এই ছয় সঙ্গীর সাহায্যে দার্জিলিঙের নামচি পোখরির পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র সৌরভ রাজ প্রকৃতির পুষ্প হয়ে উঠেছে | দার্জিলিঙের " সিটং " ঘুরতে গেলে আপনাকে যেতে হবে " নামচি পোখরি " এলাকায় ৷ নামচি অর্থাৎ নিচু এলাকা আর পোখরি মানে পুকুর৷ আর এই পোখরিকে ঘিরে রয়েছে সুন্দর গাছগাছাড়ি৷ সেখানে গেলেই শুনতে পাবেন পাহাড়ি পাখীদের কলরব৷ রয়েছে সুন্দর একটি প্রাচীন শিব মন্দির ৷ রয়েছে বিশাল এটি প্রয়োজনীয় জঙ্গল ৷
advertisement
ইদানিং কালে এই এলাকাটি পর্যটন কেন্দ্র হয়ে যাওয়ায় মানুষের আনাগোনা বেড়ে গেছে অনেকটাই ৷ আর মানুষ যেখানে সেখানেই দূষণের হাতছানি | মানুষের ব্যবহৃত প্লাস্টিক থেকে শুরু করে যাবতীয় আবর্জনা ক্রমশ দূষিত করছে এলাকাকে৷ যার জেরে একসময় ময়ুরের দল যারা এই প্রকৃতির বুকে ঘুরে বেড়াতো তারাও আজ আতঙ্কে এমুখো হতে চায়না৷ ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে পাখিদের কলরব | কিন্তু চোখের সামনে সব শেষ হয়ে যাবে ? কিছু করা যাবে না !
আরও পড়ুন: দেশের সেরা চিড়িয়াখানা দার্জিলিংয়ে, শৈলশহরের মুকুটে নতুন পালক!
এই সব চিন্তাই কুড়ে কু়ড়ে খাচ্ছিলো " নামচি পোখরির " ছোট্ট সৌরভ রাজকে৷ ছোট্ট সৌরভ ঠিক করে এলাকার তার বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে শুরু করবে প্রকৃতি বাঁচানোর লড়াই ৷ কিন্তু ছোট্ট হাতে এতো কাজ, মাথায় হাত সৌরভ রাজের ৷ আর বন্ধুরাও বলে এতো কাজ করে কি লাভ তাদের৷ হত দরিদ্র বন্ধুদের কথা মাথায় আসে ছোট্ট সৌরভের ৷ সে ঠিক করে সপ্তাহে একদিন সে এলাকা পরিষ্কার করবে, সভ্য মানুষের ফেলে যাওয়া আবর্জনা কুড়িয়ে এলাকা কে দূষণ মুক্ত করবে৷
কাজটা অবশ্য সহজ ছিল না৷ কারণ সৌরভের বন্ধুরা পরিবারের আর্থিক অনটনের কারণেই এই বয়স থেকেই উপার্জনের চেষ্টায় নেমে পড়েছে৷ তাই বন্ধুদের অর্থ লাভের দিশা দেখিয়ে কাজ শুরু করে সৌরভ রাজ ৷ বাবার রয়েছে ছোট্ট মুদিখানার দোকান ৷ সেই টাকায় কোনও রকমে চলে সংসার৷ কারণ এলাকায় পরিবার মানে হাতেগোনা কয়েকটি পরিবার৷ ফলে বাড়ি থেকে যে সে কোনও অর্থ সাহায্য পাবে না সৌরভ রাজ তা জানতো ৷ তাই সে ঠিক করে গাইডের কাজ করে সে পর্যটকদের কাছ থেকে রোজগার করেই সে শুরু করবে প্রকৃতি বাঁচানোর লড়াই ৷
প্রতি পর্যটকদের দল প্রতি তার চাহিদা ১০০ টাকা৷ কেউ দেয় আর কেউ দেয় না৷ তাতে কি, কেউ না দিলেও স্কুলের পর বা ছুটির দিনে এলাকার বিভিন্ন স্থান তার ইতিহাস, প্রয়োজনীয়তা সবই সরল ভাবে উপস্থাপনা করে চলে শিশুটি ৷ ইংরেজি ও হিন্দিতে পটু হলেও আধো বাংলায় সে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে৷ ছোট্ট সৌরভকে দেখলেই আপনার হয়তো প্রথমে তাকে আদর করতে ইচ্ছে করবে৷ অনেকেই খুদে গাইডের নরম গাল টিপে দিচ্ছেন৷
গাইডের কাজ করে যৎসামান্য উপার্জিত অর্থ ভাগ করে দেয় নিজের সঙ্গীদের, কিছুটা বেশি অর্থ উপার্জন হলে সে তাঁর পড়াশোনার পিছনে তা ব্যয় করে ৷ পর্যটকদের দল দেখলেই সে ছুটে গিয়ে বলে, " ম্যায় সৌরভ রাজ, ম্যায় আপ লোগোকো ইহা পুরা ইলাকা ঘুমকে দিখায়েঙ্গে " মেরেকো সব মালুম ৷''
এর পর পাহাড়ের চড়াই উৎরোই পথ ধরে এগিয়ে যাওয়া আর এলাকা সম্বন্ধে অনর্গল তথ্য পেশ, কখনও হিন্দি, কখনও ইংরেজি | ঘোরাঘুরির শেষে কেউ খুশি বেশি টাকা দিতে গেলেও অবশ্য সৌরভ নেয় না৷
প্রকৃতি চুরি করা " রাজ্ " মানে পুষ্পা রাজ কারোর কাছে মাথা নতো না করলেও প্রকৃতিকে বাঁচাতে নামচি পোখরির সৌরভ রাজ্ কিছু সবসময় মাথা নিচু করেই থাকে ৷ নিশ্চিত করে বলা যায়, এখানে এলে আপনার সামনে সৌরভ না এলেও, পারলে একবার খোঁজ করে নেবেন সৌরভের, দেখা মিললেসাক্ষাৎ দেব দর্শন করবেন৷
কেউ ১০ টাকার চিপস বা ঠান্ডা পানীয় খেয়ে সেই প্লাস্টিক ফেলে আসতেই পারেন, কিন্তু পর্যটকরা চলে যাওয়ার পরেই সেখানে হাজির হয়ে যাবে নামচি পোখরির শিশু সৌরভ রাজ৷ না আপনাকে চমকাবে বা ধমকাবে, শুধু একটি মিষ্টি হেসে সে নিমেষেই পরিষ্কার করে দেবে এলাকা ৷