শুনলে চমকে উঠতে পারেন, রাতে খাওয়ার পর শুতে যাওয়ার সময় তিন তালাক বিধিতে একজন স্বামী তাঁর ঘুমন্ত স্ত্রীকে তালাক দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে চলে গিয়েছেন ৷ অন্য আরেকটি ঘটনায়, স্বামী তার স্ত্রীকে ফোন করে তিনবার তালাক বলায় তাদের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে ৷ দুটি ঘটনাই ঘটেছে মধ্যপ্রদেশের সাতনা জেলার নজিরাবাদ এলাকায় ৷
advertisement
মুসলিম শরিয়ত আইন অনুযায়ী, এই দুটি তালাকের ঘটনাই আইনসিদ্ধ ৷ মাত্র কয়েক মুহূর্তে, তিন শব্দের জোরে বিবাহিত থেকে বিবাহ-বিচ্ছিন্না ৷
এই দুই মহিলা যেখানে তালাকের পর থেকে দু’বেলা দু’মুঠো অন্নের জন্য লড়াই করে চলেছেন ওই দুই গৃহবধূ, সেখানে আবার বিয়ে করে রীতিমতো জমিয়ে সংসার করছেন ওই দুই পুরুষ ৷ এই ঘটনাকে সামনে রেখে, মুসলিম মহিলা সংগঠন এবং এক মহিলা সমাজসেবী আন্দোলন শুরু করবেন বলে জানিয়েছেন ৷ নিপীড়িত ওই দুই মহিলাকে ন্যায় দেওয়াই তাদের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য ৷
২০১৩ সালে ৭ জুলাই উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা সেলিম সৌদাগরের সঙ্গে বিয়ে হয় শাবানা নিশার ৷ বিয়ের এক বছর পরে হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে ওঠার পর শোনেন শাবানার স্বামী নাকি তাকে তালাক দিয়ে চলে গিয়েছেন ৷ হতভম্ব শাবানাকে তাঁর জা জানায়, সে যখন ঘুমোচ্ছিল তখন তাঁর স্বামী সেলিম তাঁকে তিন তালাক দিয়েছে ৷ মূহূর্তের মধ্যে অজান্তেই বিবাহিতা থেকে তালাকসুদা হয়ে যায় শাবানা ৷
সেই ঘটনার কথা বলতে গিয়ে আজও চোখের কোণ ভিজে ওঠে শাবানার ৷ বলেন, ‘আমি বলেছিলাম, এমন তালাক মানি না ৷ কোথাও যাব না স্বামীর ঘর ছেড়ে ৷ কিন্তু সেই শুনে আমার জা বলল, শরিয়তের আদেশ না মানা হারাম ৷ আর তার পরই আমাকে জোর করে ঘরের বাইরে বার করে দেয় ওরা ৷’’
প্রতিবন্ধী শাবানার একটি পা অকেজো ৷ তালাকের পর জীবনধারণের জন্য সেলাই মেশিনকেই আঁকড়ে ধরেন তিনি ৷ টুকটাক সেলাই করে যা রোজগার হয়, তাতে কোনওমতে আধপেটা খেয়ে জীবন চলে শাবানার ৷ কিন্তু এক রাতে স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার কয়েকদিন পরই ঘরে নতুন বউ এনে আরামে আছেন শাবানার ‘প্রাক্তন’ স্বামী সেলিম ৷
তিন তালাকের দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটেছে হতভাগ্য খুশবু বেগমের জীবনে ৷ ২০০৭-এর ৭ জুন এলাহাবাদের শাহ আলমের সঙ্গে খুশবুর বিয়ে হয় ৷ বিয়ের পরই শ্বশুরবাড়িতে শুরু হয় পণের জন্য অত্যাচার ৷ বাপের বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে আসার জন্য চাপ দিতে প্রতিদিন চলত মারধর আর গালিগালাজ ৷ এইসবের মাঝেই খুশবু আর শাহ আলমের একটি ছেলে হয় ৷ কিন্তু তাতেও কমেনি অত্যাচার ৷ একদিন জোর করে খুশবুকে বাপের বাড়িতে দিয়ে আসে আলম ৷ এর একদিন বাদেই খুশবুর মোবাইলে ফোন করে তাঁকে তিন তালাক দেয় তাঁর স্বামী আলম ৷
এখন নিজের তিনবছরের ছেলেকে মানুষ করার জন্য বাড়ি বাড়ি ঘর পরিষ্কার ও বাসন মাজার কাজ করেন খুশবু ৷ তাকে যখন প্রশ্ন করা হয়, কেন এই তালাক মেনে নিলেন খুশবু? তখন জবাব আসে, ‘তো না মেনে কি করব! সবাই বলে, স্বামী যখন তিনবার তালাক উচ্চারণ করেছেন, তার মানে তালাক হয়ে গিয়েছে ৷ মৌলানা সাহেবও বলেন, স্বামী তালাক বললেই তা মেনে নেওয়ার কথাই শরিয়তে লেখা আছে ৷ ফেসবুকে বলুক আর ফোনে বলুক, তালাক দিয়ে দিলেই ডিভোর্স ৷ ’ এই সমাজব্যবস্থার প্রতি ক্ষোভ খুশবুর গলায় স্পষ্ট ঝরে পড়ছিল ৷
শাবানা ও খুশবু দুজনের কথা কানে যেতেই মুসলিম সমাজসেবী ফহমিদা বেগম তাদের সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেন ৷ তিনি শাবানা ও খুশবু দুজনকেই পরামর্শ দেন যে, তাদের স্বামীরা মুসলিম শরিয়ত আইনের অপপ্রয়োগ করেছে ৷ এর বিরুদ্ধে তারা আদালতের সাহায্য চাইতে পারে ৷ এরপরই ফহমিদা বেগমের সাহায্য নিয়ে ভোপালের মহিলা সংগঠনকে চিঠি লিখে ন্যায় বিচারের আবেদন জানান ৷
ফহমিদা বেগমের মতে, ‘এই সব পুরুষেরা মুসলিম শরিয়ত আইনকে ছেলেখেলা বানিয়ে ফেলেছে ৷ শুধুমাত্র বিনা ঝামেলায় দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্য প্রথম স্ত্রীকে এরকমভাবে তালাক দিয়েছেন ৷ ঘুমন্ত স্ত্রীকে কী করে তালাক দেওয়া যায়! ফোনেই বা কিভাবে তালাক হয় ৷ এই তিন তালাক প্রথা বন্ধ হওয়া উচিত ৷’
শাবানা ও খুশবু, দু’জনেরই তালাকের ঘটনার ক্ষেত্রে সাতনা জেলা আদালতের শরিয়ত কানুন বিশেষজ্ঞ মকসুদ আহমেদের বক্তব্য, অজ্ঞতা ও সচেতনতার অভাবে মুসলিম মহিলারা নিজেদের অধিকার রক্ষার জন্য লড়াই করতে পারে না ৷
তিনি আরও জানান, শরিয়তে মহিলাদের যে অধিকার দেওয়া হয়েছে তা খুব কম মহিলাই জানেন ৷ তালাকে অসন্তুষ্ট মুসলিম মহিলারা এক্ষেত্রে আদালতের সাহায্য চাইতে পারেন এবং জীবনধারনের জন্য ওয়াকফ বোর্ড থেকে ভাতা-র জন্যে আবেদন করতে পারেন ৷ এমনকী, একজন তালাকসুদা মুসলিম মহিলা আবার বিয়ে না করা অবধি প্রাক্তন স্বামীর কাছে তাঁর ভরণপোষণের দাবী জানাতে পারেন ৷
মকসুদ আহমেদের মতে, শরিয়ত আইনের তালাক বিধি একটি সামাজিক ব্যবস্থা, যাকে সংবিধান ও আইন বৈধতা দিয়েছে ৷ কিন্তু তিন তালাক প্রথা বা শরিয়তের অন্য আইনে বদলের যে প্রচেষ্টা বর্তমানে শুরু হয়েছে তার সঙ্গে সহমত নন শরিয়ত কানুন বিশেষজ্ঞ মকসুদ আহমেদ ৷ এমনকী, জোর করে রাজনীতির নামে শরিয়তের আইন বদলানো হলে, পরিণাম যে ভালো হবে না, তার হুঁশিয়ারিও দেন তিনি ৷