আজকের শহর শান্তিপুর থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে সর্বপ্রথম মন্ত্র দ্বারা মায়ের মূর্তি পুজো স্থাপন হয় হরিপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত প্রাচীন ব্রহ্মশাসনে। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে মীরকাশিম যখন বাংলার মসনদ দখল করেন তখন তাঁর রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে সরিয়ে মুঙ্গেরে নিয়ে যান এবং এই সময়েই নদিয়া রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে বকেয়া কর না মেটানোর জন্য মীরকাশিমের মনোমালিন্য হয় । নবাবের বকেয়া কর পরিশোধ করতে না পারার কারণে মীরকাশিম বন্দি করেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে এবং তাঁকে পাঠানো হয় বিহারের মুঙ্গের জেলে।
advertisement
১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে মীরকাশিমের সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যুদ্ধ শুরু হলে, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সেই সুযোগে জেল থেকে পালিয়ে আসেন জলপথে কৃষ্ণনগরের উদ্দেশে রওনা দেন। জলপথে ফেরার সময় গঙ্গায় দুর্গাপ্রতিমা নিরঞ্জন দেখে কষ্ট পান ও ব্যথিত হন। সেই রাতেই দেবীর স্বপ্নাদেশে তিনি পরের নবমী তিথিতে জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু করেন। সেই সময় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে দেবী জগদ্ধাত্রীর রূপের কোনও ধারণা না থাকার কারণে ১৭৬৩ সালে তাঁর হাত ধরেই কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে প্রথম দেবী জগদ্ধাত্রীর পুজো শুরু হয় দুর্গামন্ত্রে মঙ্গলঘট পুজোর মাধ্যমে।
এরপর ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের পৌত্র গিরিশচন্দ্র রায় যখন নদিয়ার অধিপতি হন তখন তাঁর রাজসভায় সভাপন্ডিতের পদ অলংকৃত করতেন শান্তিপুরের পশ্চিমে হরিপুর অঞ্চলের চন্দ্রচূড় তর্কচূড়ামণি। ১০৮ ঘর ব্রাহ্মণদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম এবং তিনি ব্রহ্মশাসন গ্রামে বসবাস করতেন। কথিত আছে, তত দিনে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন হয়েছে কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে, কিন্তু দেবীর কোনও নির্দিষ্ট রূপ এবং পুজোর পদ্ধতি বা মন্ত্র ছিল না। গিরিশচন্দ্রই চন্দ্রচূড়কে অনুরোধ করেন সাধনার মাধ্যমে দেবী জগদ্ধাত্রীর রূপের সন্ধান এবং পুজোর জন্য প্রয়োজনীয় পদ্ধতি এবং মন্ত্রের অন্বেষণের।
এর পরে ধ্যানে বসেন চন্দ্রচূড়। আর সাধনায় বসে একদিন ব্রাহ্ম মুহূর্তে দেবীর অপূর্ব মৃন্ময়ী রূপের দর্শন পান। বলা হয়, সেই দেবীর গাত্রবর্ণ ছিল ব্রাহ্মমুহূর্তের রং অর্থাৎ ঊষাকালে সূর্যের রং এবং তিনি ছিলেন সিংহবাহিনী চতুর্ভুজা। কথিত আছে, সেই সাধনাতেই পুজোর পদ্ধতি এবং মন্ত্রের হদিশ পান চন্দ্রচূড়। এর পরে সেই পদ্ধতি মেনেই দেবীর সেই ঊষাবর্ণা মৃন্ময়ী রূপ সৃষ্টি করে তিনি সর্বপ্রথম মন্ত্র দ্বারা মূর্তি পুজো শুরু করেন ব্রহ্মশাসনে।
সম্ভবত ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দ থেকেই কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে মহা আড়ম্বরের সঙ্গে দেবীর মৃন্ময়ী রূপের আরাধনা শুরু হয়। আর পরবর্তীকালে সেই পদ্ধতি অনুসরণ করেই, সেই চিরাচরিত পুজো পদ্ধতি সেই চিরাচরিত পরম্পরা মেনেই জগদ্ধাত্রী পুজো হয়ে আসছে ব্রহ্মশাসন-সহ শান্তিপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ীর নাটমন্দির থেকে শুরু করে পরবর্তীতে এই পুজো ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে শান্তিপুর, চন্দননগর থেকে বাংলার এবং বাংলার বাইরে আপামর বাঙালি সমাজের কাছে।