পৃথিবীর সেই কন্যা কাছে এসে অন্ধকারে নদীদের কথা
ক’য়ে গেছে; আমরা বুঝেছি যারা পথ ঘাট মাঠের ভিতর
আরো-এক আলো আছে…’ (বানান অপরিবর্তিত)
আরও একটা বছর পেরিয়ে এলাম। হিসাবে রইল অনেকটা মন্দ আর কিঞ্চিতমাত্র ভাল। তাই কী?
রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘যন্ত্র কেবলই বলছে আমি জোর করে বাধা কাটিয়ে যাবো। যন্ত্রের এই ঔদ্ধত্যে সমস্ত পৃথিবী তাপিত।’ ২০২৪ যন্ত্রের ঔদ্ধত্য দেখল, দেখল অসহিষ্ণুতা, প্রতিযোগিতা। ২০২৪ দেখল গোটা পৃথিবীটায় একটা কাল্পনিক রেখা যার একপাশে শিবতরাই, অন্যদিকে উত্তরকূট। লোভী ও আগ্রাসনকামী মানুষের অপরিমিত লোভ দেখল ২০২৪। ‘কখনও সব কাজ তুচ্ছ হয়—পণ্ড মনে হয়, সব চিন্তা—প্রার্থনার সকল সময় শূন্য মনে হয়…’ আবার কখনও ‘ওই মহামানব আসে।’ একটা বছর পার হয়ে গেল আমাদের কেজো হিসাবে। অথচ ‘অকেজো’ কতকিছুই খেয়াল করিনি আমরা। খেয়াল করিনি মিনারের মতো মেঘ, সোনালী ডানার চিল কিংবা সুপুরির সারি বেয়ে নেমে আসা সন্ধ্যা। দেখিনি, ‘প্রতিদিন ভোর আসে ধানের গুচ্ছের মতে সবুজ সহজ।’ ঠিক মাসে কিস্তির জোগান, পকেটে টান, মাস-মাইনের হিসাব,ডাক্তারের চেম্বার, ওষুধের বিল মেটাতেই কেটে গেল কয়েকটা মধ্যবিত্তের জীবন। কেউ হা-পিত্যেশ করলেন। কেউ ভাবলেন যা পেয়েছি, আঁজলা ভরে দিয়েছেন ঈশ্বর। নাড়িয়ে দিয়ে গেল কিছু মৃত্যু। জুবিন গর্গ-কিংবা শেফালি জরিওয়ালার শোক এখনও ভুলতে পারিনি আমরা। কিছু মানুষ উপস্থিতির সঙ্গেই উন্মাদনা নিয়ে আসেন, এঁরা দুজনেই ছিলেন তেমন। প্রার্থনা করেছি, ‘লেখো আয়ু’। তবু সব থেকে বড় সত্যি হয়ে দাঁড়িয়েছে মৃত্যু, বিচ্ছেদ। ‘এই বাংলার মায়া ভরা পথ’ থেকে বিদায় নিয়েছেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়। ‘ইয়ে দোস্তি হাম নেহি ছোড়েঙ্গে’ বলেও কথা রাখেননি ধর্মেন্দ্র। ‘শেষের বেশে সেজেছ তুমি কি এ!’ তবুও নতুন পাতায় আবার ভরেছে উঠোন। ভূমিষ্ঠ হয়েছে কত শিশু। কত চারহাত এক হয়েছে। আফগানিস্তানে ভূমিকম্পে সারি সারি শব, ঢাকায় স্কুলের উপর ভেঙে পড়া জেট- সব কিছুই বুঝিয়েছিল এ বছরটা মোটের ওপর ভাল না। বছরের তিন মাস পার হতেই একটা বড় ধাক্কা ছিল, পহেলগাঁও। তারপর যুদ্ধ যুদ্ধ আতঙ্ক। আবার ছ-মাস পেরতেই হস্টেলের খাবার ঘরের মাথার ওপর ভাঙল বিমান। দুঃখ মাপার দাঁড়িপাল্লা হয়না। তবু এ বছর আহমেদাবাদের বিমান দুর্ঘটনার মতো ধাক্কা আর কিছুতে বোধহয় খাইনি আমরা। দুই শতাধিক মৃত্যু আর একটা বেঁচে যাওয়া প্রাণ। জানি, ২২৯ জন মৃত্যুর মাঝে একটা জীবন তুচ্ছ। তবু, জীবন তো। আর কিছুক্ষণেই বাজি ফাটবে। নতুন বছরকে বরণ, একরাশ আশা। এমন বাজি ফেটেছিল দিল্লির বাতাসের মতো বিষাক্ত ২০২৫-এও। আইসিসি মহিলা বিশ্বকাপ। খেলার ময়দানে ২০২৫ ছিল পয়া- তা ক্রিকেট হোক, হকি কিংবা দাবা। আরণ্যকের রাজু পাঁড়ের মতো যাঁরা জটিলতার ঊর্ধ্বে, যাঁরা কুঁচো সুপুরি মুখে দিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে, তাঁদের মতো কাউকে পেলাম? পেলাম তো! ইরান-ইজরায়েল যুদ্ধ যেমন ছিল, তেমন ছিলেন এঁরাও। কেউ ফুচকার দোকান চালিয়ে কত পাশ দিয়ে ফেললেন। কেউ মূক-বধির। তবু চালাচ্ছেন ব্যবসা। প্রত্যন্ত গ্রামের কোনও কন্যার গলায় ঝুলল সোনার মেডেল। উত্তরবঙ্গ থেকে কেউ পৌঁছলেন কলম্বিয়ায়। বছরের শেষ পৃষ্ঠা আজ। পুরনো ক্যালেন্ডারের সঙ্গে আবর্জনায় যাক সব অবসাদ-বিষাদ-কালো। ধ্বংস কিংবা শোকের হাতছানি অগ্রাহ্য করে, হল্লা-হুল্লোড়কে আরেকটু প্রশ্রয় দেওয়া যাক। আরেকটু পাশে বসা যাক জীবনের, আরেকটু বলা যাক, লেখো আয়ু… ‘মৃত্যুর নাম অন্ধকার , কিন্তু মাতৃগর্ভ? তাও অন্ধকার, ভুলো না…’
advertisement
