দিঘার আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক ইমন কল্যাণ জানার মতে, আজকের দিঘা মোহনা একসময় ছিল বীরকুল নদীর মোহনা। সুবর্ণরেখা নদীর এক প্রাচীন শাখা ছিল এই বীরকুল, যা নরিকুল গ্রামের পাশ দিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নদীর গতিপথ বদলেছে, নরিকুল গ্রাম বিলীন হয়ে গেছে, আর বীরকুল নদী সঙ্কুচিত হয়ে ছোট একটি খালে পরিণত হয়েছে। আর এই বীরকুল নদীর মোহনাই আজকের দিঘা মোহনা।
advertisement
অতীতে এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে বলা হত বীরকুল পরগনা। সাল ১৭৭২। ইংল্যান্ড থেকে বাংলার গভর্নর হয়ে এসেছেন ওয়ারেন হেস্টিংস। গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা, আর তখনও দার্জিলিং ছিল অচেনা নাম। ততদিনে হিজলি নগরীর বহু এলাকা জলোচ্ছ্বাসে নিশ্চিহ্ন। খেজুরিতে বিকল্প বন্দর তৈরি হলেও গরম থেকে ত্রাণ মিলত না। ঠিক এমন সময় ভাগীরথীর মোহনা থেকে দক্ষিণে সমুদ্রতীর ধরে প্রায় ৩০ কিলোমিটার এগিয়ে বীরকুল সৈকত হেস্টিংসের নজরে আসে। নির্জন সৈকত, বন্য প্রাণীর উপস্থিতি, সমুদ্র-মাছ শিকারের সুযোগ, আরামদায়ক পরিবেশ—সব মিলিয়ে এটি হয়ে ওঠে ইংরেজ শাসকের কাছে আদর্শ গ্রীষ্মাবাস। এজন্যই হেস্টিংস বীরকুলকে ‘প্রাচ্যের ব্রাইটন’ বলে অভিহিত করেছিলেন। সেই সময় সৈকত বরাবর রাস্তা তৈরি হয়, পণ্য পরিবহনের সুবিধা বাড়ে, আর বীরকুল অঞ্চলের গুরুত্ব বাড়তে থাকে।
১৯৫০-এর দশকে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ড. বিধানচন্দ্র রায়ের উদ্যোগে দিঘাকে পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়। সঙ্গে সঙ্গে দিঘা মোহনাও জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। মোহনার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সকালের সূর্যোদয়, জেলেদের জীবনযাত্রা, আর ভোরের মাছের বাজার পর্যটকদের কাছে বড় আকর্ষণ হয়ে ওঠে। দিঘায় প্রবেশের মুখে মোহনার মনোরম দৃশ্য অনেককেই থমকে দাঁড়াতে বাধ্য করে। পর্যটকদের কথায়, “দিঘা প্রবেশ পথে মোহনায় না গেলে ভ্রমণই অসম্পূর্ণ।
বর্তমানে দিঘা মোহনা পূর্ব ভারতের অন্যতম সামুদ্রিক মৎস্য নিলাম কেন্দ্র। ভোর হলেই দেখা যায় এখানে মৎস্যজীবীদের মৎস্য শিকারে। সমুদ্র থেকে নৌকা ভিড়তেই শুরু হয় মাছ বাছাই। আজকের দিঘা মোহনা স্থানীয় বহু মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করেছে। আজ নদী বদলেছে, বীরকুল হারিয়ে গেছে, নোরিকুল গ্রামও আর নেই—তবু তাদের স্মৃতিচিহ্ন লুকিয়ে আছে দিঘা মোহনাতেই। ইতিহাসবিদদের কথায়—’নদী বদলায়, পথ বদলায়; কিন্তু তার চিহ্ন রয়ে যায় প্রকৃতির বুকেই।’ ঠিক তেমনই, প্রাচীন বীরকুল নদীর স্মৃতি আজও বেঁচে আছে দিঘা মোহনায়।