ক্ষতিপূরণ পেলে কি সিঙ্গুরের জমি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে টাটারা? সুপ্রিম কোর্টে সিঙ্গুর মামলার শুনানিতে এমনই ইঙ্গিত মিলল। ক্ষতিপূরণ হিসাবে টাটারা ঠিক কী চাইছে, তা বৃহস্পতিবারের মধ্যে জানানোরও নির্দেশ দিল শীর্ষ আদালত। টাটাদের অস্বস্তি বাড়িয়ে ডিভিশন বেঞ্চের জানিয়েছে, সিঙ্গুরে কারখানার জন্য জমি অধিগ্রহণে প্রক্রিয়াগত ক্রুটি ছিল। আদৌ জনস্বার্থে এই জমি অধিগ্রহণ হয়েছিল কিনা, তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছে সুপ্রিম কোর্ট।
advertisement
কথা ছিল, খড়গপুরে ৬০০ একরে গাড়ির কারখানা তৈরি করবে টাটারা। ৬ মাসের মধ্যেই সেই অবস্থান বদলে যায়। টাটা ও রাজ্য সরকারের তরফে ঘোষণা হয়, সিঙ্গুরে ১০০০ একর জমিতে হবে কারখানা। এর জন্য জনস্বার্থে জমি অধিগ্রহণের বিজ্ঞপ্তি জারি হয়। যে জমি অধিগ্রহণের বিরোধীতায় একসময় উত্তাল হয়েছিল সিঙ্গুর, বুধবার তার বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিল সুপ্রিম কোর্ট। বারবারই যে কথা বলে এসেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কার্যত সেই মতই এদিন শোনা গিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্যে।
জমি অধিগ্রহণ আইনের ১১ (এ) ও ১১ (বি) ধারা লঙ্ঘন করে জমি অধিগ্রহণে কীভাবে সন্মতি দিয়েছিল তৎকালিন মন্ত্রিসভা? সিঙ্গুর মামলায় প্রশ্ন তুললেন বিচারপতি ভি গৌড়া ও বিচারপতি অরুণ মিশ্রর বেঞ্চ। বিচারপতিদের প্রশ্ন, বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ৬০০ একর জমি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ৷ পরে সিঙ্গুরে ১০০০ একর জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত কীভাবে হল? কেন বাড়তি ৪০০ একর জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন পড়ল তা জানতে চাওয়া হয়েছে ৷ জনস্বার্থে জমি অধিগ্রহণের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলেও সেই শর্ত কেন মানা হয়নি?
জনস্বার্থে জমি অধিগ্রহণ হয়নি বলে মনে করার কারণ ব্যখ্যা করেছে সুপ্রিম কোর্ট ৷ আদালতের মতে, জমি অধিগ্রহণের আগে জনমত যাচাই এবং সয়েল ও ফিসিবিলিটি টেষ্ট হয়নি ৷ সবচেয়ে কম ঘনবসতিপূর্ণ ও অনুর্বর অঞ্চল চিহ্নিত করে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে অথচ সিঙ্গুরের ৩ ফসলি জমিকে কারখানার জন্য বেছে নেওয়া হয় ৷
শীর্ষ আদালতের প্রশ্নের মুখে এদিন আরও এক গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত মেলে টাটা সংস্থার তরফে। ক্ষতিপূরণ পেলেই সিঙ্গুরের জমি ছাড়তে রাজি টাটারা। সিঙ্গুর শুনানিতে জানিয়ে দিলেন টাটাদের আইনজীবী। এই সূত্রেই সিঙ্গুর মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির সম্ভাবনাও অনেকটাই বাড়ল। টাটাদের বক্তব্য, সিঙ্গুরের জমি পরিকাঠামো তৈরিতে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে সংস্থা ৷ পরে অন্যান্য খাতে আরও ১৫০ কোটি বিনিয়োগ করা হয় ৷ উপরন্তু, কারখানা সরিয়ে নিয়ে যেতে কয়েকশো কোটি টাকা খরচ হয়েছে ৷ এদিন জমি ফেরত নিয়ে দীর্ঘ সওয়ালে একবারও সিঙ্গুরের জমি রেখে দেওয়ার কথা বলেনি টাটারা।
ক্ষতিপূরণ হিসাবে কী দাবি রয়েছে টাটাদের? বৃহস্পতিবার তা টাটাদের লিখিতভাবে জানানোর নির্দেশ দিয়েছে শীর্ষ আদালত। টাটাদের সেই বক্তব্য শোনার পরই পরবর্তী নির্দেশ দিতে চলেছে সুপ্রিম কোর্ট।
২০১৫ সালের জুলাইতেও তৃণমূল সরকারের তরফে সুপ্রিম কোর্টে সরকারিভাবে এই প্রস্তাব দেওয়া হয় টাটাদের। রাজ্যের সেই প্রস্তাবে অবশ্য সায় দেয়নি টাটারা। সুপ্রিম কোর্টে সিঙ্গুর মামলার এই গতিপ্রকৃতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত অনেকটাই শক্ত করল। জমি অধিগ্রহণ নিয়ে শীর্ষ আদালতের মন্তব্য, টাটাদের জমি ছাড়ার ইঙ্গিত, শেষ দফার ভোটের আগে তৃণমূল সরকারের ততটাই স্বস্তি বাড়াল, যতটা অস্বস্তি বাম সরকারের।
শীর্ষ আদালতের একের পর এক প্রশ্নের মুখে টাটারা জানায়, ক্ষতিপূরণ পেলে সিঙ্গুর ছাড়তে তাঁরা তৈরি। যে প্রস্তাব আগেও একাধিকবার দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। এমনকী ২০১৫ সালের জুলাইতেও সুপ্রিম কোর্টে সরকারিভাবে এই প্রস্তাব দেওয়া হয় টাটাদের। রাজ্যের সেই প্রস্তাবে অবশ্য সায় দেয়নি টাটারা। তা হলে এখন সেই অবস্থান বদলাল কেন? রাজ্য সরকারের কৌশলগত ও আইনি অবস্থানের সামনে কোণঠাসা টাটাদের এছাড়া অন্য কোনও পথ ছিল না বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
সবমিলিয়ে ওয়াকিবহল মহলের মতে, শেষ ধাপে সিঙ্গুর মামলা ৷ ১০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তির চেষ্টার মিলল ইঙ্গিত সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের কথায় ৷ সুপ্রিম কোর্টে সিঙ্গুর মামলার এই গতিপ্রকৃতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত অনেকটাই শক্ত করল। চূড়ান্ত রায়ে সিঙ্গুর সমঝোতাও সিঙ্গুরে জমিহারাদের সুখবর শোনাবে। বুধবারের পর এই আশা করা যেতেই পারে।