ছবিটিকে একা টেনে নিয়ে গিয়েছেন উত্তম কুমার। নিজের অভিনয় ক্ষমতা দিয়ে, নিজের স্টারডম দিয়ে। এসব ছবিগুলোতে চিত্রনাট্যকার কিংবা পরিচালকের চেয়েও অনেক বেশি কৃতিত্ব উত্তম কুমারের। সত্যজিৎ রায়ের ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য। তিনি অধিকাংশ সময় নতুনদের নিয়ে কাজ করেছেন। তাঁর ছবিতে চিত্রনাট্যই নায়ক। ছবি সফল হয়েছে সত্যজিতের জন্য। উত্তম কুমারের মতো স্টারের পারিশ্রমিক দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না তাঁর,  সেটা সত্যি কথা। অন্যদিকে উত্তম কুমারের স্টারডমকে সঙ্গে নিয়ে ছবি বানানো কঠিন ছিল সত্যজিৎ রায়ের পক্ষে। তবে 'নায়ক' বানানোর সময় তিনি ছুটে গিয়েছিলেন উত্তমকুমারের কাছে। কারণ এই ছবির জন্য তাঁর একজন স্টার-এর প্রয়োজন। উত্তম কুমার ছাড়া সেই ছবি সম্ভব ছিল না। 'নায়ক' যে কাল্ট হওয়ার ক্ষমতা রাখে সেটা বুঝতে পেরেছিলেন উত্তম কুমারও। তাই তো বিনা মেকআপে ক্যামেরার সামনে নিজেকে উজাড় করে দিতে পিছপা হননি তিনি। 'চিড়িয়াখানা'র বাণিজ্যিক সাফল্যের অনেকটা কৃতিত্বই স্টার উত্তম কুমারের, তা কখনো অস্বীকার করেননি সত্যজিৎ রায়ও।
advertisement
সত্যজিৎ রায়ের ছবি সফল হওয়ার চাবিকাঠি তাঁর অনবদ্য কাস্টিং। 'পথের পাঁচালী' র অপু, 'ফেলুদা'র লালমোহন বাবু,  চিত্রনাট্য লেখার সময় তিনি যেন তাঁর চরিত্র গুলোকে দেখতে পেতেন। তিনি ভাল অভিনেতা খুঁজেতেন না। তাঁর শব্দ দিয়ে আঁকা স্কেচ-এর সঙ্গে, কার শরীরী ভাষা, মুখের মিল সবচেয়ে বেশি, সেটাই দেখতেন। কারণ  অভিনয় করিয়ে নেওয়ার মুন্সিয়ানা তাঁর জানা ছিল। অপর্ণা সেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষ বারবার বলেছেন, ' মানিকদা যেটা করে দেখাতেন তাঁর ৫০ শতাংশ যদি পর্দায় করা যায়, তবে সেটাকে নিখুঁত সিন বলা যেতে পারে।' অসামান্য কাস্টিং-এর ফল মিলেছে বারবার। 'প্রতিদ্বন্দ্বী'- তে তিনি নিলেন ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়কে। সেই সময় ধৃতিমানের মতো ইংরেজি খুব কম অভিনেতা বলতে পারতেন। একজন অবশ্যই ছিলেন, উৎপল দত্ত। কিন্তু সত্যজিতের প্রয়োজন কম বয়সি কাউকে। কর্পোরেট, শহুরে বিষয়বস্তুর সঙ্গে ধৃতিমান-এর অসম্ভব মিল। চরিত্রটা যেন তাঁকে মাথায় রেখে লেখা। আবার 'জন অরণ্য'-তে তিনি নিলেন প্রদীপ মুখোপাধ্যায়কে। একজন মানুষ যিনি পেট চালানোর জন্য মহিলা পাচার করেন। ২০২০ তে দাঁড়িয়ে এমন ব্যক্তির হাবেভাবে কোনও জটিলতা থাকবে না। কিন্তু তখনকার দিনে এ কাজ যেন পাপ। আত্মদহন, মনের মধ্যে সংশয়, নিজের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন, নানা রকম অনুভূতি। তিনি একজন কনফিডেন্ট মানুষ হতে পারেন না। প্রদীপ মুখোপাধ্যায়ের চেহারার মধ্যেও তেমন আত্মবিশ্বাসের ছাপ নেই। চরিত্রের ছাঁচে নিজেকে ঢেলে ফেললেন প্রদীপ।
advertisement
সব বাচ্চাকে এক ব্র্যাকেটে ফেলা উচিত নয়। সেটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে আমাদের শিখিয়েছে রায় পরিবার। উপেন্দ্রকিশোর রায় ছিলেন শিশুসাহিত্যিক। সুকুমার রায় লিখতেন ১০-১২ বছর বয়সের বাচ্চাদের জন্য। তবে সত্যজিৎ রায় লিখতেন কিশোরদের জন্য। সত্যজিৎ রায়ের কথা বললে তাঁর ফ্যান্টাসির দিকটা তুলে ধরতেই হয়। 'গুপী গাইন বাঘা বাইন'  ছবিটি তাঁর দাদু উপেন্দ্রকিশোর রায়ের প্রতি তাঁর ট্রিবিউট ছিল। 'গুপী গাইন বাঘা বাইন'-এর মতো সহজ ছবি হয় না। ছোটদের জন্য ছবি হলেও এর মধ্যে ছিল ইউনিভার্সাল অ্যাপ্রোচ। এর মত পলিটিক্যাল ছবিও আর হয় না। আমরা টুডি, থ্রিডির কথা বলি। সত্যজিৎ রায় কতগুলো লোহার পাত দিয়ে যা অ্যানিমেশন করেছেন, তার কাছে এখনও হার মানবে প্রযুক্তি।
রজনী সেন রোড, মৌলালি এলাকার একটি রাস্তা যেটা বর্তমানে করোনা রেড zone। ফেলুদা সত্যিই এখনও থাকলে গৃহবন্দি হয়ে এতদিন কাটাতেন কী ভাবে ? হয়তো তাঁর মগজাস্ত্রে আরও শান দিতেন। ফেলুদা মানে ফ্যান্টাসি। কৈশোরের নস্টালজিয়া। ছবি বানানোর আগে সত্যজিৎ রায় যখন লিখতেন, তখন বোধহয় চরিত্রগুলো তাঁর সামনে ভেসে উঠতো, কথা বলতো। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কে কি তিনি প্রথম থেকেই ফেলুদা হিসেবে ভিসুয়ালাইজ করেছিলেন?  সেই লম্বা সুঠাম চেহারা। বুদ্ধিদীপ্ত চাহনি। শার্প চিবুক। চারমিনার ধরানোর স্টাইল। এই সমস্ত কিছুর মালিক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। অ্যাডভেঞ্চারের পাশাপাশি ফেলুদার গল্পগুলো ট্র্যাভেল অ্যানালগ বললেও ভুল বলা হয় কি? গ্যাংটকে গন্ডগোল, দার্জিলিং জমজমাট-এ  যত নিখুঁতভাবে গ্যাংটক কিংবা দার্জিলিংয়ের বর্ণনা দেওয়া আছে, তা বোধহয় সিকিম ট্যুরিজমের কিংবা এই রাজ্যের ওয়েবসাইটেও মেলা দুষ্কর।
সত্যজিতের শর্ট টেকিং-এর মধ্যে ছিল একটা স্বাতন্ত্রতা। এক্সপেরিমেন্ট করতেন তিনি। বিষয়ের সৌন্দর্য বৃদ্ধি নয়, টাইট ফ্রেম পছন্দ করতেন তিনি। তাই তো হীরক রাজার দেশে হোক বা শাখা প্রশাখা, কাপুরুষ মহাপুরুষ বা জয় বাবা ফেলুনাথ, পথের পাঁচালি বা আগন্তুক। সব ছবিই যেন টাইট ফ্রেম করে বাঙালির মননে ধরে রেখেছে কেউ। যার ফোকাস কখনও সফট হয় না। গল্প বলার এমন জাদু, ফ্রেমে ধুলো জমতে দেয় না কিছুতেই।
ARUNIMA DEY
বাংলা খবর/ খবর/ফিচার/
স্মরণে সত্যজিৎ: মহারাজা তোমারে সেলাম
Next Article
advertisement
'আমি শিবভক্ত, সব বিষ গিলে নিই...', অসমের জনসভায় বললেন মোদি, তাঁর 'রিমোট কন্ট্রোল' কে? চিনিয়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রী!
'আমি শিবভক্ত, সব বিষ গিলে নিই...', 'রিমোট কন্ট্রোল' কে? অসমের জনসভায় চিনিয়ে দিলেন মোদি
  • অসমের জনসভায় কংগ্রেসকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করলেন প্রধানমন্ত্রী

  • মোদি বলেন, জনগণই তাঁর আসল প্রভু এবং তাঁর ও ‘রিমোট কন্ট্রোল বা নিয়ন্ত্রক’

  • অসমের দরং ও গোলাঘাটে ১৮,৫৩০ কোটি টাকার প্রকল্পের উদ্বোধন

VIEW MORE
advertisement
advertisement