'হৃদজায়া' তমলুক শহরের একমাত্র মহিলা পরিচালিত পুজো। প্রাচীন ঐতিহাসিক শহর তমলুক হলেও ২০১৩ সালের আগে কোনও মহিলা পরিচালিত দুর্গাপুজো হতো না। পুজোর আয়োজন থেকে পুজোর সবকিছুই মহিলারা নিজের হাতে করেন। পুজোর বাজেট কম হলেও আন্তরিকতায় ভাটা পড়ে না। এই পুজোর বয়স বেশি না। উৎসবে মেতে ওঠা তমলুক শহরবাসীর কাছে আলাদা জায়গা করে নিয়েছে মহিলা পরিচালিত 'হৃদজায়া'। প্রমিলা বাহিনীর এই পুজো দেখতে ভিড় জমায় শহরবাসী।
advertisement
ঘরবাড়ি সংসার সামলেও অফিস বা কাজের জায়গায় সমান বিচরণ মহিলাদের। পুজো প্রস্তুতি বা পুজোর আয়োজনেই বা তা কেন বাদ যায়। এমনিতেই কর্মনিপুণতায় বাড়ির মহিলারাদের দশভূজা আখ্যা দেওয়া হয়। বাড়ি ঘর সংসার আত্মীয়-পরিজন স্বামী সন্তান সব দায়িত্ব পালন করে থাকেন সাধারণত বাড়ির মহিলারাই। সবার দিকে সমান নজর তাঁদের। আবার কর্মনিপুণতাতেও নারী-পুরুষের ভেদাভেদ মুছে দেন এ যুগের মহিলাকা। বাড়ির মহিলারাই হলেন প্রকৃত দুর্গা। এই মর্তের দুর্গারা বেশ কয়েক বছর ধরে মেতে উঠেছে দেবী দুর্গার আরাধনায়।
সালটা ২০১৩। পাঁচ জন মহিলা মিলে ঠিক করেন, এ বছর তাঁরা দুর্গাপূজা করবেন। যেমন ভাবা তেমন কাজ। শুরু হয় দুর্গাপূজার উদ্যোগ নেওয়া। পাড়ায় নিজেদের মধ্যে মিটিং করে মহিলারা। মিটিংয়ে আরও কয়েকজন বাড়ির মহিলারা এই উদ্যোগে সামিল হয়। মহিলার সংখ্যা বাড়তে বাড়তে তা পাঁচ থেকে পঞ্চাশে পৌঁছায়। শুরু হয় ২০১৩ সালের দেবী দুর্গার আরাধনা। 'হৃদজায়া' নামে তমলুক শহরের বুকে প্রথম মহিলা পরিচালিত পূজা কমিটি গড়ে ওঠে। তমলুকের সাত নম্বর ওয়ার্ডের ঐতিহাসিক রামসাগর পাড়ে প্রতিবছরই আয়োজিত হয় দেবী দুর্গার আরাধনা।
আরও পড়ুন- কাশীপুর রাজ পরিবারের ১৬ দিনের দুর্গাপুজো! নেপথ্যে রয়েছে বিশেষ গল্পকথা
'হৃদজায়া' কমিটির দুর্গাপূজা এবছর নয় বছরে পা দিল। প্রতিবছরই 'মানবী দুর্গাদের' আয়োজিত দেবী দুর্গার আরাধনা দেখতে ভিড় জমায় তমলুক শহরবাসী ও শহরতলির মানুষজন। 'হৃদজায়া' পুজো কমিটির বর্তমান সম্পাদক মিনতি দেবী বলেন, " প্রতিবছর দুর্গাপূজা এলেই মনটা কেমন উদাস উদাস হতো। দুর্গাপূজা এলেই পাড়ার মহিলাদের একাত্ম হওয়ার উপায় থাকত না। পাড়ার মহিলারা কেউ কেউ বাপের বাড়ি চলে যেতেন। কেউ বা বেড়াতে চলে যেতেন। যাঁরা থাকতেন অন্য পুজো প্যান্ডেলে যেতেন, যেখানে আনন্দ করার অতটা সুযোগ থাকত না। তাই চিন্তাভাবনা করা হয়, মহিলারা নিজেরাই পুজো করবেন। এই চিন্তাভাবনা থেকে 'হৃদজায়া'র জন্ম।" তিনি আরও বলেন, "নিজেদের পুজো হলে সেখানে আনন্দের মাত্রার সীমা থাকে না। নিজেরা পুজোর কটা দিন হৈ-হুল্লোড়ে একসঙ্গে কাটানো যায়। পাড়ার সব মহিলারা একসঙ্গে পূজার প্রস্তুতি পুজোর আয়োজন সিঁদুর খেলা ও প্রতিমা নিরঞ্জন সবেতেই অংশ নেন। ফলে সবার সঙ্গে হৃদয়ের আত্মিক যোগাযোগ বাড়ে।"
'হৃদজায়া'-র পুজো দেখতে দেখতে নয় বছরে পড়ল। পুজোর বাজেট কম হলেও আন্তরিকতায় অন্য পুজোগুলিকে টেক্কা দেয় এই পুজো। 'হৃদজায়া'-র পুজোয় আন্তরিকতায় ঘাটতি পড়ে না। আরম্বড় না থাকলেও আছে হৃদয়ভরা ভক্তি, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। এ বছর পুজোর বাজেট এক লক্ষ একুশ হাজার টাকা। প্রতি বছর পুজোর কটা দিন সামাজিক কাজকর্মতে ব্যস্ত থাকেন 'হৃদজায়া' পুজো কমিটির সদস্যরা। এবছর 'হৃদজায়া' তাঁদের এবছরের পুজোর বাজেট থেকে কিছু টাকা বন্যা কবলিত মানুষের প্রাণের কাজে লাগাবে। তাই বাদ দেওয়া হয়েছে ব্যান্ডপার্টি। কেলেঘাই নদীর বাঁধ ভেঙে ভগবানপুর পটাশপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা জলমগ্ন। এই বন্যা পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াতে পুজোর বাজেট থেকে ত্রাণের ব্যবস্থা করেছে 'হৃদজায়া'। ব্যান্ড পার্টির জন্য ধরা অর্থমূল্য যাবে বন্যা পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কাজে।
'হৃদজায়া'-র পুজোর ব্যস্ততা এখন চরমে। জোর কদমে চলছে পুজার প্রস্তুতি। 'হৃদজায়া'-র এছরের পুজোর উদ্বোধন হবে মহাপঞ্চমীতে। উদ্বোধক তমলুকের বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী সৌমেন কুমার মহাপাত্র। সম্প্রতি ঘূর্ণবাতের বৃষ্টির কারণে সাময়িকভাবে ছেদ পড়ে ছিল পুজো প্রস্তুতিতে। দুর্যোগের মেঘ সরে শরৎ আকাশে সেজে উঠেছে নীল সাদায়। ঘর সংসার সামলে মর্তের উমারা ব্যস্ত স্বর্গের উমা আরাধনায়।
সৈকত শী