ভারতীয় বিমানবাহিনীকে প্রতিশ্রুত ৮৩টি তেজস এমকে ১এ জেট সরবরাহ না করার জন্য হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেডের (এইচএএল) সমালোচনা করেছেন এয়ার চিফ মার্শাল সিং। তিনি প্রশ্ন তোলেন কেন তারা এই প্রকল্পটিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে না এবং জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এই গা-ঢিলে দেওয়া মনোভাবের তীব্র নিন্দা করেছেন।
এখনও পর্যন্ত একটিও তেজস এমকে ১এ জেট বিমান সরবরাহ করা হয়নি। এছাড়াও, গত সপ্তাহে চণ্ডীগড়ে এক অবসর গ্রহণ অনুষ্ঠানে ৩৬টি মিগ-২১ যুদ্ধবিমান আর ব্যবহার করা হবে না জানানো হয়েছে।
advertisement
আরও পড়ুনঃ রণক্ষেত্র দিল্লি মেট্রোর কোচ, দুই মহিলায় ধুন্ধুমার, সিট সব খালি দেখে ঝগড়ার কারণ নিয়ে ধন্দে সবাই
এর ফলে প্রশ্ন ওঠে যে HAL কি এই সুযোগে এগিয়ে আসবে এবং তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করবে? কারণ এটি ভারতের নিরাপত্তার বিষয়।
গত সপ্তাহে ভারতীয় বিমানবাহিনী তাদের মিগ-২১ স্কোয়াড্রনগুলিকে অবসর দিয়েছে, যা ১৯৬০ সাল থেকে বিমানবাহিনীর মেরুদণ্ড ছিল কিন্তু এখন পুরনো এবং দুর্ঘটনাপ্রবণ হয়ে পড়েছে। ১৯৬৩ সালে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর থেকে ভারত কয়েক দশক ধরে ৮৭৪টি মিগ-২১ জেট ব্যবহার করেছে, যার মধ্যে ৬০ শতাংশেরও বেশি তৈরি করেছে এইচএএল।
১৯৭১ সালের যুদ্ধ থেকে শুরু করে কার্গিল সংঘাত, বালাকোট বিমান হামলা থেকে শুরু করে অপারেশন সিঁদুর পর্যন্ত, মিগ-২১ ভারতের জন্য একটি শক্তিশালী অস্ত্র হয়ে উঠেছে। কিন্তু এখন সেগুলি ইতিহাস।
আইএএফের অনুমোদিত শক্তি ৪২টি ফাইটার স্কোয়াড্রনের, কিন্তু বর্তমানে এটি মাত্র ২৯টি নিয়ে কাজ করছে, যার প্রতিটিতে ১৬ থেকে ১৮টি জেট রয়েছে। মিগ-২১-এর পর্যায়ক্রমে অবসর গ্রহণের ফলে এই ব্যবধান আরও বেড়েছে এবং প্রতিস্থাপনকারী বিমান সময়মতো পৌঁছাচ্ছে না।
২০২১ সাল থেকে HAL-এর কাছে ৮৩টি তেজস Mk 1A যুদ্ধবিমানের ৪৭,০০০ কোটি টাকার অর্ডার রয়েছে, কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনও জেট সরবরাহ করা হয়নি, যদিও সরবরাহ ২০২৪ সালে শুরু হওয়ার কথা ছিল এবং ২০২৮ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। বিমানবাহিনী দ্রুত এগুলি চায়, তবে এই ৮৩টি জেটের মধ্যে কেবল প্রথম দুটিই এই বছর আসতে পারে।
HAL-এর জন্য একটি প্রধান সমস্যা হল এই যুদ্ধবিমানের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের GE Aerospace থেকে ইঞ্জিন সংগ্রহ করা। তা কত দ্রুত সরবরাহ করা হবে সেটিই বাকি সব নির্ধারণ করবে।
এখনও পর্যন্ত মাত্র তিনটি ইঞ্জিন HAL-এ সরবরাহ করা হয়েছে, যার মধ্যে প্রথমটি মার্চ মাসে এসেছে। বিলম্বের প্রধান কারণ হিসেবে GE-এর ইঞ্জিন সরবরাহ শৃঙ্খলের সমস্যা উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে কাঠামো প্রস্তুত থাকবে, তবে ইঞ্জিনগুলি আসার পরেই কেবল সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
কিন্তু, সরকার কি অপেক্ষা করে থাকতে পারবে?
গত সপ্তাহে সরকার HAL-এর সঙ্গে আরেকটি মেগা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যার মধ্যে ৬৬,৫০০ কোটি টাকা মূল্যের ৯৭টি হালকা যুদ্ধ বিমান (LCA) Mk1A-এর আরও বড় অর্ডার রয়েছে। প্রতিরক্ষা পাবলিক সেক্টর আন্ডারটেকিং (PSU) এখন নির্ধারিত সময়ে IAF-কে ১৮০টি যুদ্ধবিমান সরবরাহ করার এবং উৎপাদন লাইন বাড়ানোর কাজ করছে।
এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ ভারত পাকিস্তানের চেয়ে পিছিয়ে থাকার সামর্থ্য রাখে না, কারণ ভারতের ২৯টির তুলনায় তাদের ২৫টি ফাইটার স্কোয়াড্রন রয়েছে। পাকিস্তান ৩৫ থেকে ৪০টি জে-৩৫ পঞ্চম প্রজন্মের জেট কেনার জন্য চিনের সঙ্গে একটি চুক্তিও স্বাক্ষর করেছে।
‘অপারেশন সিঁদুর’-এর প্রেক্ষাপটে, যেখানে যুদ্ধবিমানগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, ভারত আকাশে শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার গুরুত্ব বুঝেছে। পাকিস্তান এবং চিন উভয়ের কাছ থেকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলে ভারতের বিমানশক্তিতে কোনও ক্ষমতার অভাব থাকা চলবে না।
এই কারণেই সরকার HAL-এর সঙ্গে ৯৭টি LCA Mk1A-এর চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যার ডেলিভারি ২০২৭-২০২৮ সালে শুরু হবে এবং ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে চলবে। বিমানটিতে ৬৪ শতাংশেরও বেশি দেশীয় সামগ্রী থাকবে এবং ২০২১ সালের জানুয়ারিতে স্বাক্ষরিত পূর্ববর্তী LCA Mk1A চুক্তির বাইরেও ৬৭টি অতিরিক্ত আইটেম অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
UTTAM অ্যাক্টিভ ইলেকট্রনিকলি স্ক্যানড অ্যারে রাডার, স্বয়ম রক্ষা কবচ এবং কন্ট্রোল সারফেস অ্যাকচুয়েটরের মতো দেশীয় উন্নত সিস্টেমগুলি রাখা আত্মনির্ভরতার উদ্যোগগুলিকে আরও শক্তিশালী করবে।
কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি রয়েই গেল – জেটগুলি কি সময়মতো পৌঁছাবে?
মিগ-২১ বিমানগুলির অবসর গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে মনোযোগ সরে যায় Su-30MKI-এর দিকে, যা এখন ভারতীয় বিমানবাহিনীর মেরুদণ্ড, যেখানে প্রায় ২৭০টি বিমান রয়েছে। ভারতের কাছে ফরাসি রাফাল বিমানের দুটি স্কোয়াড্রনও রয়েছে- মোট ৩৬টি, যা এক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি প্রদান করে।
‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সময় যেমনটি দেখানো হয়েছিল, রাফাল সীমান্ত অতিক্রম না করেই দূরপাল্লার নির্ভুল হামলা চালাতে পারে। মিরাজ-২০০০, মিগ-২৯ এবং জাগুয়ারও দেশের অস্ত্রাগারের অংশ।
তবে বিদেশ থেকে কেনাকাটায় সময় লাগেই। ভারত সম্প্রতি ফ্রান্স থেকে ক্যারিয়ার পরিচালনার জন্য ২৬টি রাফালে-এম জেট কেনার অনুমোদন দিয়েছে, তবে ২০২৯ সালের আগে এগুলো আসবে না।
এরপর আছে AMCA — পঞ্চম প্রজন্মের, বহুমুখী, দ্বিগুণ ইঞ্জিন বিশিষ্ট স্টিলথ ফাইটার যা DRDO-এর অধীনে IAF-এর জন্য অ্যারোনটিক্যাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি (ADA) তৈরি করছে। ভারত এই বিমানটি কেবলমাত্র সরকারি খাতের মাধ্যমে নয় বরং বেসরকারি শিল্প অংশীদারিত্বের মাধ্যমে তৈরি করার লক্ষ্য নিয়েছে, অর্থাৎ HAL ডিফল্ট অংশীদার নয়।
অগাস্ট মাসে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং ঘোষণা করেছিলেন যে ভারত ফরাসি মহাকাশযান প্রধান সাফরানের সঙ্গে যৌথভাবে AMCA-এর জন্য উন্নত জেট ইঞ্জিন তৈরি করবে। কিন্তু এতে সময় লাগবে কারণ AMCA-এর পরিষেবা অন্তর্ভুক্তিতে সম্ভবত এক দশক সময় লাগবে।
এই সমস্ত কিছু HAL-এর দ্রুত সরবরাহের প্রয়োজনীয়তার উপর আরও জোর দেয়। তিনটি ইঞ্জিন এসেছে, এবং GE ২০২৬ সালের মার্চের মধ্যে আরও ১২টি সরবরাহ করবে বলে আশা করা হচ্ছে, যার মধ্যে ২০২৮ সালের মধ্যে মোট ৯৯টি ইঞ্জিন আসবে।
‘অপারেশন সিঁদুর’ দেখিয়েছে যে আধুনিক যুদ্ধ বিমান শক্তি এবং প্রযুক্তির উপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করে। পহেলগাঁও সন্ত্রাসী হামলার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ভারতীয় বিমানবাহিনী পাকিস্তানি ভূখণ্ডের গভীরে আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছিল, যা দেখিয়েছিল যে বিমানশক্তি কীভাবে দ্রুত এবং সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ নিতে পারে। রাডার সাইট, হ্যাঙ্গার এবং বিমান ঘাঁটিতে নির্ভুল হামলা দেখিয়েছে যে কীভাবে ক্যালিব্রেটেড বিমানশক্তি কোনও প্রতিপক্ষকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে সংঘাত না বাড়িয়ে শাস্তি দিতে পারে।
প্রতিকূল প্রতিবেশী রাষ্ট্রে শত্রুদের প্রতিহত করার জন্য ভারতের সর্বোচ্চ বিমানশক্তির প্রয়োজন। এগিয়ে যাওয়ার পথ হল স্বয়ংসম্পূর্ণতা এবং আত্মনির্ভরতা , তা সে যুদ্ধবিমান হোক বা জেট ইঞ্জিন। পাকিস্তান বা চিনের কাছে তুলনায় কম সুবিধা থাকা ভারত মেনে নিতে পারে না!