বাঙালির কান ঘেঁষে শহরে মারওয়াড়ির দাপট ! কীভাবে কলকাতায় বাড়ল এদের রাজ্যপাট
Last Updated:
কলকাতা বাঙালিদের শহর ৷ এবিষয় কোনও সন্দেহ না থাকলেও অনেকেই হয়তো জানেন, কলকাতায় জনবসতির একটা বড় অংশই হল মারওয়াড়ি সম্প্রদায়ের মানুষ ৷ স্বাধীনতার অনেক আগের থেকেই ব্যবসার কাজেই হোক বা অন্য কোনও কারণে, এশহরের বিভিন্ন প্রান্তে বসতি গড়েছেন রাজস্থান থেকে আসা অসংখ্য মারওয়াড়ি ৷ দেশের বিভিন্ন রাজ্যের মতো কলকাতাতেও বরাবরই মারওয়াড়িদের দাপট লক্ষ্য করা গিয়েছে ৷ এর পিছনে অবশ্য এক নয়, অনেক কারণ রয়েছে ৷ সেগুলো কী, আসুন দেখে নেওয়া যাক ৷
১. জগত শেঠের কাহিনী- বাংলায় মারওয়াড়িদের বসবাস শুরু ব্রিটিশদের এদেশে আসারও অনেক আগের থেকে ৷ নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ, বলা যেতে পারে ‘ডান হাত’ ছিলেন জগত শেঠ ৷ নবাবের টাকা পয়সার লেনদেন এবং সমস্ত হিসেব নিকেশ দেখার গুরুদায়িত্ব অনেকাংশেই ছিল তাঁর উপরেই ৷ টাকা-পয়সার হিসেব-নিকেশ এবং ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে মারওয়াড়িদের জুড়ি মেলা ভার ৷ এই ধারণা তাই আজকের নয়, নবাবদের আমল থেকেই চলে আসছে ৷ রাজস্থানের মারওয়াড়ি সম্প্রদায়ের ইতিহাস, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ার বাণিজ্যকুশলতা নিয়ে কয়েক বছর আগেই টমাস টিমবার্গ-এর ‘ দ্য মারওয়াড়িজ: ফ্রম জগত শেঠ টু বিড়লাজ’ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল। এই বইটিতে কলকাতার নানা অজানা ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে ৷ যেখানে রয়েছে কলকাতায় মারওয়াড়ি সম্প্রদায়ের ইতিহাসও ৷
advertisement
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এই শহরে ‘রডা অস্ত্র ষড়যন্ত্র’-র কথা অনেকেরই জানা । রডা কোম্পানি এখানে মাউজার পিস্তল আমদানি করত, তাদের কেরানি শ্রীশচন্দ্র মিত্র সেখান থেকে বেশ কিছু পিস্তল সরিয়ে রাখেন। অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা অনেকেই এই চোরাই পিস্তল কাজে লাগিয়েছেন। কিন্তু সে পরের কথা ! শহর জুড়ে ধরপাকড়, তল্লাশির সময় পিস্তলগুলি কোথায় ছিল ? সেগুলি আসলে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল বড়বাজার এলাকার ঘনশ্যামদাস বিড়লা, ওঙ্কারমল সরাফ, প্রভুদয়াল হিম্মতসিংকা প্রমুখ মারওয়াড়ি তরুণদের হেফাজতে। বিপ্লব কেবল বঙ্গসন্তানদের একচেটিয়া নয়। অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর আমলে কলকাতার মারওয়াড়ি তরুণদেরও সশস্ত্র আন্দোলনের নজির রয়েছে ৷
advertisement
advertisement
২. ‘ভদ্রলোক’-এর বন্ধু- বাঙালিরা বরাবর ভদ্রলোক হিসেবেই পরিচিতি পেয়ে আসছেন ৷ সাহিত্য, শিল্পকলা এবং নানা সংস্কৃতি নিয়ে চর্চা বাঙালিদের রক্তেই রয়েছে ৷ আবার ব্যবসা-বাণিজ্যের বিষয় বাঙালিদের থেকে কয়েকশো গুণ এগিয়ে মারওয়াড়িরা ৷ তাঁরা বরাবর ‘মানি মাইন্ডেড’ সম্প্রদায় হিসেবেই পরিচিত ৷ বর্তমানে ছবিটা অনেক বদলালেও কোনও বাঙালি বাড়ির ছেলে বা মেয়ে ব্যবসা করবেন, সেটা হয়তো তাঁদের অভিভাবকদের প্রথমে হজম করতেই কষ্ট হয় ৷ মারওয়াড়িদের ক্ষেত্রে বিষয়টা ঠিক উল্টো ৷ ছেলে বা মেয়ে যতোই উচ্চ-শিক্ষিত হোক না কেন, পারিবারিক ব্যবসার কাজে হাত দেওয়াটা তাঁদের বাধ্যতামূলক ৷ ব্যবসা কীভাবে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে তার কৌশল বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পড়ে জানতে হয় না তাদের ৷ কারণ ব্যবসা তাঁদের রক্তেই রয়েছে ৷
advertisement
৩. মারওয়াড়িদের মধ্যে একতা (Unity)- মারওয়াড়ি সম্প্রদায়ের ‘ইউনিটি’ বা একতাই তাঁদেরকে সাফল্যের পথে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে ৷ ধরা যাক কোনও মারওয়াড়ি ব্যবসায়ী বিদেশে নিজের কাজে সাফল্য পেয়েছেন ৷ তিনি নিজের পরিবারের পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুবান্ধবদের কিন্তু ভোলেন না ৷ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য কাউকে সাহায্যে করতে কখনই দ্বিধা করেন না ৷ এই একতাই মারওয়াড়ি সম্প্রদায়কে বরাবর অনেক শক্তিশালী করে তুলেছে ৷ ছোট হোক বা বড়, ব্যবসার কাজে একে অপরকে সাহায্য তাঁরা বরাবরই করে থাকেন ৷ যা বাঙালি বা অনেক সম্প্রদায়ের মধ্যেই অনেকসময় লক্ষ্য করা যায় না ৷ এই একতাই আজ, কলকাতা-সহ দেশের বিভিন্ন শহরে মারওয়াড়িদের সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেছে ৷ কলকাতা বাঙালিদের স্থান হলেও, ব্যবসার কাজে বাঙালিদের বরাবরই পিছনে ফেলেছেন সুদূর মারওয়াড় প্রদেশ থেকে আসা মানুষরা ৷
advertisement
৪. বাঙালিদের সহ্য-শক্তির ক্ষমতা- মারওয়াড়িদের সঙ্গে বাঙালিদের চিরকালই একটা রেষারেষি লক্ষ্য করা যায় ৷ মারওয়াড়িদের নিয়ে বাঙালিরা অনেক সময়েই বিরক্তি প্রকাশও করে থাকেন ৷ ‘মেড়ো’, ‘মারু’...... মারওয়াড়িদের উদ্দেশে এমন নানা শব্দই বাঙালিদের মুখে প্রায়শই শোনা যায় ৷ অনেক সময় কটূক্তি করতেও পিছপা হন না তাঁরা ৷ কিন্তু একইসঙ্গে বাঙালিদের মধ্যে সহ্য-শক্তির ক্ষমতাও অনেক বেশি ৷ সব কিছু মানিয়ে নেওয়াটা হয়তো সবসময় সম্ভব হয় না ৷ কিন্ত ‘ভদ্রলোক’ বাঙালিরা কিন্তু সবাইকে নিয়েই থাকতেই ভালবাসেন ৷ শহরে মারওয়াড়িদের তৈরি স্কুলে যেমন নিজের সন্তানদের পড়াশোনার জন্য পাঠান তাঁরা ৷ তেমনি যতো অপছন্দই হোক না কেন, মারওয়াড়িদের অপমান খুব কম বাঙালিদেরই করতে দেখা গিয়েছে ৷ পাশাপাশি ব্যবসার কাজে মারওয়াড়িরা বাঙালিদের চেয়ে যতোই এগিয়ে থাকুক না কেন, এশহরে দুই সম্প্রদায়ের মানুষ বরাবরই মিলেমিশে চলেছেন ৷ এবং অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা একে অপরের প্রতি নির্ভরশীলও ৷
advertisement
৫. কলকাতা, দেশের প্রাচীণ বাণিজ্য কেন্দ্র- কলকাতা বন্দর নদী বন্দর হলেও একসময় ব্যবসা-বাণিজ্যের দিক থেকে এই বন্দরের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম ৷ জাভা, সুমাত্রা এবং বালির মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ীরা ব্যবসার উদ্দেশে এশহরে পাড়ি দিতেন ৷ আর বাঙালিরা যেহেতু গোটা দেশের মধ্যেই নয়, গোটা বিশ্বেই ‘বিজনেস মাইন্ডেড’ মানুষ হিসেবে একেবারেই পরিচিত নন ৷ তাই কলকাতা-সহ গোটা রাজ্যেই ব্যবসা বাড়ানোর জন্য এমন একটি সম্প্রদায়ের প্রয়োজন ছিল যাদের ব্যবসা নিয়েই গোটা কারবার ৷ এই কাজটা এশহরে প্রথম থেকেই করতে সফল মারওয়াড়িরা ৷ ধীরে ধীরে হলেও কলকাতায় নিজেদের আধিপত্য জমাতে সফল তাঁরা ৷ এছাড়া ব্যক্তিগত হোক বা ব্যবসার কাজে, মারওয়াড়িরা অত্যন্ত ‘ফ্রেন্ডলি’ সম্প্রদায় হিসেবেই পরিচিত ৷ গ্রাহকদের খুশি রাখতে এবং মন জয় করতে তাঁদের জুড়ি মেলা ভার ৷
view commentsLocation :
First Published :
August 31, 2018 10:20 AM IST




