Explained || India’s first steel slag road: দেশে তৈরি হল প্রথম ইস্পাত বর্জ্যের রাস্তা, এই রাস্তার বিশেষত্ব নিয়ে কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
- Published by:Rukmini Mazumder
Last Updated:
আধুনিক বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিকে হাতিয়ার করে গুজরাতের মাটিতে ভারত সরকারের উদ্যোগে তৈরি হচ্ছে কয়েকশো কিলোমিটার ইস্পাত রাস্তা।
#সুরাত: এ-কাল আর সে-কাল। যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা। সেই লক্ষ্যে আধুনিক বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিকে হাতিয়ার করে মানুষ তার নিজের মতো করে তৈরি করছে দৈনন্দিন জীবনে চাহিদার উপকরণ। গোটা দেশের জনসংখ্যা ১০০ কোটি ছুঁয়েছে বহুকাল আগেই। তাই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মানুষের নিত্য প্রয়োজনে ব্যবহৃত গাড়ির সংখ্যা। এর সঙ্গে গোটা দেশে শিল্পের মাত্রাও কয়েক দশক ধরে বেড়েছে দ্রুততার সঙ্গে। আর শিল্প-বাণিজ্য মানেই প্রয়োজন ভারি ভারি যানবাহন। শুধু তো যানবাহন হলেই হবে না, প্রয়োজন রয়েছে রাস্তারও। শিল্প আর বাণিজ্যের প্রয়োজনে ব্যবহৃত ভারি ভারি যানবাহন চালানোর জন্য আসলে দরকার ভালো মানের সড়ক। কিন্তু সবই তো সেই মান্ধাতার আমলের পিচের রাস্তা। যার গুণমান নিয়ে গোটা দেশ জুড়ে অভিযোগের অন্ত নেই।
কিন্তু আর পিচ রাস্তা নয়, এবার হবে ইস্পাতের রাস্তা। রাস্তার মেয়াদ অর্থাৎ রাস্তাটি কত দিন ব্যবহারের উপযোগী থাকবে, তার গুণমানই বা কী হবে, এমনকি রাস্তাটি ভারি যানবাহন চলাচলের জন্য উপযোগী কিনা, অথবা পিচের বদলে ইস্পাত দিয়ে রাস্তা তৈরি হলে তা পরিবেশ-বান্ধব হবে কিনা, এমনকি ওই রাস্তা টি তৈরির খরচ পিচ রাস্তার থেকে কম হবে কিনা, এসব নিয়েই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছিল বহুকাল আগে থেকেই। কিন্তু চলতি বছরের শুরুতে সেই প্রতীক্ষার অবসান শেষ হল। শেষ পর্যন্ত দেশের মাটিতে তৈরি হল পিচের বদলে ইস্পাতের রাস্তা।
advertisement
জানা গিয়েছে, সাম্প্রতিক করোনা আবহে গত দু'বছর যাবৎ গোটা দেশ জুড়ে যখন ত্রাহি ত্রাহি রব, ঠিক সেই সময় আধুনিক বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিকে হাতিয়ার করে গুজরাতের মাটিতে ভারত সরকারের উদ্যোগে তৈরি হচ্ছে কয়েকশো কিলোমিটার ইস্পাত রাস্তা। চলতি বছরের মার্চ মাসে গুজরাতের সুরাতে তৈরি ওই রাস্তাটি খুলে দেওয়া হয়েছে ব্যবহারের জন্য।
advertisement
কিন্তু এটা নিয়ে রয়েছে নানা রকম প্রশ্নও। পিচের বদলে বিশেষজ্ঞরা রাস্তা তৈরিতে ইস্পাতকে বেছে নিলেন কেন? পাশাপাশি এই রাস্তা পিচ রাস্তার থেকে আলাদাই বা কেন? তাই দেখে নেওয়া যাক, ভারত সরকারের বিভিন্ন দফতর এবং বিশেষজ্ঞরা ইস্পাত রাস্তা নিয়ে ঠিক কী মত দিয়েছেন। এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন যে, বহুকাল আগে থেকেই ভারি শিল্পের তালিকায় দেশের মাটিতে প্রথম সারিতে রয়েছে গুজরাত। বর্তমানে সুরাতে আর্সেলর মিত্তল এবং নিপ্পন স্টিলের দুটি বড় স্টিল অর্থাৎ ইস্পাত প্রোজেক্ট বা কারখানা রয়েছে। যেখানে ভারি শিল্প চালু রয়েছে। এই দুই বেসরকারি সংস্থার ভারি ইস্পাত কারখানার জন্য কয়েকশো কিলোমিটারের ওই রাস্তা দিয়ে প্রতিনিয়ত ভারি পণ্য নিয়ে কয়েক হাজার যানবাহন প্রতিনিয়ত যাতায়াত করে। এমনকি শিল্পে ব্যবহৃত হওয়ার পর বাকি ইস্পাত বর্জ্যের সঠিক ব্যবহার করে কি করা যায়, তা নিয়ে ভারত সরকারের নীতি (NTTI)আয়োগ, বৈজ্ঞানিক ও শিল্প গবেষণা কাউন্সিল (CSIR) এবং সেন্ট্রাল রোড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (CRRI) কর্তারা কয়েক বছর ধরে রীতিমতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন। অবশেষে এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, মিত্তল ও নিপ্পন স্টিলের ভারি শিল্পের জন্য ব্যবহৃত সুরাতের ওই রাস্তাটি তৈরি করা হবে পিচের বদলে ঢিবি হয়ে জমে থাকা ইস্পাত বর্জ্য বা স্টিল স্ল্যাগ দিয়ে। যেমন ভাবনা, ঠিক তেমনই কাজ।
advertisement
শেষ পর্যন্ত চলতি বছরের মার্চ মাসে কয়েকশো কিলোমিটার ব্যাপী ওই রাস্তাটি সম্পন্ন করে ভারত সরকার। প্রকল্পটি সম্পন্ন হওয়ার পর এই বিষয়ে সুরাত মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন (SMC)-এর সড়ক উন্নয়ন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন যে, ওই রাস্তাটি নির্মাণ করতে প্রক্রিয়াজাত স্টিলের স্ল্যাগ বা ইস্পাত বর্জ্য ব্যবহার করা হয়েছে। রাস্তাটি পিচ রাস্তার থেকে অনেক বেশি টেকসই এবং মজবুতও বটে।
advertisement
প্রকল্পটি কী রকম?
মূল রাস্তাটি ছয় লেনের। আর কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত দীর্ঘও। ওই রাস্তার উপরেই মিত্তল এবং নিপ্পন স্টিলের দুটি বড় মাপের কারখানা রয়েছে। ওই দুই কারখানার ইস্পাত বর্জ্যের ঢিবিকে স্টিল স্ল্যাগ এগ্রিগেটে রূপান্তর করে প্রায় এক বছর আগে রাস্তাটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল। রাস্তার ষষ্ঠ এবং শেষ লেন, যার উভয় পাশে তিন লেনের টু-এন্ড-ফ্রো ক্যারেজওয়ে চলতি বছরের মার্চে মাসের প্রথম দিকে সম্পন্ন হয়। বর্তমানে ওই রাস্তাটি সুরাতের উপকণ্ঠে শিল্প এস্টেটে অবস্থিত বহুজাতিক কোম্পানির ভারী-শুল্কবাহী যানবাহন চলাচলের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। এই বিষয়ে সেন্ট্রাল রোড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (CRRI)এর বিভাগীয় প্রধান বিজ্ঞানী সতীশ পাণ্ডে বলেন, "প্রক্রিয়াজাত স্টিল স্ল্যাগ রোডের নির্মাণ খরচ প্রাকৃতিক সমষ্টি থেকে তৈরি রাস্তার তুলনায় ৩০ শতাংশ কম। এমনকি রাস্তার পুরুত্বও স্বাভাবিকের চেয়ে ৩০ শতাংশ কম"। তিনি আরও বলেন স্টিলের স্ল্যাগ ব্যবহারের কারণে রাস্তাটি অনেক বেশি টেকসই। এ ছাড়াও তিনি উল্লেখ করেন, এই প্রকল্পটি ওয়েস্ট টু ওয়েলথ(WASTE TO WEALTH) এবং ক্লিন ইন্ডিয়া(CLEAN INDIA) অর্থাৎ 'স্বচ্ছ ভারত' মিশনের আওতায় পড়ে।
advertisement
কীভাবে এই রাস্তাটি তৈরি করা হয়?
প্রথমে একটি ইস্পাত চুল্লি থেকে প্রায় ১৫০০ থেকে ১৬০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড উষ্ণতায় জ্বলতে থাকা গলিত ফ্লাক্স উপাদান কাস্টমাইজড অর্থাৎ সাধারণ পদ্ধতি অনুসারে গলিত উপাদানগুলিকে শীতল করার জন্য স্ল্যাগ পিটগুলিতে সেই গলিত ইস্পাত ঢেলে দেওয়া হয়। পাশাপাশি স্থিতিশীল ইস্পাত স্ল্যাগ এগ্রিগেটগুলি আরও শক্ত এবং মজবুত করতে তা আরও প্রক্রিয়াজাত করা হয়। তার পর ওই প্রক্রিয়াজাত স্টিল স্ল্যাগ অর্থাৎ বর্জ্যকে ব্যবহার করা হয় রাস্তা নির্মাণে।
advertisement
ভারি যানবাহন চলাচলের জন্য কী রকম রাস্তার প্রয়োজন?
দেশের পরিবহণ মন্ত্রকের নির্দেশিকা অনুসারে একটি ভারি যানবাহন রাস্তা নির্মাণের জন্য প্রথমেই যে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, তা হল, প্রতিদিন ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ ট্রাক লোড নিতে সক্ষম এমন রাস্তায় প্রয়োজন। নির্মিত ওই রাস্তাগুলি প্রায় ৬০০ থেকে ৭০০ মিলিমিটার পুরু হওয়া প্রয়োজন। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ সাধারণ হাইওয়ের তুলনায় স্টিলের স্ল্যাগ দিয়ে তৈরি হাইওয়ে যেগুলি ভালো উপাদান বৈশিষ্ট্যের কারণে ৩০ শতাংশ কম পুরু হয়। এই ধরনের স্টিলের স্ল্যাগ রাস্তার নির্মাণ খরচও পিচ রাস্তার থেকে প্রায় ৩০ শতাংশ কম। এমনকি প্রতি কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে প্রায় ১ লক্ষ টন প্রক্রিয়াজাত স্টিল স্ল্যাগ ব্যবহার করা হয়।
advertisement
সদ্য নির্মিত ওই রাস্তাটি কীভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে?
জানা গিয়েছে, বর্তমানে ওই রাস্তাটি দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ৩০টিরও বেশি ভারি পণ্য বোঝাই ট্রাক ক্যারেজওয়ে ব্যবহার করা হয়েছে। ওই স্টিল স্ল্যাগ রাস্তাটি পুরো মাত্রায় ব্যবহারের আগে গবেষকরা রাস্তাটির ক্ষমতা, গেজ, চাপ কোষ, স্থানচ্যুতি সবই খুঁটিয়ে দেখে নিতে চাইছেন। সে লক্ষ্যে সঠিক পরিমাপক যন্ত্রের পাশাপাশি থার্মোকাপল ব্যবহার করে লোড-প্ররোচিত বিকৃতি এবং ফুটপাথ এলাকায় চাপ ও ক্ষমতা বা স্ট্রেংথ পরিমাপ করেছেন। এই বিষয়ে গবেষকরা জানিয়েছেন, রাস্তার ফুটপাথের তাপমাত্রা পরিমাপের জন্য থার্মোকাপল ব্যবহার করে ফুটপাথের স্তরের তাপমাত্রার পরিবর্তনের উপর নজর রাখা হয়েছে। তবে এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজটি সম্পন্ন করা হচ্ছে ভারত সরকারের বৈজ্ঞানিক ও শিল্প গবেষণা কাউন্সিল (CSIR) এবং সেন্ট্রাল রোড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (CRRI) এর যৌথ উদ্যোগে।
কেন ওই রাস্তাটি তৈরি করা হল ?
এ বিষয়ে বিশেষ সূত্র মারফত জানা গিয়েছে, ওই রাস্তাটি নির্মাণের জন্য বেছে নেওয়ার কারণই হল ওই রাস্তার ধারেই রয়েছে মিত্তল এবং
নিপ্পন কোম্পানির দুটি ভারি ইস্পাত কারখানা। ফলে ওই রাস্তা দিয়ে বছরভর ভারি পণ্যের গাড়ি চলাচল করে নিয়মিত। এই অবস্থায় বর্ষাকালে ওই রাস্তাটির অবস্থা একেবারে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে। তখন যানবাহন চলাচল তো দুরঅস্ত, মানুষ চলাচলাচলেরও অযোগ্য হয়ে পড়ে ওই রাস্তাটি। পাশাপাশি পরিবেশ বাঁচাতে স্টিল স্ল্যাগ ব্যবহারের প্রয়োজনের কারণেই ওই রাস্তাটি দ্রুত নির্মাণ প্রয়োজন ছিল বলে জানা গিয়েছে। রাস্তাটি তৈরির জন্য প্রায় ২ মিলিয়ন টন স্টিল স্ল্যাগ ব্যবহার করা হয়েছে।
এই ধরনের রাস্তা তৈরিতে খরচ সাশ্রয় হয় কি?
এক কথায় এর স্পষ্ট উত্তর, হ্যাঁ। এ বিষয়ে সুরাত মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন (SMC) সড়ক উন্নয়ন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন যে, এই রাস্তা
নির্মাণে প্রক্রিয়াজাত স্টিলের স্ল্যাগ ব্যবহার বর্জ্যের টেকসই ব্যবহারের পথ প্রশস্ত করে এবং পচনশীল প্রাকৃতিক সমষ্টির উপর নির্ভরতা হ্রাস করে। এই প্রক্রিয়াটি রাস্তা নির্মাণের কার্যকলাপে (GHG) নির্গমন এবং কার্বন পদচিহ্ন হ্রাস করবে বলেও আশা করা হচ্ছে। পাশাপাশি এর সঙ্গে টেকসই ও মজবুত শিল্পায়ন এবং সবুজ প্রযুক্তির মাধ্যমে স্থিতিস্থাপক অবকাঠামো নির্মাণের জন্য জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের ৯ নম্বর নির্দেশিকার সঙ্গে ভারতের প্রতিশ্রুতি সামঞ্জস্যপূর্ণ। রাস্তাটির নির্মাণ খরচ প্রসঙ্গে সুরাত মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের সড়ক উন্নয়ন বিভাগের ইঞ্জিনিয়ার বি আর ভাট বলেছেন, “প্রক্রিয়াজাত স্টিল স্ল্যাগ রাস্তার প্রতি বর্গমিটার আনুমানিক নির্মাণ খরচ ১ হাজার ১৫০ টাকা। যেখানে পিচ অর্থাৎ বিটুমিন রাস্তা তৈরিতে খরচ পড়ে ১ হাজার ৩০০ টাকা। এমনকি সিমেন্ট বা কংক্রিটের জন্য খরচ পড়ে ২ হাজার ৭০০ টাকা। স্টিল স্ল্যাগ রাস্তার স্থায়ীত্ব প্রায় ৩০ বছর। যেখানে বিটুমিন অর্থাৎ পিচ রাস্তার মেয়াদ তার অর্ধেক অর্থাৎ ১৫ বছর।
উচ্চ তাপমাত্রা কি এই রাস্তাগুলিকে প্রভাবিত করে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই রাস্তার উপরিভাগ "নিয়মিত রাস্তার তুলনায় মধ্য-দুপুরে এর তাপমাত্রা এক-দুই ডিগ্রি বেশি" হবে। রাস্তার বাইরের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বজায় রাখতে থার্মোকাপল ব্যবহার করা হয়েছে। যাই হোক, এই জাতীয় রাস্তাগুলির কার্বন ফুটপ্রিন্ট অনেক কম বলেই জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে যানবাহনের উপর এই ধরনের রাস্তার প্রভাব সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে, টায়ারের উপর এই তাপমাত্রার প্রভাব নগণ্য । ২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা হলে তবেই স্টিল স্ল্যাগ গলে যায়। কিন্তু ভারতে গ্রীষ্মকালের তাপমাত্রা সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হয় না। অবশ্য তা সত্ত্বেও ওই রাস্তাটির উপরের স্তরে পিচের প্রলেপ দেওয়া হয়েছে।
Location :
First Published :
April 02, 2022 8:27 PM IST