পরিবারের প্রবীণ সদস্য শশাঙ্ক শেখর চক্রবর্তী বলেন আনুমানিক বাংলার ১০০০ সালে এই দুর্গাপূজার প্রচলন করেছিলেন স্বর্গীয় নিধিরাম চক্রবর্তী। তার আগে তিনি মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়ে খঞ্চি গ্রামের একটি পুকুর থেকে অভয়া মাতার মাটির মূর্তি উদ্ধার করেন। কিছু বছর পর আবার স্বপ্নাদেশ পেয়ে মাটির মূর্তিকে প্রস্তর মূর্তিতে রূপান্তরিত করা হয়, আর সেই সময় থেকেই দুর্গাপুজোর প্রচলন।
advertisement
কথিত আছে, মায়ের মূর্তি উদ্ধারের এক বছর আগে নিধিরাম চক্রবর্তীর মায়ের প্রয়াণ ঘটেছিল এবং বহু সমস্যার সম্মুখীন হন তিনি। দুর্গা মায়ের স্বপ্নের 'অভয়ে' সমস্ত সমস্যার অবসান হয়। আর সেই থেকেই মায়ের নাম হয় 'অভয়া'। পূজিতা হতে থাকেন পরিবারের মাতা হিসাবে। এই মায়েরই চারজন সহযোগী বনদেবদেবী রয়েছেন খঞ্চি গ্রামের বিভিন্ন প্রান্তে। যাঁরা গ্রামের প্রান্তগুলির রক্ষী হিসাবে বিরাজমান বলেও কথিত রয়েছে। তাঁদের নাম বলী রায় বা বলাই সিং, কালু রায়, দক্ষিণরায় ও মনসা দেবী। প্রতিবছর মকর সংক্রান্তি তিথিতে এবং গ্রামীণ শয়াল উৎসবে তাদের পুজো হয়। দুর্গা পূজার কয়েকদিন মূল মন্দিরে এঁদের নামেও পুজো হয়।
আরও পড়ুন : কয়েকশো বছর ধরে এই সাবেক দুর্গোৎসবের নবমীতে করা হয় মহামারি পুজো
আগে দুর্গাপূজায় নহবত বসত। সন্ধিপুজোর তিথিতে তোপধ্বনি করা হত। কালের নিয়মে সেসব এখন বিলীন হয়েছে। দুর্গাপূজায় আগে অন্নভোগ নিবেদন করা হলেও প্রায় দুশো বছর আগে থেকে কোনও প্রকার অন্নভোগ নিবেদন হয় না । পরিবর্তে আতপ চাল, দুধ, ক্ষীর, ফল, মিষ্টি, সুজি, লুচি, নাড়ু এ সবই নৈবেদ্য দেওয়া হয়। পরিবারের প্রথা অনুযায়ী, নবমীর দিন পরিবারের কুলদেবতা রসিক রাই ঠাকুরের অন্নপ্রসাদ বিতরণ করা হয় ভক্তদের মধ্যে। রীতি অনুযায়ী অভয়া মায়ের বাহন বাঘের পুজোও বিশেষভাবে করা হয়। আগে স্বর্গীয় শ্রীনাথ, সীতানাথ ও গোপীনাথ চক্রবর্তী ---এই তিন ভাইয়ের সময় এই পূজা মহা ধুমধাম করে আয়োজন হতো। কলকাতা থেকে নৌকাতে করে গেঁওখালি পর্যন্ত পূজার সমস্ত বাজার আসত। পূজা কয়েকদিন এই গ্রাম-সহ আশেপাশের অন্যান্য গ্রামের মানুষজনেরাও আসতেন। তবে এখনও পূজা কে কেন্দ্র করে এলাকায় মানুষের উৎসাহ থাকে চরমে। অষ্টমীর দিন পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার জন্য বহু মানুষ উপস্থিত হন। তবে এই পুজোতে কুমারী পুজো হয় না।
চক্রবর্তী পরিবারের সদস্য রাম শংকর চক্রবর্তী জানান মা অভয়া সারাবছর মাতৃরূপে পূজিতা হন। আর এই দুর্গাপূজার কয়দিন স্বয়ং দশভুজা দুর্গা রূপে বাড়ির কন্যা সমজ্ঞানে পুজো করা হয় তাঁকে। তাই আলাদা করে আর কুমারী পুজো হয় না। প্রায় ১৫ পুরুষ ধরে এই রীতিই পালন হয়ে আসছে। রাম শংকর চক্রবর্তী জানান বিগত বেশ কয়েক বছর আগে প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং বন্যার ফলে বেশ কিছু পুরনো নথিপত্র নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তবে যতটুকু সম্ভব এখনো গচ্ছিত করে রাখা হয়েছে। আর তা থেকেই এসব টুকরো টুকরো ইতিহাস জানা যায়।
আরও পড়ুন : বিপ্লবের গন্ধ মেখে মাতৃ আরাধনা নেতাজির ভিটেবাড়িতে
উল্লেখযোগ্য ভাবে এই পুজোর সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নামও জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে। তৎকালীন সময়ে এই খঞ্চি গ্রামে বিপ্লবীদের সংগঠন বিদ্যুৎ বাহিনী গড়ে উঠেছিল। সেই বাহিনীর নেতৃত্ব দিতেন সুশীল ধাড়া সহ অন্যান্য বিপ্লবীরা। এলাকার স্বাধীনতা সংগ্রামী সতীশ চন্দ্র দত্ত সহ বেশ কয়েকজন বিদ্যুৎ বাহিনীর অন্যতম সদস্য ছিলেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে চক্রবর্তী পরিবারের দুর্গাপূজায় সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল তাঁদের। শোনা যায় এক সময় ব্রিটিশ পুলিশ সে কথা জানতে পেরে দুর্গাপূজার ক’দিন চক্রবর্তী বাটিতে পিকেটিং করেছিল। কিন্তু পরিবারের সদস্য প্রমথ চক্রবর্তী, কালী কুমার চক্রবর্তী-সহ অন্যান্যরা ছদ্মবেশধারী বিপ্লবীদের বাড়ির মধ্যে পুলিশের সামনে দিয়েই নিয়ে এসেছিলেন। এসব বহু ঘটনার সাক্ষী এই দুর্গাপূজা।
বংশের রীতি অনুযায়ী সমস্ত কিছুই আচার মেনেই দুর্গাপূজা হবে এ বছরও। তবে করোনা অতিমারির জন্য অত্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন করা করা হয়েছে। তার জন্য সরকারি নির্দেশাবলী পালন করেই পূজা হবে ৷
(প্রতিবেদন- সৈকত শী)