#নয়াদিল্লি: তীব্র তাপপ্রবাহের (Heatwave) কবলে দেশ। দেশের কয়েকটি অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গিয়েছে, যা অকল্পনীয়। তবে এই মে মাসেও প্রবল গরম পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, মে মাসে এপ্রিলের তুলনায় গরম বেশি পড়ে। আবহাওয়া দফতরের (IMD) পূর্বাভাস অনুযায়ী, মে মাসে পশ্চিম, মধ্য, উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় স্বাভাবিক সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকবে। তবে বাকি আংশের তাপমাত্রা কিছুটা হলেও কম থাকবে। অতিরিক্ত গরম মানুষের জন্য অনেক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে হাজির হয়। তার মধ্যে একটি গ্যাস্ট্রিক সমস্যা। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, তাপপ্রবাহের সময় ইনফ্ল্যামেটরি বাওয়েল ডিজিজ (Inflammatory Bowel Disease) এবং সংক্রামক গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিস (Infectious Gastroenteritis) হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
তাপপ্রবাহ পেটের সমস্যাকে কীভাবে প্রভাবিত করে?
একটি তাপপ্রবাহকে ৬ দিনের সময়কাল হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। যেখানে উচ্চ তাপমাত্রা (High Temperature) দৈনিক গড় তাপমাত্রার ৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি অতিক্রম করে। লাইভসায়েন্স (LiveScience)-র একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যে অতিরিক্ত একদিন তাপপ্রবাহ হলে প্রদাহজনক অন্ত্রের রোগে (Relapse Of Inflammatory Bowel Disease) আক্রান্ত ব্যক্তিদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সম্ভাবনা ৪.৬ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। যদি তীব্র তাপ সোমবার থেকে শুরু হয় এবং সারা সপ্তাহ স্থায়ী হয়, তবে এটি শনিবারের (ষষ্ঠ দিন) মধ্যে সেটিকে তাপপ্রবাহ হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হবে এবং রবিবার (সপ্তম দিন) থেকে আইবিডি (IBD) ফ্লেয়ারের সম্ভাবনা প্রতিদিন ৪.৬ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। অন্ত্রের রোগ (IBD) দুটি রূপে আসে। ক্রোনস ডিজিজ (Crohn’s Disease) এবং আলসারেটিভ কোলাইটিস (Ulcerative Colitis)। উভয়ই পেটে ব্যথা (stomach Pain), ডায়রিয়া (diarrhoea) এবং রক্তপাত ঘটায় (Bleeding)।
গবেষণায় আরও দেখা গিয়েছে যে অতিরিক্ত একদিন তাপপ্রবাহ হলে সংক্রামক গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সম্ভাবনা ৪.৭ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। সাধারণত, নরোভাইরাস বা সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়া বা গিয়ার্ডিয়া পরজীবী সংক্রামক গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিস (GI) সৃষ্টি করতে পারে। যার কারণে বমি এবং পেটে ব্যথা হয়। গবেষণাটি আমেরিকান জার্নাল অফ গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিতে প্রকাশিত হয়েছিল।
পেটের সমস্যা এবং তাপের মধ্যে যোগসূত্র কীরকম?
সুইৎজারল্যান্ডের গবেষকরা পাঁচ বছরের মেয়াদে জুরিখের ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের ভর্তির রেকর্ড পরীক্ষা করেছেন, যার মধ্যে ১৭টি তাপপ্রবাহ অন্তর্ভুক্ত ছিল। গরমের সময় প্রদাহজনক অন্ত্রের রোগে আক্রান্ত মোট ৭৩৮ জন এবং সংক্রামক গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিসে আক্রান্ত ৭৮৬ জন লোককে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। গবেষকরা ৫০৬ জনের অন্য একটি গোষ্ঠীর দিকেও দেখেছেন, যারা অ-সংক্রামক জিআই (GI) সমস্যার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল, কিন্তু তাদের অসুস্থতার সঙ্গে তাপপ্রবাহের প্রভাবের কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। গবেষণা অনুসারে, তাপপ্রবাহগুলি আইবিডি ফ্লেয়ার-আপের ঝুঁকির উপর প্রভাব ফেলতে দেখা গিয়েছে। তবে, তাপপ্রবাহের সপ্তম দিনে সংক্রামক গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিস হওয়ার সর্বাধিক সম্ভাবনা ছিল।
তাপপ্রবাহ আমাদের গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ট্র্যাক্টের ব্যাকটেরিয়া গঠনকে পরিবর্তন করে: তাপপ্রবাহ গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ট্র্যাক্টের ব্যাকটেরিয়া সংমিশ্রণকে পরিবর্তন করে। অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার এই পরিবর্তনে সময় লাগে, যা হজমের সমস্যার উপসর্গগুলির সূত্রপাতের জন্য সাতদিন দেরি হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, তাপপ্রবাহ শারীরিক চাপ তৈরি করে। যা প্রদাহজনক অন্ত্রের রোগকে বাড়িয়ে দেয়।
তাপপ্রবাহের অন্য কিছু প্রভাব কি আছে?
হিট সিনকোপ (Heat Syncope), ক্র্যাম্প (Cramps), ক্লান্তি (Fatigue) থেকে হিট স্ট্রোকের (Heat Stroke) মতো ছোটখাটো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে, যা কখনও কখনও মারাত্মক হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার পারদ বাড়ার সঙ্গে সম্পর্কিত স্বাস্থ্য সমস্যাগুলিকে চিহ্নিত করেছেন। বিশেষজ্ঞরা আরও বলেছেন যে তাপপ্রবাহের কারণে রোদে পোড়া (Sunburn) এবং ছত্রাকের সংক্রমণ (Fungal Infections) হতে পারে। গান্ধিনগরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ পাবলিক হেল্থ-র ডিরেক্টর দিলীপ মাভালঙ্কার বলেছেন যে তাপপ্রবাহের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলি ছোট এবং বড় হতে পারে, যা কখনও কখনও মৃত্যুর বা এমনকী স্থায়ী স্নায়বিক ক্ষতির (Neurological Damage) কারণ হতে পারে। ছোটখাটো পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে মাভালঙ্কার বলেন, "প্রচণ্ড তাপ জলশূন্যতার কারণ হতে পারে, বিশেষ করে যারা বাইরে বের হয়। এছাড়াও হিট ক্র্যাম্প (পেশিতে খিঁচুনি), ক্লান্তি হতে পারে। অতিরিক্ত তাপপ্রবাহের কারণে হিট সিনকোপ (জ্ঞান হারানো বা মাথা ঘোরা) হতেও পারে। যেহেতু দেশের বেশ কিছু অংশ তীব্র তাপপ্রবাহের কবলে পড়ছে, তাই হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। হিট স্ট্রোক হল সাধারণ তাপ-সম্পর্কিত রোগ, যার ফলে মৃত্যু হতে পারে। হিট স্ট্রোকের কারণে রক্তের তাপমাত্রাও বেড়ে যায় এবং মস্তিষ্কে প্রোটিন জমে যায়। এটি স্নায়বিক ক্ষতির কারণ হতে পারে এবং কখনও কখনও মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। বয়স্ক ও অন্য অসুস্থতা রয়েছে, এমন ব্যক্তিরা বেশি হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। প্রচণ্ড তাপ হৃৎপিণ্ড এবং ফুসফুসের মতো অঙ্গগুলির উপর আরও চাপ সৃষ্টি করে। কারণ তারা তাদের ক্ষমতার বাইরে কাজ করে, যা বিপজ্জনক হতে পারে। আসলে বাইরে বের না হয়েও কেউ পরোক্ষ হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হতে পারে।"
আরও পড়ুন : বিয়ে করলেই কমে যাবে নাছোড়বান্দা 'এই' নেশা! জানেন কি সেই বদ অভ্যেস?
মুম্বইয়ের মাসিনা হাসপাতালের পালমোনোলজিস্ট সংকেত জৈন বলেছেন, গত দুই সপ্তাহ ধরে তাপ বৃদ্ধির কারণে অনেক রোগীর জানিয়েছে যে তাদের পেট ফুলে যাচ্ছে, খাবার খেতে ভাল লাগছে না। অনেকেই রাতে ঘুম না হওয়ার কথাও জানিয়েছে। স্যার এইচ এন রিলায়েন্স ফাউন্ডেশন হাসপাতালের চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ বনানী চৌধুরীও অতিরিক্ত গরমের কারণে ছত্রাকের সংক্রমণের সমস্যা তুলে ধরেন। চৌধুরী বলেন, "প্রচুর ঘামের কারণে ছত্রাকের সংক্রমণ অন্য কারও কাছ থেকে আসে না। এটি আমাদের শরীরে থাকা ছত্রাকের কারণেই হয়, ঘামের কারণে তারা সংখ্যায় বৃদ্ধি পায় এবং সংক্রমণ ঘটায়। সংক্রমণগুলি হাতের নিচে, কুঁচকিতে হতে পারে এবং তারপরে শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তারা খুব সংক্রামক এবং দ্রুত মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং আশপাশের অন্যান্য লোকেদেরও সংক্রামিত করতে পারে।"
মুম্বইয়ের চিকিৎসক হরিশ চাফলে বলেছেন যে উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের অবশ্যই পর্যবেক্ষণে রাখা উচিত। শিশু এবং ছোট বাচ্চাদের, ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সিদের স্বাস্থ্যের প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ দেওয়া দরকার। বয়স্ক, স্থূল, যাদের হৃদরোগ বা উচ্চ রক্তচাপ আছে বা যারা বিষণ্নতা, অনিদ্রা বা দুর্বল সঞ্চালনের জন্য ওষুধ খায়, তাদের স্বাস্থ্যের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার দরকার। হরিশ বলেন, বিকেলের দিকে বাইরের কাজকর্ম এড়িয়ে চলা উচিত। রোদে পোড়া এবং ট্যানিং এড়াতে সানস্ক্রিন ব্যবহার উচিত। প্রচুর পরিমাণে তরল (Fluids) পান করা এবং খুব চিনিযুক্ত বা অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় থেকে দূরে থাকারও পরামর্শ দিয়েছেন ওই চিকিৎসক।
আরও পড়ুন : ফোন থেকে তৎকাল কাটার এই টোটকা জানা আছে? জেনে রাখুন! কনফার্ম টিকিট গ্যারান্টি!
হরিশ বলেছেন, "অতিরিক্ত ঘাম শরীর থেকে লবণ এবং খনিজ পদার্থকে (Salt And Minerals) সরিয়ে দেয়, যা আবারও শরীরে ঢোকানো প্রয়োজন। লবণ এবং খনিজের জন্য স্পোর্টস ড্রিঙ্ক পান করা যেতে পারে। তবে, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ বা অন্য কোনও সমস্য়া থাকলে আগে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলতে হবে।" মুম্বইয়ের ফর্টিস হাসপাতালের ক্লিনিকাল ডায়েটিশিয়ান শ্বেতা মহাদিক বলেছেন, তাপমাত্রা বাড়লেই শরীরে পানীয়ের চাহিদা বাড়ে। কারণ ঘামের আকারে শরীর থেকে জলের উপাদান বেরিয়ে যায়। নিয়মিত ব্যবধানে সাধারণ জল পান করা খুবই কাজের। এটিতে বিভিন্ন ধরণের খনিজ যোগ করা আরও ভাল। প্রাকৃতিক শীতল পানীয় জৈব উপাদান বহন করে, যা আমাদের গরমে সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। লেবুর রস, কোকুমের রস, জিরে-ধনে বীজের জল, মৌরি বীজের রস শরীরের তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করে।
তাহলে কীভাবে সুরক্ষিত রাখা যায় নিজেকে?
>দুপুরের আগেই বাইরের কাজ সেরে ফেলতে হবে। ১২টা থেকে ৩টের মধ্যে বাড়ির বাইরে না বের হওয়া ভাল।
>তেষ্টা না পেলেও নিয়মিত ব্যবধানে জল খেতে হবে। শরীরে যাতে তারল্য বজায় থাকে।
>হালকা পোশাক পরতে হবে। যাতে ঘাম হলে তাড়াতা়ড়ি শুকিয়ে যায়। পা গরম হবে না, এমন জুতো পরতে হবে।
>দুপুরে বাইরে বেরোলে রোদচশমা, ছাতা অবশ্যই সঙ্গে নিতে হবে। সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে।
>অতিরিক্ত চা বা কফি খাওয়া মোটেই ভাল হবে না। যতটা পারা যায় এড়িয়ে যেতে হবে। বদলে লেবুর জল, ঘোল, ছাতু বা বেলের শরবত বানিয়ে খাওয়া যায়।
>দিনে কয়েকবার ঠান্ডা জলে স্নান করতে শরীর ঠান্ডা থাকবে।
>অসুস্থ লাগলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
নিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।
Tags: Healthy Tips, Heat Wave, Heat Wave Alert