স্কুলের গণ্ডি না পেরোনোর কারণে প্রতীক্ষাদেবীর কর্মজীবন শুরু হয় একজন সাফাইকর্মী হিসেবে। নিজের এবং সন্তানের জন্য সুস্থ জীবন-যাপনের সংকল্প নিয়ে প্রতীক্ষাদেবী কঠোর পরিশ্রমে নেমে পড়েন। প্রতীক্ষাদেবীর গল্প ভারতের পুরুষ-শাসিত ব্যাঙ্কিং সেক্টরে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। আমাদের দেশের পুরুষ-শাসিত সমাজে পরিবারের যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি সামাজিক নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজেকে তুলে ধরতে হলে মেয়েদের রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। প্রতীক্ষাদেবীর গল্পও তার ব্যতিক্রমী নয়।
advertisement
প্রতীক্ষাদেবীর জন্ম ১৯৬৪ সালে পুণেতে। দরিদ্র বাবা-মায়ের ঘরে জন্ম নেওয়া এই লড়াকু মেয়ের মাত্র ১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয় সদাশিব কাড়ুর (Sadashiv Kadu) সঙ্গে। তখনও তিনি স্কুলের দশম শ্রেণীও উত্তীর্ণ হননি। তাঁর স্বামী সদাশিব তখন মুম্বইতে থাকতেন, সেখানে এসবিআই-তে তিনি বুক বাইন্ডার হিসেবে কাজ করতেন। বিয়ের এক বছর পর যখন তাঁর প্রথম পুত্র বিনায়কের জন্ম হয় তখন নবজাতক পুত্রকে নিয়ে গ্রামে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। তখনও প্রতিক্ষাদেবী জানতেনই না খুব অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যেতে চলেছে। গ্রামে ফিরে যাওয়ার সময়ই পুরো পরিবার নিয়ে সদাশিব এক দুর্ঘটনার মধ্যে পড়েন এবং তিনি মারা যান। মাত্র ২০ বছর বয়সে ছেলেকে নিয়ে একা হয়ে পড়েন প্রতীক্ষাদেবী। অতীত দিনের কথা স্মরণ করে প্রতীক্ষাদেবী বলেন, ‘সেই সময়েই আমার স্বামীর অবশিষ্ট বেতন সংগ্রহ করতে আমাকে এসবিআই শাখায় যেতে হয়েছিল। কাজ তো নিতেই হত, কিন্তু যোগ্যতা না থাকায় আমি সামান্য একটা কাজ চেয়েছিলাম যাতে কোনও ভাবে বেঁচে থাকতে পারি।’
আরও পড়ুন : এ বার দিল্লিতে মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত এক নাইজেরীয়, এই রোগের ঘটনা দেশে বেড়ে হল ৬
সেখানেই তিনি সাফাইকর্মী হিসেবে চাকরিতে নেমে পড়েন। সকালে ব্যাঙ্কের এলাকা পরিষ্কার, শৌচাগার পরিষ্কার এবং আসবাবপত্র ধুয়ে দিয়ে দুই ঘন্টা কাজ করতেন। সর্বসাকুল্যে তখন তাঁর বেতন ছিল মাসে ৬০-৬৫ টাকা। সে সময়ই ধীরে ধীরে তিনি অফিসের কাজে আসক্ত হয়ে পড়েন। ব্যাঙ্কের নানা উচ্চতর কর্মীদের দেখে তিনিও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন একদিন তিনিও এঁদের মতোই সচ্ছল জীবন-যাপন করবেন। কয়েকজন ব্যাঙ্ক কর্মকর্তা এই নিয়ে তাঁকে সাহায্যও করেছিলেন, ফর্ম পূরণ করে দেওয়া, এক মাসের ছুটি দেওয়া ইত্যাদির বন্দোবস্ত করে প্রতীক্ষাদেবী দশম শ্রেণির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
প্রতীক্ষাদেবীর আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং সহকর্মীরাও তাঁকে নানা ভাবে সাহায্য করেন। কিন্তু লক্ষ্য তখনও অনেক দূরে। এরপর নিজের প্রচেষ্টাতেই দ্বাদশ শ্রেণীও পাশ করেন তিনি। সে সময়ের কথা মনে করে প্রতীক্ষাদেবী জানান, ‘তখন ছেলে এক প্যাকেট বিস্কুট খেতে চাইলেও আমাকে এক স্টপ আগে নেমে পড়তে হত টাকা বাঁচানোর জন্য। যেটুকু টাকা জমিয়েছিলাম তা দিয়ে দ্বাদশ শ্রেণী পাশ করার পর মুম্বইয়ের ভিক্রোলিতে একটি নাইট কলেজে ভর্তি হই।’ওই কলেজ থেকেই তিনি ১৯৯৫ সালে মনোবিজ্ঞানে স্নাতক হন। এরপরই তিনি ব্যাঙ্কে কেরানি হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘একজন মা হিসেবে আমার জন্য সব প্রতিকূলতাকে জয় করে নিজের পক্ষে অবস্থান নেওয়া, বিশেষ করে পড়াশোনা করা কঠিন ছিল।’
আরও পড়ুন : ৫০ বছর পর ফের পড়াশোনা শুরু করে ৬৮ বছরের বৃদ্ধা উত্তীর্ণ দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায়
১৯৯৩ সালে তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর স্বামী ছিলেন একজন ব্যাঙ্ক মেসেঞ্জার, তিনি প্রতীক্ষাদেবীকে বিভিন্ন ব্যাঙ্কিং পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করেছিলেন। তাঁদের দুই সন্তানকেও তাঁর স্বামী দেখাশোনার দায়িত্ব নেন। এরপর আর তাঁকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
২০০৪ সালে প্রতীক্ষাদেবী ট্রেইনি অফিসার হিসেবে ব্যাঙ্কে যোগ দেন। তারপরে বিভিন্ন অফিসারের গ্রেড অতিক্রম করে তিনি এজিএম পদে উন্নীত হন।
প্রতীক্ষাদেবীর অবসর গ্রহণের আর মাত্র দুই বছর বাকি। এসবিআইয়ের সঙ্গে প্রতীক্ষাদেবীর যাত্রাপথ ৩৭ বছরের, এযাবত কাল ধরে তাঁর অধ্যবসায়, দৃঢ়তা এবং আরও ভালো কাজ করার চেষ্টা অনুপ্রাণিত করেছে সকলকে।
২০২১ সালে তিনি ন্যাচেরোপ্যাথি কোর্সও সম্পন্ন করেছেন, ইচ্ছে রয়েছে অবসর গ্রহণের পরে তিনি এই নিয়েই কাজ করবেন। নিজের বিগত জীবনের কথা মনে করে জানান, ‘আমি যখনই পেছন ফিরে তাকাই তখনই অবিশ্বাস হয় এই দীর্ঘজীবন কীভাবে অতিক্রম করলাম! তবে শেষমেশ আমি পেরেছি। এরপর যখনই কেউ হতাশ হবেন আমি আমার জীবনের গল্প তাঁদের কাছে পৌঁছে দিতে চেষ্টা করব’।