কিন্তু সমস্যা অন্যত্র। উপরোক্ত রাষ্ট্রগুলির মতো ভারত এখনও স্বৈরাচারী শাসকের অধীনস্থ নয়। ফলে সরাসরি VPN-এর উপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে নাগরিকের ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া ভারতে ইন্টারনেট ও তথ্য প্রযুক্তি পরিষেবা যে ভাবে সরাসরি অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত সে ভাবে চিন, রাশিয়া বা সৌদি আরবের নয়। তাই একেবার নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেওয়ার সমস্যা রয়েছ এ দেশে। তাই ভারতকে ভাবতে হচ্ছে সতর্কতার সঙ্গে কী ভাবে এই VPN-এ নিষেধাজ্ঞা চাপানো যায়। তবে গত সপ্তাহে CERT-IN আইন প্রণয়নের সঙ্গে সঙ্গেই স্থির হয়ে গিয়েছে যে ভারত সে দিকেই পা বাড়াচ্ছে।
advertisement
আরও পড়ুন - অপেক্ষার অবসান, Whatsapp আপডেটে এ বার বড় ফাইল শেয়ারিংয়ের সুযোগ
তা হলে ভারত কী করতে পারে? জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে VPN-এর উপর নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা আরোপ করা যেতেই পারে। আর তেমনটাই হতে চলেছে।
VPN-কে বলা হয়েছে:
-- যাঁরা এই পরিষেবা গ্রহণ করছেন তাঁদের নামের তালিকা দিতে হবে।
-- নির্দিষ্ট সময় কালের উল্লেখ থাকতে হবে পরিষেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে
-- VPN ব্যবহারকারীদের জন্য IP বরাদ্দ করতে হবে।
-- রেজিস্ট্রেশনের সময় ইমেল, IP এবং টাইম স্ট্যাম্প ব্যবহার করতে হবে
-- কী উদ্দেশ্যে VPN পরিষেবা ব্যবহার করা হচ্ছে তা জানাতে হবে
-- বৈধ ঠিকানা এবং যোগাযোগ নম্বর দিতে হবে
-- VPN গ্রাহকদের মালিকানা প্যাটার্ন নির্দিষ্ট করতে হবে
VPN পরিষেবা কী ভাবে কাজ করে, তা জানা থাকলেই বোঝা যাবে যে এই নিয়মগুলি কার্যকর করা মোটেও যুক্তিসঙ্গত নয়৷ আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে এ সব নিয়ম মেনে চললে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু সমস্যা রয়েছে অন্যত্র।
দেখে নেওয়া যাক VPN কী ভাবে কাজ করে...
VPN-এর ব্যবহার দু’ধরনের হতে পারে— ব্যক্তিগত এবং সংস্থাগত (বেশিরভাগ বড় কোম্পানি)। তারা উভয়ই বিভিন্ন কারণে VPN ব্যবহার করে থাকে। ব্যক্তি মালিকানায় বেশিরভাগই VPN ব্যবহার করেন সেন্সরশিপকে উপেক্ষা করতে বা ব্লক করা কোনও সাইট অ্যাক্সেস করতে কিংবা নজরদারি এড়াতে। আবার অনেকে ইন্টারনেটে গোপনীয়তা রাখতেও VPN ব্যবহার করেন। না হলে অনেক সময়ই বিজ্ঞাপনের ট্র্যাকিংয়ে পড়তে হয় যে কোনও মানুষকে।
ছোট বড় নানা ধরনের সংস্থাগুলি, ডেটা (Data) সুরক্ষার জন্য VPN ব্যবহার করে৷ নিজস্ব তথ্য সুরক্ষিত রাখতে এ ধরনের সংস্থাগুলি তাদের কর্মচারীদের শুধুমাত্র একটি অভ্যন্তরীণ VPN-এর মাধ্যমে অফিস নেটওয়ার্কে লগ ইন (Log-in) করতে দেয়। এ ক্ষেত্রে সেন্সরশিপ উপেক্ষা করা বা ব্লকড সাইটে ঢোকার কোনও উদ্দেশ্য থাকে না। বরং এই সংস্থাগুলির নন-পাবলিক (Non-public) VPN সাধারণ ইন্টারনেটের থেকেও বেশি কড়া হয়। এই ধরনের সংস্থাগুলির ক্ষেত্রে সরকারি নির্দেশিকা মেনে কাজ করা মোটেও অসম্ভব নয়।
পাবলিক VPN-এ নিষেধাজ্ঞা
সমস্যার জায়গা হচ্ছে পাবলিক VPNগুলি। সার্ফশার্ক (Surfshark), নর্ড (Nord) এবং এক্সপ্রেসVPN (ExpressVPN)-এর মতো পাবলিক VPN-গুলি নতুন নিয়ম মানতে পারবে না বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ এই পরিষেবাগুলির মূল মন্ত্রই হল গোপনীয়তা। অনেক ক্ষেত্রে, এই VPN পরিষেবাগুলির একটি নো-লগ (no log) নীতিও থাকে। অর্থাৎ, তারা VPN পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত ব্যবহারকারী ইন্টারনেটে কী কী করছেন তার হিসেব রাখে না। হিসেব না থাকলে তথ্য ফাঁসের সম্ভাবনাও থাকে না।
সমস্যা কোথায়?
ভারতে ব্যবসা করতে গেলে এই সব VPN কোম্পানিগুলিকে ভারতীয় আইন মেনে চলতেই হবে। আর সেই আইন মেনে চলতে গেলে তাদের নীতিগত এমন কিছু পরিবর্তন করে ফেলতে হবে যা আদতে তাদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত পরিষেবাকে দুর্বল করে দেবে। এতে ভারতে ব্যবসা চললেও ক্ষতি হবে অন্যত্র। সারা বিশ্বে এই সংস্থাগুলি বাজার হারাবে। তাদের সুনামও নষ্ট হবে ব্যাপক হারে। বস্তুত পক্ষে এত কান্ড করে কোনও সংস্থাই ভারতীয় নীতি মেনে নিতে রাজি হবে না। ইতিমধ্যে নর্ড (nord) এবং সার্ফশার্ক (surfshark) বলেছে যে তারা নতুন নিয়ম নিয়ে ভারতে পরিষেবা দেওয়ার মতো জায়গায় নেই। অবিলম্বে তারা এ দেশ থেকে তাদের সার্ভার সরিয়ে নেবে বলে স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছে।
ভারতের নতুন VPN নির্দেশিকা কার্যকর হবে আগামী জুন মাস থেকে। সূত্রের খবর, এই নিয়ম আপাতত শিথিল ভাবে প্রয়োগ করা হবে। কিন্তু পরবর্তী কালে তা কঠোর ভাবে প্রয়োগের কথা ভাবা হচ্ছে। মনে করা হচ্ছে কর্পোরেট সংস্থাগুলি যারা নিজস্ব VPN চালায়, সেই সঙ্গে দেশীয় VPN সংস্থা ধীরে ধীরে নতুন নিয়মের সঙ্গে নিজেদের অভিযোজন ঘটিয়ে ফেলতে পারলেই নিয়ম কড়া হবে। তখনই ভারত সরকার নতুন নির্দেশিকা আনবে সারা দেশের জন্য। মনে করা হচ্ছে, Airtel বা Jio-এর মতো ISP-এর মাধ্যমে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ফেলতে পারে কেন্দ্র। ঠিক যে ভাবে চিন Google এবং Apple-এর অ্যাপ স্টোরের মাধ্যমে VPN ব্লক করে দিয়েছে। এমনকী ভারতীয় নাগরিকরা যাতে কোনও ভাবেই আন্তর্জাতিক VPN পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলিকে অর্থ দিতে না পারেন তার ব্যবস্থাও করা হতে পারে।
তবে এই পদক্ষেপ ধীরে ধীরে করছে ভারত সরকার। সরাসরি ‘নিষেধাজ্ঞা’ (Ban) বলার জায়গা থাকবে না ভারতে। বদলে কার্যকর করে দেওয়া হবে নির্দেশিকা। যা মানা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠবে আন্তর্জাতিক VPN পরিষেবা দেওয়া সংস্থাগুলির পক্ষে। আবার ভারতীয় নিয়ম না মেনে নিলে ব্লক করে দেওয়া হবে, তবে তা সাময়িক ভাবে। তবে অবশ্যই একটি নিষেধাজ্ঞা কার্যকর থাকবে এ দেশে। ওয়াকিবহাল মহলের দাবি, সাধারণ মানুষ যে সব VPN পরিষেবা ব্যবহার করেন, তা চালু রাখার পথই বন্ধ করে দেওয়া হবে। বদলে নামমাত্র অনুমতি দেওয়া হবে VPN ব্যবহার করার।
আরও পড়ুন - Google বন্ধ করে দিচ্ছে কল রেকর্ডিং অ্যাপ! জানুন এবার কী করবেন
২০২০ সাল থেকে ক্রমাগত লকডাউনের জেরে সারা বিশ্বের সঙ্গে ভারতেও বেড়েছিল বাড়ি থেকে কাজের (Work from home) রীতি। তার জেরেই ভিপিএন (VPN) বা ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক পরিষেবার রমরমা। এই পরিষেবায় ইন্টারনেট ব্যবহারকারী কোথায় আছেন, কী তার IP পরিচয়— সবটা জানতে পারা মুশকিল হয়ে যায়। ২০২১ সাল থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক এই পরিষেবা বন্ধ করার পক্ষে মত প্রকাশ করতে শুরু করে।
গত বছর প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা গিয়েছিল সারা বিশ্বে VPN ব্যবহারকারীর সংখ্যার নিরিখে ভারত সর্বোচ্চ। কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি, দেশের সাইবার নিরাপত্তার দিকে লক্ষ্য রাখতেই এই পরিষেবাকে নিষিদ্ধ ঘোষণার আবেদন করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এর মাধ্যমে বড় কোনও অপরাধ ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশও করা হয়েছে। তারই ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ভারতে ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (VPN) পরিষেবা নিষিদ্ধ করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছিল গত বছর।
সে কমিটির তরফে জানানো হয়েছিল, 'VPN ব্যবহার করে অনলাইনে নিজের পরিচয় গোপন করছেন সমাজবিরোধীরা।' গত বৃহস্পতিবার ব্যক্তিগত ও কর্পোরেট ক্ষেত্রে অনলাইন কাজের জন্য ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত ‘ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক’ বা ভিপিএন পরিষেবা দেওয়া সংস্থাগুলির কাছে একটি নির্দেশিকা পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রক। আর তার পর থেকেই দেশ জুড়ে শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক। এই নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, গ্রাহকেরা তাদের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে কোথায় কার সঙ্গে কী যোগাযোগ করছে, তার সম্পূর্ণ তথ্য ভান্ডার ভিপিএন পরিষেবা দেওয়া সংস্থাগুলোকে রাখতে হবে। শুধু তাই নয় এই সব তথ্য অন্তত ৫ বছর ধরে তাদের কাছে যত্ন করে রাখতে হবে, এবং কেন্দ্র চাইলেই তা দিতে হবে। অন্যথায় সংস্থাগুলোর কর্ণধারদের কড়া শাস্তির জন্য তৈরি থাকতে হবে।
