রোজনামচার ইঁদুর দৌঁড়ে শহরতলীর মেয়েদের কাছে পেয়িং গেস্টই ভরসা
Last Updated:
শর্মিতা ভট্টাচার্য: ঘড়ির কাঁটা ন’টা ছুঁইছুঁই। সিস্টেম বন্ধ করতে যাচ্ছি, সংবাদ সংস্থা ‘প্ল্যান’ ঘেঁটে এক লাইনার ধরাল। ‘কাশ্মীরে অমরনাথযাত্রীদের বাসে জঙ্গি হানা’। ব্যাস। বসের ‘ড্যাডিকুল মুড’ মুহূর্তে সুইং । প্রফেশনাল টিম লিডারের ভূমিকায় আদেশ, ‘কপিটা করে বেরোবে’। অগত্যা, পুরো কপি লিখে অবশেষে সিস্টেম শাটডাউন। এদিকে ঘড়ির কাঁটা ততক্ষণে পেরিয়েছে অনেকটা ‘ঘর’। পড়িমরি সব কাজ চুকিয়ে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে বাস। না হলে যে মিস হবে, ১০:৪০ এর শেষ লোকাল। ভিড়ে ঠাসা পাবলিক বসে, দাদু-জ্যেঠুদের ‘দুষ্টু’ হাত থেকে নিজেকে কোনোমতে বাঁচিয়ে হাওড়ায় নেমে , রুদ্ধশ্বাস দৌঁড়ে ট্রেনে আসন জয় লাভ করা। সব মিলিয়ে বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে, প্রায় সাড়ে এগারোটা।
রোজনামচায় দৌড়-ঝাঁপ যায় হোক না কেন, বেশি রাত হলেও বাড়ি নাহয় পৌঁছানো গেল। কিন্তু , ভেবে দেখুন তো! কোনও কারণে ট্রেন যদি ঘন্টাখানেক লেট থাকে! কিংবা হঠাৎ ঝড়-বৃষ্টিতে অভারহেডেড তার ছিঁড়ে যদি বন্ধ হযে যদি মাঝ রাস্তায় আটকে পরে ট্রেন। তাহলে ? একটা মেয়ে যে রোজ শহরতলি থেকে কাজের জন্য় জীবনকে কাঁধে তুলে দৌড়াচ্ছে সে রাতে বাড়ি ফিরবে কি করে? আর এই ঘটিনাগুলো যে শুধুই কল্পনারসাগর থেকে তুলে আনা ‘কপি ভরানোর মুক্ত’ তেমনটা কিন্তু নয়। আমার-আপনার চারপাশে একবার চোখ বলালেই হামেশাই দেখতে পাবেন এই ছবি।
advertisement
একদিকে কাজের চাপ। মেয়ে বাড়ি সাবধানে ফিরতে পারছে কিনা, তা নিয়ে মায়ের রক্তচাপ ঊর্ধ্বমুখী। বাবার ঘন ঘন সিগারেট(ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক)। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ঘেঁটে ঘ হওয়ার আগে, কলকাতাতেই মাথার গোজার ঠাঁই খুঁজতে হয়। দমদম স্টেশন থেকে ঢিল ছোড়া দূরেই, দিল্লি-মুম্বই স্টাইলে ‘পেয়িং গেস্ট’। যাকে গোদা বাংলায় বলে ‘অর্থের অতিথি’। বাইরে থেকে বেশ ঝকঝকে তকতকে । তিনতলা বাড়ির একতলায় রয়েছে একটা ছোট্ট অফিস । সারাদিনই লোকজনের আনাগোনা । দো'তলায় থাকেন পিজির মালিক-মালকিন । আর আমরা ১৬টা মেয়ে তিনতলায় রাজত্ব করে বেরাই । তবে, আমাদের সঙ্গে রয়েছেন আরও একজন । আমাদের কেয়ারটেকার কাম রান্নার মাসি কাম সুখ দু:খের সঙ্গী । পেশার তাগিদে সেও পরিবার পরিজন ছেড়ে আমাদের সঙ্গেই দিনের পর দিন কাটাচ্ছেন ডাইনিংয়ের একটা ছোট্ট সিঙ্গল খাটে ।
advertisement
advertisement
যাই হোক, সব মিলিয়ে তিনতলায় মোট পাঁচটি ঘর । প্রত্যেক ঘরে কমবেশি ৩টে করে বেড । বড় ঘরে আবার ৫টা । এখানে সবাই যে এই রাজ্যের তেমনটা কিন্তু নয় । বেশিরভাগই এসেছে রাজ্যের বাইরে থেকে । কেউ বিহার, অসম । আবার কেউ ওডিশা কিংবা মুম্বই । অনেক সময় ছুটির দিনে বিশেষ কোনও বাড়ি যাওয়া হয় না । সেই সময় ওদের কাছে বসেই অনেক কিছু শেখা । ওদের সংস্কৃতি, খাবারের ধরণ আরও কত কী ! এসব শুনতে শুনতে যে সময় কীভাবে কেটে যায় তার কোনও হুঁশ থাকে না ।
advertisement
তবে, এ তো গেল ভাল দিকটা । খারাপ দিকটাও কিন্তু অনেক সময়ই অজানাই থেকে যায় । এই তো সেদিন ময়ূরীর থেকে ওঁর কলকাতা আসার পর একটা অভিজ্ঞতা শুনে চমকে উঠলাম । তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী ময়ূরী শর্মারও পেশার তাগিদেই অসম থেকে কলকাতায় আসা । চারবছর আগে কলকাতায় আসে । কলকাতা আসার দ্বিতীয় দিন অফিস থেকে পিজি-তে ফিরছিল ময়ূরী । আচমকাই বাসে এক ব্যক্তি খেঁজুরে আলাপ করে ওর সঙ্গে । কলকাতা ময়ূরীর কাছে যে একেবারেই অজানা সেটা কয়েক মুহূর্তে বুঝে যায় ওই ব্যক্তি । এরপরই সে কথায় কথায় জেনে নেয় যে, ময়ূরী কোথায় থাকে । শর্টে বাড়ি পৌঁছোনো যাবে বলে এরপর বাস থেকে ময়ূরীকে জোর করে নামিয়ে একটি অন্ধকার রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে । এরপরই বেগতিক বুঝে চিত্কার করতে শুরু করে ময়ূরী । সামনেই পুলিশ পোস্টে থাকা ট্রাফিক পুলিশরা ছুটে এসে বাঁচায় ময়ূরীকে । এরপর একটা ট্যাক্সি ডেকে কর্তব্যরত ওই পুলিশ অফিসার ময়ূরীকে পিজি পৌঁছে দেয় । ট্যাক্সিতে উঠেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে ময়ূরী ।
advertisement
এ তো গেল শুধু ময়ূরীর কথা । এমন আরও অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে অনেকেরই । কিন্তু ময়ূরী তো পেশার তাগিদে । কিন্তু এমন অনেকেই আছে । যারা সদ্য উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে । তারপরই কলকাতার নামী দামী কলেজে পড়ার জন্য শহরে চলে আসা ৷ যেমন, নামী দামী ফ্যাশন ডিজাইনিং কলেজে পড়ার জন্য মেয়েকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছেন শুভাঙ্গির বাবা । নিজের 'পরী'-কে ছেড়ে থাকতে কতটা কষ্ট হবে সেটা একবারও ভাবেননি তিনি । মেয়ে জীবনে খুব উন্নতি করুক । এটাই শুভাঙ্গীর বাবার একমাত্র লক্ষ্য । একদিন ছুটির দুপুরে বসে এসবই শুনছিলাম শুভাঙ্গীর কাছ থেকে । ছোট থেকেই যা চেয়েছে সেটাই মুহূর্তের মধ্যে হাতের সামনে পেয়ে গিয়েছে । নিজেকে জলের বোতলটা ভরেও কোনও খেতে হয়নি । কিন্তু আজ সেই মেয়েটাকেও খাবার পর নিজের প্লেটটা ধুয়ে রাখতে হয় ।
advertisement
শহরে পেশার তাগিদে আশা কোনও মেয়ে তাও এই অনভ্যস্ত জীবনকেই অভ্যেস বলে মানিয়ে নেবে। কিন্তু ভাবুন তো, সদ্য পড়তে আশা কলেজেই ফার্স্ট ইয়ারের এই মেয়েটার কথা । বাড়িতে দু'বেলা মাছ না হলে যে মেয়ে মুখে খাবার তুলতো না, তাকে মেস-মাসি বলে দিয়েছে সপ্তায় একদিন মাছ। দু'দিন ডিম । আর বাকিদিন নিরামিষ খেতে হবে । আর নিরামিষ মানে? ওই খাবার মুখে তো ঢোকে। কিন্তু গলা দিয়ে যে কিভাবে নামে । সেটা শুধু আমরা ১৬ জনই জানি ।
advertisement
তবু, আমরা সকলে মিলে মজা করে আনন্দেই দিন কাটাই । মেসে থাকতে থাকতেই হয়ে উঠেছি কারোওর নিজের দিদি । আবার কখনও কারওর দু:খ কমাতে মায়ের মতনও হয়ে ওঠার 'নাটক' করতে হয়েছে স্বান্তনা দেওয়ার জন্য । এই তো সেদিনই । পঞ্জাব থেকে আসা দীপ কৌর । বড় হয়ে এয়ারহস্টেস হতে চায় । সেই লক্ষ্য নিয়েই কলকাতা পাড়ি দেওয়া । কিন্তু কলকাতা আসার পর দু'মাস কেটে গেলেও আজও বাড়িকে খুব মিস করে দীপ । আর রাতে ঘুমের মধ্যেই ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠে । ঘটনাচক্রে আমার ঘরে পাঁচটা বেডের মধ্যে একটা বেডে থাকে দীপ । তাই ওকে স্বান্তনা দিতে উঠে যেতে হয় আমাকেই । কিন্তু এসবের মাঝে যে, আমিও মিস করি আমার মা-বাবাকে । সেটা হয়তো বলে উঠতে পারিনা কাউকে । তার জন্য ইন্টারনেটই ভরসা । কখনও ফেসবুক আবার কখনও স্কাইপ ভিডিও চ্যাট । শুধু আমি নয় । আমার মত এমন মেয়েও কম নেই এই পিজি-তে । চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে না পড়লেও বুকের মধ্যে কোথাও যেন একটা চিনচিন করে ওঠে ।
তবে, সবকিছুই তো ভালমন্দ মিশিয়েই । এত ভালোর মধ্যেও কি কিছু ভাল নেই ? রয়েছে । পেয়িং গেস্টের ভিতরেই উইকএন্ডে চলে উদ্দাম পার্টি । লুকিয়ে লুকিয়ে সেই পার্টিতে আবার কেউ নিয়ে এসে হাজির হয় ছোট্ট একটা ওয়াইনের বোতল নিয়েও । চুপিসারে খেয়ে আবার শুরু হয় নাচ-গান আর পাগলামি । এছাড়াও রয়েছে কথায় কথায় পিকনিক । তবে, মেনু একটাই ম্যাগি । মেস-মাসি কাজে বাইরে বেরোনো যেন হাতে চাঁদ পাওয়ার সমান । সকলেই সকলের 'সিন্দুক' তথা মাথা পিছু বরাদ্দ একটা করে আলমারি থেকে বের করে আনে ম্যাগি প্যাকেট । তারপর দুরন্ত বেগে শুরু হয় ম্যাগি বানানো । কেউ পেঁয়াজ কাটছে তো কেউ কড়াইয়ে জল গরম করছে । এবার তো ভাবছেন কেন এত তাড়াহুড়ো ? বিষয়টা একটাই । মেস-মাসি যদি একবার দেখতে পান যে, রান্নাঘর আমাদের দখলে । তাহলেই প্রত্যেকের কপালে জুটবে মোটা টাকার ফাইন । কারণ এই পিজিতে রান্না করা নৈব নৈব চ ।
কখনও বার্থডে পার্টি সেলিব্রেশন ৷ কখনও ম্যাগি কিংবা ওয়াইন পার্টি ৷ আর সেই সঙ্গে উদ্দাম নাচ৷ (নিজস্ব চিত্র)যাই-ই হোক । এসব ছাড়াও আরও বেশ কিছু কিন্তু রয়েছে আনন্দের রসদ । কারণ এই পিজিতে নেই কোনও রেস্ট্রিকশন । স্কুলের হস্টেলের মত । পিজি-তে এসে তো নিয়মকানুনের কোনও বাধ্যবাধকতা নেই শুনে চমকেই উঠেছিল শ্রেয়া। কারণ ওর অন্ধ্রপ্রদেশের স্কুলের হস্টেলে ছিল একগাদা নিয়ম । পিজিতে কি পোশাক পড়বে তারা । সেটাও নাকি হস্টেল কর্তৃপক্ষ ঠিক করে দেবে । ফোন, টাকা পয়সা এমনকী, পারফিউমও নিজের কাছে রাখার অনুমতি ছিল না শ্রেয়া আর আকৃতিদের।
এ তো গেল পিজির কথা । কিন্তু বাইরে থাকছে ঘরের মেয়ে ? সেই নিয়ে পরিবার পরিজনের কথায় বেজায় সমস্যায় পড়েন মা বাবা । সকলের একটাই কথা... টাকা রোজগার করছে তো ঠিক আছে । কিন্তু একা একা আবার কেন থাকতে হচ্ছে ? সেরম হলে ভাল পাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে দাও । আবার কেউ কেউ তো এমনও বলেন যে, মাস্টার্স পাশ করেছে । অনেক পড়াশুনা করেছে । আর চাকরি নয় । এবার ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার দেখে বিয়ে দাও । মেয়ের বয়সও তো বাড়ছে ! শুধু মা বাবাই নয় । পরিবার-পরিজন, আত্মীয়সজন, প্রতিবেশীদের ব্যাঁকা নজরের স্বীকার যে, আমিও হইনি সেটাও বলা ভুল । রাত ১টা ২টো অফিস থেকে ফেরার সময় শুনে কারোওর কারোওর তো চোখ কপালে উঠল । কী এমন কাজ করি ? কি জন্য এত রাত হয় আমার বাড়ি ফিরতে ? তাদের সেই সমস্ত ভ্রু কোঁচকানো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি । তাই হাল ছেড়ে দিয়ে তাদেরকে স্মাইলি ফেসে বিদায় জানাতেই আমি অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি । কারণ তাদের কাছে একা থাকা মানেই দেদার ফুর্তি আর চূড়ান্ত উশৃঙ্খল একটা জীবন । মফস্বলে থেকে কলকাতায় চাকরি করার এই জীবনে কতটা যে, স্ট্রাগল করতে হয় তা একেবারেই অজানা এদের কাছে ।
এসমস্ত কিছু হাসিমুখে শুনতে শুনতে মা বাবাও যে বেজায় ক্লান্ত তা মুখে না বললেও স্পষ্ট বুঝতে পারি । কিন্তু মা বাবার অগাধ বিশ্বাস মেয়ের উপর । 'আমার মেয়ে অনেক বড় হবে, অনেক নাম করবে' । এই বিশ্বাসে ভর করেই শত বাধা মুখ বুজে মেনেই হয়তো আমার মত মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন ।
view commentsLocation :
First Published :
July 29, 2018 6:07 PM IST


