প্রশ্ন: সিঙ্গুরের বাম প্রার্থী আপনি। আর সিঙ্গুর থেকেই ফের শিল্পের জন্য সওয়াল করছেন আপনারা। সিঙ্গুরে শিল্প, তাও আবার বামেদের তরফে। ব্যুমেরাং হবে না?
সৃজন: প্রথমেই বলতে চাইব, শিল্পায়নের স্লোগান যে ভুল নয়, তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেন্দ্র মোদিদের দেখেই বুঝতে পারছে মানুষ। সেদিন তাঁরা শিল্পের বিরোধিতা করেছিলেন। আজ দুজনেই বলছেন, সিঙ্গুরে শিল্প করব। সিঙ্গুরের মানুষের মনে একটা বিষাদ কাজ করছে। সিঙ্গুরের মানুষ যে রাজনীতির জন্য ব্যবহৃত হয়েছিলেন, তা আজ আর কারও অজানা নয়। তাই মানুষ শিল্প চাইছেন, আমরা তাঁদের হয়েই সওয়াল করছি।
advertisement
প্রশ্ন: তবু, শিল্প-কৃষির সংঘাত তো বামেদের কাছে দুঃস্বপ্নের মতো। তা এড়াবেন কী করে?
সৃজন: শিল্প বনাম কৃষির সংঘাতের ন্যারেটিভটা সেদিনও তৈরি করার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু আমরা 'বনাম'-এ বিশ্বাসী নই। আমাদের কাছে কৃষির সাফল্যের উপর দাঁড়িয়ে পরবর্তী অগ্রগতির পদক্ষেপ ফেলা। আমরা পুরনো যা কথা বলেছিলাম, আজও তাই বলব। কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ।
প্রশ্ন: নীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাহলে কোনও ভুল ছিল না?
সৃজন: সময়ের সঙ্গে আমরা শিখেছি, বুঝেছি। যে কোনও পরিকল্পনায় শুরুর দিকে কিছু ঘাটতি, কিছু বোঝাপড়ার অভাব থাকে। কিন্তু এখন আমরা সহমতের ভিত্তিতে এগোতে চাইছি। শিল্প আসলে কারা চায়, তা এই দশ বছরে মানুষ বুঝে গিয়েছেন।
প্রশ্ন: সিঙ্গুরের জন্য তাই নতুন স্লোগান, 'তরুণ রক্ত, নতুন ভাষা/ সৃজন মানেই শিল্প আসা'?
সৃজন: আরও স্লোগান আছে, 'শিল্প কৃষির হাল ফেরাবে/ সিঙ্গুরে এবার লাল ফেরাবে।' আমরা এখনও তাই বলছি। কৃষিকে অগ্রাহ্য বা কম গুরুত্ব দেওয়ার কোনও প্রশ্ন নেই। আমরা কৃষির পক্ষে, কিন্তু পরবর্তী প্রজন্ম যদি চাষ জমিতে ফিরে যেতে না চায়, তাঁরা কোথায় যাবে? আমরা সেই পথটা তৈরির কথা বলছি।
প্রশ্ন: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো বলছেন, শিল্পপতিদের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে। জিতলেই এবার সিঙ্গুরে শিল্প। আপনার বা আপনাদের প্রচার সেখানে কেন গ্রহণযোগ্য হবে কেন? সিটিং চিফ মিনিস্টার বলছেন, তার কথার তো বেশি গুরুত্ব দেবে মানুষ!
সৃজন: শিল্পপতিদের বাড়ি না গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটু পাম অ্যাভিনিউতে বুদ্ধদেব (ভট্টাচার্য) বাবুর বাড়ি যান। ক্ষমা চেয়ে বলুন, বুদ্ধবাবু আমরা আপনাকে খেলাতে গিয়ে একটা প্রজন্মের ভবিষ্যৎকে খেলিয়ে ছেড়েছি। আর তৃণমূল-বিজেপি যে একজোট হয়ে সেদিন সিঙ্গুরের মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন, তা কি আর গোপন আছে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও আজ বলছেন, সিঙ্গুরে শিল্প চাই, সেখানেই তো বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য জিতে গেলেন।
প্রশ্ন: একদিকে হেভিওয়েট বেচারাম মান্না, অন্যদিকে সদ্য প্রাক্তন তৃণমূল নেতা বর্তমানে বিজেপি প্রার্থী মাস্টারমশাই রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। দুই বৃহৎ শক্তিধরের বিরুদ্ধে কি নবীন সৃজনের চাপ অনেকটাই বেশি?
সৃজন: আমার একমাত্র প্রতিপক্ষ এখন এই অসহ্য গরম। আমাদের লড়াই প্রবণতার বিরুদ্ধে। যে প্রবণতায় বেচারাম বাবুকে দুষ্ট করা যায়, সেই প্রবণতায় আমি মাস্টারমশাইয়ের দলকেও কাঠগড়ায় তুলতে পারি। 'ডন 1'-এর পর যেমন 'ডন 2' হয়, তৃণমূল 1 থেকেই তৃণমূল 2 অর্থাৎ বিজেপির এই বাড়বাড়ন্ত। তৃণমূলের বদান্যতা ছাড়া বিজেপি আজকের বিজেপি হত কি?
প্রশ্ন: সূর্যকান্ত মিশ্ররা ভোটের ময়দানে কি গ্রহণযোগ্যতা হারালেন? তাই এবার মীনাক্ষী, সৃজন, ঐশীদের মতো তরুণ মুখের ভিড়? প্রজন্মকে জায়গা ছেড়ে দিতে হয়, বামেদের বুঝতে কি দেরি হল?
সৃজন: কোনও মানুষই আজীবন ভোটে দাঁড়াতে পারবেন না। পরবর্তী প্রজন্ম তো উঠে আসবেই। আমাদের ভোটের প্রক্রিয়া হয় মূলত টিম ওয়ার্ক হিসেবে। সেখানে সবার গুরুত্ব সমান। আর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ৩৩ বছর বয়সে মন্ত্রী হয়েছিলেন। সুভাষ চক্রবর্তী, শ্যামল চক্রবর্তীদের ভুলে গেলে চলবে না। বামেরা যেন গতকালের গল্প হয়ে গেছে। তাঁদের যেন আজ কোনও প্রাসঙ্গিকতা নেই। এটা একটা ক্যাম্পেইন। নবীন-প্রবীণের মিশেল বামেদের মধ্যেই সবথেকে বেশি।
প্রশ্ন: অল্প বয়স, ভোটে দাঁড়ালেন। তৃণমূল, বিজেপি আপনাদের উদ্দেশে বলছে, 'আগে পড়াশোনা সারো, তারপর ভোটে লড়ো।' কোনও উত্তর দিতে পারছেন ওদের?
সৃজন: কেউ কেউ বলছেন বটে, তোমরা কি পারবে, তোমরা তো বড়ই বাচ্চা ছেলে। তাঁদের আমরা বলতে চাইব, সায়ন্তিকা দেবী বা যশ দাশগুপ্তের থেকে তো বেশিদিন আমরা রাজনীতিটা করি, বুঝি।
প্রশ্ন: আব্বাস সিদ্দিকির সঙ্গে জোট করে আর ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলতে পারবেন? আব্বাসের বক্তব্যের দায় আপনারা নেবেন তো?
সৃজন: আব্বাস আগে যা যা বলেছেন, তার প্রকাশ্যে নিন্দা করব। কিন্তু তিনি নিজের ভুল স্বীকার করেছেন বারবার। কিন্তু আব্বাস সৎ। আব্বাস নিজের ধর্মগুরু পরিচয় ফেলে দিয়ে রাজনীতিতে আসছেন না। তাঁকে অকারণ হিজাব পরে সাজতে হচ্ছে না, ভুল চণ্ডীপাঠ করতে হচ্ছে না। আইএসএফ-কে আমি কিছুতেই সাম্প্রদায়িক ভাবতে পারব না। কারণ আব্বাস ইমামদের ভাতা নিতে বারণ করছেন, বরং ইমাম পরিবারের সন্তানের চাকরির হয়ে সওয়াল করছেন। তিনি সকলের উন্নয়নের কথা বলছেন। আব্বাস ধর্মগুরু, কিন্তু সাম্প্রদায়িক নন। শুভেন্দু অধিকারী অনেক বেশি সাম্প্রদায়িক।
প্রশ্ন: মীনাক্ষীকে বলা হচ্ছে কিং মেকার। অর্থাৎ, মীনাক্ষী কতটা ভোট পাবেন, তার উপর নির্ভর করবে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জিতবেন নাকি শুভেন্দু অধিকারী। সিঙ্গুরের সৃজনই কি কিং মেকার হবে না একেবারে কিং?
সৃজন: (হাসি)। না, সিঙ্গুরের মানুষের মুখ-চোখ যা বুঝতে পারছি, তাতে মানুষ কিন্তু বেচারাম মান্না আর রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য- এই সরল সমীকরণ ভাবছেন না। সিঙ্গুরে একদিকে বিজেমূল, যেখানে একই বাড়ির একতলায় বেচারাম বাবু থাকেন, আর দ্বিতীয় তলায় রবীন্দ্রনাথ বাবু। আর অন্যদিকে সিঙ্গুরের প্রতারিত মানুষ, যাঁদের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে একমাত্র সংযুক্ত মোর্চা।
প্রশ্ন: ভোটে দাঁড়ানো বা প্রচারে তৃণমূল-বিজেপির তারকাপ্রীতি নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। কিন্তু এখন কি প্রতিযোগিতায় বামেরাও? তাই সৃজন ভট্টাচার্যের হয়ে প্রচারে ছুটতে হয় শ্রীলেখা মিত্র, রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়দের?
সৃজন: জয়া বচ্চনকে আপনি শেষ কবে বাংলার রাজনীতি নিয়ে দুটো কথা বলতে শুনেছেন? শ্রীলেখা মিত্র কিন্তু ধারাবাহিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি নিয়ে ভোকাল, কথা বলেন, প্রতিবাদ করেন। দেবদূত ঘোষ টালিগঞ্জে আমাদের প্রার্থী, কিন্তু তিনি বহুদিনের বাম কর্মী। অভিনেতারাও তো সংবেদনশীল মানুষ। তাঁরা রাজনীতি নিয়ে কথা বলছেন মানেই গুরুত্বহীন, তা কিন্তু নয়। আপনাকে দেখতে হবে, সেটা কতটা ধারাবাহিক, কতটা জেনুইন। তা দিয়েই স্পষ্ট হবে, সত্যিই কারা রাজনীতি করতে চান, কারা চান না।
প্রশ্ন: ২ মে তাহলে সিঙ্গুরে সৃজন?
সৃজন: জ্যোতি বাবুর লাইনটাই আবার বলতে হয়, 'মানুষই ইতিহাস রচনা করে।' (হাসি)
সুমন বিশ্বাস