Explained: মূল্যবৃদ্ধির খাঁড়ার ঘা! ইন্দোনেশিয়ার পাম তেল রফতানি নিষেধাজ্ঞা কী ভাবে দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলবে?
- Published by:Swaralipi Dasgupta
Last Updated:
Explained: ভারতে ভোজ্য তেলের দাম এখন এমনিতেই চড়া। এবার ইন্দোনেশিয়া পাম তেল রফতানি বন্ধ করে দিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
#নয়াদিল্লি: ২৮ এপ্রিল থেকে পাম তেল (Palm Oil) রফতানি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইন্দোনেশিয়া। শুক্রবার এক ভিডিও বার্তায় দেশটির প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো (Joko Widodo) বলেন, "দেশের অভ্যন্তরে খাদ্যপণ্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে পাম তেলের রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা অপরিহার্য ছিল। বিশ্বজুড়ে মুদ্রাস্ফীতির লাগাম বাড়ছে। দেশের ভেতরে সেই প্রবণতার লাগাম ধরতে এই সিদ্ধান্তের বিকল্প ছিল না।" রফতানি নিষেধাজ্ঞা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে কি না তা নিশ্চিত করতে নজরদারি চালানো হবে বলেও তিনি।
২৮ এপ্রিল থেকে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হলেও কতদিন তা স্থায়ী হবে, সেই আভাস দেওয়া হয়নি। তবে পরবর্তী সময়ে ইন্দোনেশিয়া জানিয়েছে যে ঘোষিত রফতানি নিষেধাজ্ঞা অপরিশোধিত পাম তেলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না, শুধুমাত্র পরিশোধিত (Refined), ব্লিচড (Bleached), ডিওডোরাইজড (Deodorised) বা গন্ধযুক্ত (RBD) পাম তেলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। এদিকে, ইন্দোনেশিয়ার নিষেধাজ্ঞায় ভোজ্য তেলের মূল্য আরও বাড়বে। ভোজ্য তেলের দাম বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য ভোগ্য পণ্যের দামও বাড়বে। রান্না ছাড়াও চকোলেট থেকে শুরু করে প্রসাধনী-সহ বিভিন্ন মোড়কজাত পণ্য উৎপাদনে পাম তেল ব্যবহার করা হয়। যে কারণে চলমান সংকটে সব ধরনের পণ্যের মূল্য বেড়ে যাবে। ভারতে ভোজ্য তেলের দাম এখন এমনিতেই চড়া। এবার ইন্দোনেশিয়া পাম তেল রফতানি বন্ধ করে দিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
advertisement
ইন্দোনেশিয়াতেই বর্তমানে পাম তেল উৎপাদনে অভ্যন্তরীণ ঘাটতি রয়েছে, তাই দাম উর্ধ্বমুখী। এদিকে দেশের মধ্যেই ভোজ্য তেলের বিপুল চাহিদা। পরিস্থিতি সামাল দিতেই রফতানি বন্ধের সিদ্ধান্ত সেদেশের। যদিও অর্থনীতি যতটা না কারণ, তার থেকে রাজনৈতিক কারণেই অপরিশোধিত পাম তেল রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা চাপাচ্ছে ইন্দোনেশিয়া। দেশে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে এবং প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদোর প্রতিদ্বন্দ্বীরা সমালোচনায় সরব হয়েছেন। ক্রমেই জনপ্রিয়তায় পিছিয়ে যাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট।
advertisement
advertisement
ভারতের জন্য নিষেধাজ্ঞার অর্থ কী?
ভারতে আমদানি করা মোট বার্ষিক পাম তেলের চাহিদার প্রায় ৭০ শতাংশ আমদানি করা হয়। অনুমান করা হয় এর মধ্যে প্রায় ৮-৮.৫ শতাংশ অপরিশোধিত এবং বাকিটা পরিশোধিত। ভারতের মোট অপরিশোধিত পাম তেলের চাহিদার ৫০ শতাংশ আসে ইন্দোনেশিয়া থেকে। এটি প্রতি বছর প্রায় ৮ মিলিয়ন টন পাম তেল আমদানি করে ভারত, যা মোট ভোজ্য তেল ব্যবহারের প্রায় ৪০ শতাংশ। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ভারতে ভোজ্য তেলের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে যাবে। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের (Ukraine-Russia War) কারণে বিভিন্ন দেশ সূর্যমুখী তেলের (Sunflower Oil) বিকল্প হিসেবে পাম তেল আমদানি বাড়িয়েছে। ইউক্রেন এবং রাশিয়া বিশ্বে সূর্যমুখী তেলের বিশ্বের বৃহত্তম রফতানিকারক। বিশ্বের মোট চাহিদার ৪৬ শতাংশ ইউক্রেন থেকে এবং ২৫ শতাংশ রাশিয়া থেকে আসে।
advertisement
ভারত বিশ্বের বৃহত্তম উদ্ভিজ্জ তেল আমদানিকারক। তাই পাম তেল কম আমদানি হলে ভারতে পাম তেল-সহ অন্য তেলের দাম আরও বাড়বে। যার প্রভাব পড়বে অন্যান্য ক্ষেত্রেও।
কোন কোন পণ্য আরও ব্যয়বহুল হতে পারে?
বৃহস্পতিবার থেকে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাম তেল, সয়া তেল (Soya Oil), সূর্যমুখী তেল এবং রেপসিড অয়েল (Rapeseed Oil) সহ সমস্ত প্রধান ভোজ্য তেলের দাম আরও বাড়বে। পাম তেল অনেক দৈনন্দিন ব্যবহারযোগ্য পণ্যে ব্যবহার করা হয়, যেমন- কেক, প্রসাধনী, জৈব জ্বালানি (Biofuels), ডিটারজেন্ট, চকোলেট, মার্জারিন, নুডলস, বিস্কুট, সাবান এবং শ্যাম্পুতে ব্যবহৃত হয়। পাম তেলের দাম বৃদ্ধি এই সমস্ত ভোগ্যপণ্যের দামকে প্রভাবিত করবে।
advertisement
কোন কোন কোম্পানি প্রভাবিত হতে পারে?
২০১৬ সালে হিন্দুস্তান ইউনিলিভার (Hindustan Unilever) বলেছিল যে তারা প্রায় এক মিলিয়ন টন অপরিশোধিত পাম তেল এবং এর ডেরিভেটিভস এবং প্রায় ০.৫ মিলিয়ন টন অপরিশোধিত পাম কার্নেল তেল (Crude Palm Kernel Oil) এবং এর ডেরিভেটিভ ব্যবহার করেছে। ২০২০ সালে কিটক্যাট চকলেটের নির্মাতা নেসলে (Nestle) প্রায় ৪ লাখ ৫৩ হাজার টন পাম তেল এবং পাম কার্নেল তেল কিনেছে। যার বেশিরভাগই ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়া থেকে কেনা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ফেরেরো এবং ফেরেরো (Ferrero) রোচার চকলেট উভয়ই পাম তেল ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। পি অ্যান্ড জি (P&G) তাদের একাধিক পণ্য সামগ্রীতে পাম তেল ব্যবহার করে। ২০২০-২১ সালে ৬.০৫ লক্ষ টন পাম এবং কার্নেল তেল ব্যবহার করা হয়েছিল সংস্থার তরফে। এর বেশিরভাগই ব্যবহৃত হত হোম কেয়ার ও বিউটি প্রোডাক্টে। এই কোম্পানি বিশ্বের মোট পাম তেলের প্রায় ০.৮ শতাংশ কেন। যার ৭০ শতাংশ আসে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে।
advertisement
প্রসাধনী এবং কসমেটিকসের জগতে দেশের মহিলাদের কাছে লো’রিয়াল (L'Oréal) একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। এই সংস্থাটিও তাদের পণ্যগুলিতে পাম তেল ব্যবহার করে। ২০২১ সালে এই সংস্থা ৩১০ টন পাম তেল ব্যবহার করেছিল। যেখানে ৭১ হাজার টন পাম ডেরিভেটিভও ব্যবহার করা হয়। ওরিও (Oreo) কুকিজ প্রস্তুতকারী সংস্থা মন্ডেলেজ ইন্টারন্যাশনালও (Mondelez International) প্রচুর পরিমাণে পাম তেল কেনে। এই সংস্থাটি তাদের পণ্যে পাম তেলের বিশ্বজুড়ে সামগ্রিক উৎপাদনের ০.৫ শতাংশ ব্যবহার করে বলে জানিয়েছিল।
advertisement
স্বস্তিকা ইনভেস্টমার্ট হেডের রিসার্চ হেড সন্তোষ মীনা বলেছেন, "সাবান, শ্যাম্পু, বিস্কুট এবং নুডলসের মতো দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন পণ্য তৈরিতে পাম তেল এবং এর ডেরিভেটিভ ব্যবহার করা হয়। পাম তেল কম আমদানি হলে তা হিন্দুস্তান ইউনিলিভার (HUL), নেসলে, ব্রিটানিয়া (Britannia), গোদরেজ (Godrej Consumer Products Ltd), ম্যারিকো (Marico Ltd) ইত্যাদির মতো কোম্পানিগুলিকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করবে। প্যাকেজজাত খাদ্য পণ্য, সাবান এবং অন্যান্য প্রসাধনী সামগ্রীর দাম বাড়ানো ছাড়া উপায় থাকবে না।"
ইন্দোনেশিয়ার নিষেধাজ্ঞার পর ভোজ্য তেলের দাম প্রাথমিক মেয়াদে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই সপ্তাহান্তে দাম ৫ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। দেশের বাজারে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম বেড়েছে।
ভারতের সামনের পথ কী?
মালয়েশিয়ার থেকে পাম তেল আমদানি বাড়াতে পারে ভারত। মালয়েশিয়া বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পাম তেল উৎপাদনকারী দেশ। তবে শূন্যস্থান পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। রান্নার তেল উৎপাদনকারী সংস্থাগুলির সংগঠন ভারতের সলভেন্ট এক্সট্র্যাক্টরস অ্যাসোসিয়েশন (Solvent Extractors' Association) পাম তেল রফতানির বিষয়ে ইন্দোনেশিয়া সরকারের সঙ্গে অবিলম্বে আলোচনা শুরু করার পরামর্শ দিয়েছে। সংগঠনের ডিরেক্টর বিভি মেহতা (B V Mehta) বলেছেন, "আমরা আমাদের সরকারকে রান্নার তেল রফতানি নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে ইন্দোনেশিয়া সরকারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করার পরামর্শ দিয়েছি। এটি আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে গুরুতর প্রভাব ফেলবে। কারণ আমাদের মোট পাম তেলের অর্ধেক আমদানি ইন্দোনেশিয়া থেকে এবং কেউ এই শূন্যতা পূরণ করতে পারবে না।" জানা যাচ্ছে, পরিস্থিতি বিচার করে ভারত ও ইন্দোনেশিয়া শীঘ্রই পাম তেল সরবরাহের বিষয়ে আলোচনা করবে।
শুধু ভারত নয়, প্রভাবিত হতে চলেছে প্রতিবেশী দেশও"
পাকিস্তান এবং বাংলাদেশও এই নিষেধাজ্ঞার দ্বারা প্রভাবিত হবে। কারণ তারাও ভারতের মতো পাম তেল আমদানির জন্য ইন্দোনেশিয়ার উপর নির্ভরশীল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আবহে বিশ্ব বাজারে অশোধিত তেলের দাম চড়ায় যাতায়াতের জ্বালানি, রান্নার গ্যাস, খাদ্যপণ্য-সহ নিত্য প্রয়োজনীয় বেশিরভাগ সামগ্র কার্যত আগুন। তাতে এবার পাম তেল যুক্ত হবে। পাকিস্তানের ভোজ্য তেল শোধক সমিতির (পিইওআরএ) চেয়ারম্যান রাশেদ জানমোহদ বলেছেন, "ইন্দোনেশিয়া থেকে পাম তেল না আসলে এই ক্ষতি কেউ পূরণ করতে পারবে না। প্রতিটি দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ও হবে।"
নিষেধাজ্ঞা আর কতদিন চলবে?
এডেলউইস সিকিউরিটিজ-র অবনীশ রায় বলেছেন, "এই নিষেধাজ্ঞা সাময়িক। আমাদের মনে হচ্ছে সম্ভবত এটি দুই থেকে তিন সপ্তাহ চলবে। কারণ রফতানি না হলে তাতে আখেরে ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।" তবে, অভ্যন্তরীণ বাজারে রান্নার তেল হিসেবে ব্যবহৃত পণ্যের ঘাটতি দেখা দিলে ইন্দোনেশিয়া পরিশোধিত পাম তেল রফতানিতে চাপানো নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ আরও বাড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ার এক সরকারি কর্তাও এই আশঙ্কার কথা শুনিয়েছেন। মঙ্গলবার সরকারি কর্তা মুজদালিফা মাহমুদ জানান, বৃহস্পতিবার থেকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ পাম অয়েল রফতানিকারক দেশটি কেবল পরিশোধিত, হালকা ও গন্ধযুক্ত (RBD) পাম ওলিনের রফতানি বন্ধ রাখার পরিকল্পনা করছে। যদি পরিশোধিত পাম তেলের ঘাটতি দেখা দেয়, তাহলে রফতানি নিষেধাজ্ঞা বাড়ানো হতে পারে।
Location :
First Published :
April 27, 2022 4:22 PM IST