সাধারণত কাঁকড়া যেমন দেখতে হয় তার থেকে অনেকটা আলাদা। শরীরের পাশে যেন ঘোড়ার নালের আকৃতি। এমনই এক বিলুপ্তপ্রায় কাঁকড়া প্রজাতির সন্ধান পাওয়া যায় বঙ্গোপসাগরের উপকূলে, পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু গত প্রায় ৫-৭ বছর ধরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে বসেছে তারা।
শুধু প্রাগৈতিহাসিক বৈশিষ্ট্যই নয়, বরং এই বিশেষ প্রজাতির কাঁকড়ার রক্ত ওষুধ, প্রতিষেধক এবং জীবাণুমুক্ত চিকিৎসা সরঞ্জামের পরীক্ষায় একটি মূল্যবান উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়।
advertisement
এই হর্সশু কাঁকড়া সাধারণত বাংলার উপকূলরেখা বরাবর অগভীর উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাস করে। এ ধরনের মেরিন চেলিসেরেট আর্থ্রোপড একসময় প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। এখন নৃতাত্ত্বিক কার্যকলাপ, সামাজিক এবং পরিবেশগত কারণে এরা ক্রমশ বিলুপ্ত হচ্ছে। চারটি হর্সশু কাঁকড়ার চারটি ভিন্ন প্রজাতির মধ্যে দু’টি পাওয়া যায় ভারতে। এই দু’টি হল Tachypleus Gigas এবং Carcinoscorpius Rotundicauda ৷
এই হর্সশু কাঁকড়াগুলিকে সাধারণত জীবন্ত জীবাশ্ম হিসাবে উল্লেখ করা হয়। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে এরা এদের রূপবিদ্যা কমবেশি অপরিবর্তিত রেখেছে। বিপন্ন এই প্রজাতির কাছে অঞ্চলের পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতা আরও একটি হুমকি। ২০১৪-১৫ সালে ভারতের জুওলজিক্যাল সার্ভে যে রিপোর্ট প্রকাশ করে তাতে বলা হয়, দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং পূর্ব মেদিনীপুরের কিছু এলাকায় ট্যাকিপ্লাস গিগাস পাওয়া যায় যথেষ্ট পরিমাণে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাকখালি, ক্যানিং, নামখানা এবং সাগর দ্বীপপুঞ্জের উপকূলরেখা বরাবর প্রায় ১০০টি কাঁকড়া দেখা গিয়েছিল। পাশাপাশি পূর্ব মেদিনীপুর উপকূল বরাবর দিঘা, শঙ্করপুর, মন্দারমণিতে এই সংখ্যাটা ছিল ২০০-৩০০।
আরও পড়ুন- মাত্র ১৫ দিনে দু’বার অবস্থান বদল! কারা কারা প্রভাবিত হবেন শনির গোচরে?
ভারত সরকারের বায়োটেকনোলজি বিভাগের তরফে করা সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা যায়, এই অঞ্চলগুলিতে মাত্র একটি বা দুটি পুরুষ কাঁকড়া রয়েছে। ২০১৪-১৫ সালে দিঘায় ২৩৬টি ট্যাকিপ্লাস গিগাস পাওয়া গিয়েছিল। এর মধ্যে প্রায় ১৮০টি কাঁকড়া দম্পতিকে চিহ্নিত করা গিয়েছিল। শঙ্করপুরে ছিল মোট ১৬১ কাঁকড়া, এর মধ্যে প্রায় ১২০টি কাঁকড়া দম্পতি চিহ্নিত করা গিয়েছিল।
সাগর দ্বীপে ৬৭টির মধ্যে প্রায় ৩২টি দম্পতি এবং ফ্রেজারগঞ্জে ৫৯টির মধ্যে প্রায় ২০টি দম্পতি চিহ্নিত করা হয়েছিল। একই সময়ে প্রেন্টিস দ্বীপে ৮১টির মধ্যে ৪০টি মিলন জোড়া দেখা গিয়েছিল। ক্যানিংয়ে মোট ৭৪টির মধ্যে প্রায় ৩০টি মিলন জোড়া পাওয়া যায়।
এই জরিপটি মূলত বর্ষার পর থেকে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাস করা হয়। কিন্তু গত দুই বছরে, এই অঞ্চলে কোনও মিলন জোড়া দম্পতির খোঁজ মেলেনি এবং এমনকী, পুরুষ কাঁকড়ার সংখ্যাও বাংলার উপকূলে একেবারেই কমে গিয়েছে।
বিআইটিএস, কে কে বিড়লা গোয়া ক্যাম্পাসের জীববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সুমিত বিশ্বাস বলেন, ‘‘গত দু’বছরে, আমরা সাগর দ্বীপে দু’টি ট্যাকিপলিয়াস গিগা পুরুষ দেখেছি, একজন শঙ্করপুরে। দিঘায় একটিও পাওয়া যায়নি। তিনটি ক্যানিংয়ে এবং একটি বকখালিতে (ফ্রেজারগঞ্জ) পাওয়া গিয়েছে।’’ কিন্তু এরা সকলেই পুরুষ। কোনও সঙ্গম জোড়া পাওয়া যায়নি। জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে চালানো সমীক্ষায় বরং বংশ বিস্তারের ছবি ধরা পড়বে বলেই আশা করেছিলেন তাঁরা।
গবেষক উৎপল মল্লিক বলেন, ‘বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে দু’টি প্রজাতি বাংলা, ওড়িশা এবং বাংলাদেশেও পাওয়া যায়। গত দু’বছরে আমরা সাগর দ্বীপ, দিঘা এবং অন্য উপকূলীয় এলাকা পরিদর্শন করে একটি কাঁকড়াও খুঁজে পাইনি।’ এর কারণ হিসেবে সরাসরি সৈকত বরাবর নির্মাণ কাজের দিকে আঙুল তুলেছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘সৈকতের বালির চরিত্র বদলে গিয়েছে। ফলে এ ধরনের জীব বিলুপ্ত হচ্ছে।’
তবে আশার কথাও শুনিয়েছেন গবেষকরা। তাঁরা জানিয়েছেন, হয়তো ট্যাকিপ্লিয়াস গিগা ওড়িশা উপকূলে আরও ভাল আবাসস্থল খুঁজে পাচ্ছে।হর্সশু কাঁকড়ার মিল্কি-নীল রক্তে লিমুলাস অ্যামিবোসাইট লাইসেট (এলএএল) নামে একটি বিশেষ জমাট বাঁধা পদার্থ থাকে, যা ওষুধের নমুনাগুলিতে এন্ডোটক্সিন নামক একটি দূষক সনাক্ত করে। হর্সশু কাঁকড়ার নীল রক্ত এই অমূল্য সম্পদ প্রদান করে যা প্রতিষেধক, ওষুধ এবং চিকিৎসা ডিভাইস পরীক্ষা করতে ব্যবহৃত হয় যাতে তারা বিপজ্জনক ব্যাকটেরিয়াল টক্সিন দ্বারা দূষিত না হয়। ২০২০ সালের জুলাই মাসে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক দ্বারা প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, কোভিড-১৯ প্রতিষেধক চালু করার জন্য ঘোড়ার কাঁকড়ার রক্ত চাবিকাঠি ছিল। অধ্যাপক বিশ্বাসের মতে, গত দুই বছরে, কোভিড ভ্যাকসিনের একটি অপরিহার্য পদক্ষেপ ছিল এন্ডোটক্সিন সনাক্তকরণের পরীক্ষা। এলএএল সমৃদ্ধ হর্সশু কাঁকড়ার রক্ত ছিল ত্রাণকর্তা। গত কয়েক দশক ধরে, ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প যে কোনও প্রতিষেধক বা ওষুধে এন্ডোটক্সিন সনাক্তকরণের জন্য একটি অনন্য মাপকাঠি হিসাবে এলএএল পরীক্ষা ব্যবহার করে আসছে।
গবেষণা বলছে এই বিশেষ জীবটি প্যালিওজোয়িক যুগে (প্রায় ৫৪০ থেকে ২৪৮ মিলিয়ন বছর আগে) ট্রিলোবাইটের সঙ্গেই বিবর্তিত হয়েছিল। ট্রাইলোবাইট নামক আদিম আর্থ্রোপড প্যালিওজোয়িক যুগের শেষে অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু হর্সশু কাঁকড়াটি প্রায় ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে ডাইনোসরের বিলুপ্তি, ক্রিটেসিয়াস-টারশিয়ারি (কেটি) বিলুপ্তির ঘটনা-সহ বেশ কয়েকটি গণবিলুপ্তি থেকে বেঁচে গিয়েছিল।
কিন্তু মানুষের হাতে পড়ে বিলুপ্তির দিকে এগোচ্ছে তারা। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, হর্সশু কাঁকড়ার সংখ্যা হ্রাসের পিছনে প্রাথমিক কারণ হল উপকূলের ক্ষয় এবং নৃতাত্ত্বিক কার্যকলাপ। মহিলা কাঁকড়া প্রজননের জন্য একটি বালুকাময় স্তর পছন্দ করে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের এই অঞ্চলে পলির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই তারা এই এলাকা ছেড়ে যাচ্ছে। অপরিকল্পিত বাঁধ, যান্ত্রিক নৌকার ব্যবহার এবং চিনা মাছ ধরার জালের কারণে প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যায়।
দক্ষিণবঙ্গ মৎস্যজীবী ফোরামের সভাপতি এবং পশ্চিমবঙ্গ-ভিত্তিক জাতীয় প্ল্যাটফর্ম ফর স্মল স্কেল ফিশ ওয়ার্কার্সের সদস্য দেবাশিস শ্যামল বলেন, ‘গত ৪-৫ বছর ধরে বাংলার উপকূলরেখায় এই কাঁকড়ার সংখ্যা কমতে দেখেছি। দূষণ এবং অবৈজ্ঞানিক ভাবে মাছ ধরার কারণে এদের প্রাকৃতিক আবাসস্থলকে ধ্বংস হচ্ছে। কোনও সচেতনতা নেই। জেলেদের মূল্যবান প্রজাতি সম্পর্কে অবহিত করা উচিত।’
পুরুলিয়ার সিধো-কানহো-বিরশা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত উপাচার্য এবং পরজীবীবিদ্যার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক দীপকরঞ্জন মণ্ডল বলেছেন, ‘এমন কোনও প্রমাণ নেই যে এরা পারস্পরের সঙ্গে লড়াই করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে কিছু পরিবর্তন ঘটতে পারে। যদি এই প্রবণতা চলতে থাকে তবে এটি বেশ উদ্বেগজনক।’
১৯৫৩ সালে জনস হপকিন্স স্কুল অফ পাবলিক হেলথ-এর প্যাথলজি বিভাগে হর্সশু কাঁকড়ার রক্তে অ্যামিবোসাইট নামক বিশেষ কোষ আবিষ্কার করা হয়। এই কোষগুলি ব্যাকটেরিয়াকে সংযুক্ত করে একটি থকথকে জেল তৈরি করে যা এটিকে কাঁকড়ার শরীরে আক্রমণ করতে বাধা দেয়।