বৈশেখী পয়লা- আজও প্রাসঙ্গিক, আজও প্রয়োজন
- Published by:Sanjukta Sarkar
- news18 bangla
Last Updated:
পয়লা বৈশাখ আজকাল আর অত সেজেগুজে আসে না। কখনও কখনও জিন্স আর হোয়াইট কুর্তির সঙ্গে জাস্ট একটা বড় লাল টিপ পরেও পয়লা হাজির হয় অফিসে!
হ্যাচোড়-প্যাচোড় করতে করতে দক্ষিনাপণের পেছনের গেট দিয়ে ঢুকতেই ধোসার টেবিলের ভিড়টায় চোখ। এইসময় এতটা ভিড় তো চোখে পড়ে না আজকাল! তখনই ধা করে মাথায় এলো কথাটা। পয়লা বৈশাখ আসছে তো! অফিসের কাজের চাপ, আজ রান্নার মেয়ে টুম্পা আসবে না, কাল মা-বাবার ভ্যাকসিনের সেকেন্ড ডোজ, পরশু অ্যাকুয়াগার্ডটা বিগড়েছে, বজ্রাঘাতের মত জীবনে নেমে আসা একের পর এক 'সারপ্রাইজ'! এইসবের মধ্যে পয়লা বৈশাখটা কীভাবে যেন মাথা থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিল।
আসলে পয়লা বৈশাখ আজকাল আর অত সেজেগুজে আসে না। কখনও কখনও জিন্স আর হোয়াইট কুর্তির সঙ্গে জাস্ট একটা বড় লাল টিপ পরেও পয়লা হাজির হয় অফিসে! চৈত্র শেষের মিঠে-কড়া রোদ্দুরে সেই টিপের চারপাশে জমতে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘামে লেপ্টে থাকে, মনের আনাচ-কানাচ জুড়ে থাকে নববর্ষের ছোঁয়াচ। নরম পালকের মত।
হাঁটতে হাঁটতেই এবারে মুঠোফোনের ক্যালেন্ডারে নজর। আজ শুক্রবার। পরের বৃহস্পতিবার পয়লা। মাঝে একটা সপ্তাহও নেই! ঝট করে একগুচ্ছ স্ক্রিনশটের মত ভেসে উঠল ছবিগুলো। ফোন নয়, মন গ্যালারিতে- ছোট্ট মফস্বলি মার্কেট। অথচ ভিড় এই শহুরে ভিড়ের দশগুন। ঘাম প্যাচপ্যাচে, গায়ে গা লাগা সেই ভিড়েও কোথায় যেন নতুন জামার গন্ধ! সাদা কাগজে লাল স্কেচ পেন দিয়ে বড় বড় করে লেখা 'সেল'। আর একগাদা রং-বেরং-এর ছাপা শাড়ি নিয়ে মা আর বাণী কাকিমার বাছাবাছি। কোনওটা জোড়া। কোনওটা খুঁতো। আর তাই, 'অন সেল'। দোকানদারদের হাকাহাকি, দরাদরি, সব মিলিয়ে কী যেন এক উৎসব ছিল সেলের বাজারটাও।
advertisement
advertisement
আজকাল অবশ্য জীবনে এই সবের তেমন বালাই নেই। বিশেষ করে করোনা আসার পর কেনাকাটাটা মূলত করে দেয় অনলাইন শপিং সাইট-গুলো। সেই বা মন্দ কীসের? এই যে মনে মনে হিসেব কষে নেওয়া গেল নতুন বছরের উদযাপনে কী কী 'নতুন' না হলেই নয়, এই যে বাড়ি যাওয়ার পথে গাড়িতেই দু-একটা সাইট স্ক্রল করে কিছু পছন্দসই ও দরকারি জিনিস শপিং কার্ট-এ বা উইশ লিস্টে তুলে নেওয়া যাবে, তাতে অনেকটা সময় তো বাঁচে| বিশেষ করে এরকম হঠাৎ মনে পড়া, ভাইরাস, ভোট আর ভিড়ের চাপ এড়িয়ে পরে পাওয়া পয়লায়।
advertisement
অনলাইন শপিং-এ দুধের স্বাদ ঘোলে মিটলেও কোথাও যেন একটা না পাওয়া থেকে যায়| তাই ছুটি-ছাটা দেখে ছুটে আসা যায় এই দক্ষিনাপণ বা গড়িয়াহাটে। এখানে এখনও খুঁজে পাওয়া যায় সেই পুরনো মেজাজ। ঠিক 'চৈত্র সেল' হয়তো নয়। তবে কিছু কিছু দোকানে ভাল ডিসকাউন্ট দেওয়া হয় এই সময়টায়| আর 'সেল' তো বারো মাসই চলে| শপিং মলে। তাই আগের মত সেই 'চৈত্র সেল'-এর জন্য সারাবছরের অপেক্ষাটাও যে নেই জীবনে! তবু ভিড় দোকানে বিলিং কাউন্টারে দাঁড়িয়ে, কিম্বা নতুন বেড কভার বাছতে বাছতে সেই যোজন দূরের মফস্বলি মার্কেটের গন্ধ নাকে ভেসে আসে। কোথায় যেন মিলেমিশে যায় অতীত এবং বর্তমান। 'পয়লা বৈশাখ' যেন ম্যাজিকের মত জুড়ে দেয় দুটো সময়!
advertisement
চললো ঘণ্টাদুয়েকের 'দ্রুত শপিং'। তারই মধ্যে দু-হাত ভর্তি রংবেরং-এর প্যাকেটে। আর মনও। সে তখন হিসেবে কষছে আর কী বাকি রইল। বৈশাখের প্রথম দিনে আর কী না হলেই নয়? আবার দৃশ্যপট ভেসে ওঠে-- আগের দিন চৈত্র সংক্রান্তি। বাঙাল বাড়ির সেদিন হাজার একটা নিয়ম। কয়েকদিন তারই তোরজোর চলতো। হামানদিস্তায় খৈ গুঁড়ো হচ্ছে। লোহার কড়াইতে সেই গুঁড়ো খৈ পাক দিয়ে তৈরি হচ্ছে 'লাবন'। চিঁড়ের মোয়া, মুড়ির মোয়া। সংক্রান্তির সকালে ওইসবই খেতে হবে ব্রেকফাস্টে। সঙ্গে থাকবে মিষ্টি আর দই। ঠাকুমা একা হাতে সামলাতেন সেসব! যোগাড় দিতেন মা-কাকিমারা। মেনুর দিক থেকে বছরের শেষ দিন ছিল নিয়ম মাফিক নিরামিষ। টকের ডাল আর পাঁচ রকমের সব্জির 'পাঁচন'। মুখ বাংলার পাঁচ করে খেয়ে নিতে হত সেসব। আজকের মতন বাড়ির ছোটদের মত নিয়ে মেনু ঠিক করা হত না সেদিন।
advertisement
তবে পয়লা বৈশাখের খানাপিনা ছিল রাজকীয়! দুপুরে অবশ্যই পাঁঠার মাংস। সঙ্গে নানা পদ। ফল-মিস্টি। আর সকালে লুচি-ছোলার ডাল। তাঁর আগে অবশ্য স্নান করে নতুন জামা পরা। বড়োদের প্রণাম আর 'শুভ নববর্ষ' বলার ধুম। অদভুত একটা শব্দবন্ধ। যাঁর আপাদমস্তক যেন শুধু নতুন আর নতুন! দুপুরে নতুন জামার গন্ধ নিয়ে হাল্কা আয়েশ-ঘুম। কিন্তু মন উড়ুউড়ু। কারণ, বিকেল হতে না হতেই বড়োদের হাত ধরে সেজেগুঁজে বেরিয়ে পড়া। হালখাতা, মিষ্টির প্যাকেট গোনা, নতুন ক্যালেন্ডার আর কোল্ড ড্রিংসের 'অচেনা' ঢেকুর। সবমিলিয়ে হৈহৈ করে শেষ হত দিনটা।
advertisement
আজ বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রয়োজন হয়তো বিশেষ আর পরে না। কিন্তু পয়লা বৈশাখের এই আমেজটুকু যেন আজও বড় প্রয়োজন! নববর্ষে তাই আজও পাল্টায় পর্দার কাপড়। বদলে যায় কুশন কভার। ঘরে আসে নতুনের রং। নতুন পাঞ্জাবী, নতুন শাড়ি, নতুন ফ্রকের গায়ে লেগে থাকা গন্ধ বলে যায়, 'শুভ নববর্ষ'। মাঝ সপ্তাহে পয়লা বৈশাখ? ছুটি নেই? 'কোয়ি বাত' নেই! কাজের ফাঁকে ঝট করে ফোনে আঙ্গুল বুলিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ঠিক করে ফেলা যায় পোস্ট-পয়লা উইকেন্ড প্ল্যানিং। দুপুর-ভর গান-বাজনা, সঙ্গে দেদার খাওয়া দাওয়া! অফিস ফেরত চলে যাওয়া যায় পারিবারিক ডিনারে, সপরিবারে নাটক অথবা নতুন বাংলা ছবি দেখতেও।
advertisement
বৈশাখের পয়লা আসলে মনে থাকে। মস্তিষ্কেও। যেখানে বাঙালিয়ানার বাস। হালখাতা, বাংলা ক্যালেন্ডার, মিষ্টির প্যাকেট নাই বা থাকল। মনের প্রাণের এই বাঙালিয়ানাটুকু তো রয়ে গিয়েছে জলজ্যান্ত। বাঙালির জীবনে 'হ্যাপি নিউ ইয়ার', 'হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন্স ডে'-এর পাশে নতুন বছরের পয়লাটুকু যেন বইয়ের তাকে রাখা গীতবিতানের মতো। আকাশ জুড়ে থাকা পলাশ-শিমুলের মতো। হাজার ভিড়েও ভীষণই স্পষ্ট, ভীষণ প্রয়োজন।
Location :
First Published :
April 15, 2021 7:25 PM IST