চলতি বছরে এক দিকে যেমন মকর সংক্রান্তিতে পুণ্যস্নানের উন্মাদনা ছিল, তেমনই অন্য দিকে তা দেখা গিয়েছে ২৯ জানুয়ারি, ২০২৫ তারিখে মৌনী অমাবস্যাতেও। এই বিশেষ যোগে ব্রাহ্ম মুহূর্তে, সূর্য উদয়ের আগেই পুণ্য স্নানের রেওয়াজ। আর সেই পুণ্য মুহূর্তেই ঘটে গেল এই দুর্ঘটনা। যা নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে গুজব। তবে এখন এই দুর্ঘটনার নেপথ্য কারণ এবং হতাহতের সম্পূর্ণ পরিসংখ্যান স্পষ্ট করেছে প্রশাসন। বুধবার সন্ধ্যায় সাংবাদিক সম্মেলনে ডিআইজি বৈভব কৃষ্ণ জানান, এই দুর্ঘটনায় এখনও পর্যন্ত ৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছেন ৬০ জনেরও বেশি ভক্ত।
advertisement
প্রশাসনের দাবি, পরিস্থিতি এবং ভিড়ই এই দুর্ঘটনার নেপথ্য কারণ। ভক্তদের প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে এ হেন মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানান তিনি। বলেন, ভিড়ের অতিরিক্ত চাপের কারণে সেখানে বিশৃঙ্খলা ও পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তিনি বলেন, আহতদের সঙ্গে সঙ্গে নিকটবর্তী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে এবং প্রশাসন পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে। ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ডিআইজি মহাকুম্ভ বৈভব কৃষ্ণ বলেছেন যে আহতদের মধ্যে কয়েকজনকে তাঁদের পরিবারের সদস্যরাই হাসপাতালে তুলে নিয়ে গিয়েছেন, ৩৬ জন মেডিক্যাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছেন। বর্তমানে, ভক্তদের সুবিধার্থে হেল্পলাইন নম্বর 1920 জারি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে আহত ব্যক্তির সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য পাওয়া যাবে। ঘটনার প্রেক্ষিতে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ সমস্ত মহামণ্ডলেশ্বর, সাধু, আখড়াকে কিছু বিলম্বে পবিত্র স্নান সম্পন্ন করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তাঁরা সেই অনুরোধ রক্ষা করেছেন, এর পর নিরাপদে আখড়াগুলোর অমৃত স্নান সম্পন্ন হয়েছে।
ডিআইজি মহাকুম্ভ বৈভব কৃষ্ণ আরও বলেন, আখড়া ঘিরে এলাকার বিভিন্ন স্থানে ব্যারিকেড বসানো হয়েছে। ঘাট ও আখড়াগুলোতেও ব্যারিকেড রয়েছে। এই ব্যারিকেডগুলোর মধ্যে কয়েকটি পর পর সারিবদ্ধভাবে রয়েছে। দুর্ঘটনা এই জায়গা থেকেই ঘটে। রাত ১টা থেকে ২টো পর্যন্ত মৌনী অমাবস্যার স্নানে ভক্তদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। ভিড়ের প্রচণ্ড চাপের কারণে ব্যারিকেডগুলো ভেঙে যায়, যার ফলে মাটিতে শুয়ে থাকা বা বসে থাকা ভক্তরা পদপিষ্ট হন। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
প্রয়াগরাজে মহাকুম্ভ মেলা চলাকালীন এই ঘটনার পর প্রশাসন কড়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পুরো মেলা এলাকাকে নো ভেহিক্যাল জোন ঘোষণা করা হয়েছে। সেই মতো,
– ভিভিআইপি গাড়িতেও নিষেধাজ্ঞা বসেছে।
– ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ভিভিআইপি পাস বাতিল করা হয়েছে।
– ভিভিআইপি স্নান এবং এসকর্ট যানবাহন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
– এখন শুধু বাইক, অ্যাম্বুলেন্স, পৌর কর্পোরেশন ও ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি মেলা এলাকায় যেতে পারবে।
এর পাশাপাশি ৫টি বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য-
– সব রুট ওয়ানওয়ে করা হয়েছে, যাতে ভক্তরা এক রুট দিয়ে প্রবেশ করেন এবং স্নান সেরে অন্য রুট দিয়ে বের হন।
– প্রয়াগরাজ সংলগ্ন জেলাগুলো থেকে শহরে আসা চার চাকার গাড়ির প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
– ভক্তরা যাতে সহজে পায়ে হেঁটে যাতায়াত করতে পারেন, সেজন্য পুরো মেলা এলাকাকে নো ভেহিকল জোন ঘোষণা করা হয়েছে।
– নিরাপত্তার জন্য অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে যাতে কোনও বিশৃঙ্খলা না হয়।
– ভিড় সামাল দেওয়া আরও সুষ্ঠু করতে ব্যারিকেডিং এবং ডাইভারশন করা হয়েছে।
শুধু তাই নয়, প্রয়াগরাজে চলমান মহাকুম্ভ মেলা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে এবং ভক্তদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষ বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী অনেক গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ দিয়েছেন।
১. রেলস্টেশন এবং বাস স্ট্যান্ডে ক্রমবর্ধমান ভিড়ের পরিপ্রেক্ষিতে ভক্তদের নিরাপদে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে হবে, এটিই তাঁর প্রথম নির্দেশ। এডিজি এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে এই প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে প্রতিটি ভক্তকে তাঁদের গন্তব্যে নিরাপদে নিয়ে যাওয়া প্রশাসনের দায়িত্ব। রেলের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে ট্রেনের ক্রমাগত চলাচল নিশ্চিত করতে হবে। মানুষ যাতে সমস্যায় না পড়ে সেজন্য অতিরিক্ত বাসের ব্যবস্থাও করতে হবে।
২. মেলা এলাকায় ভিড়ের চাপ কমাতে সীমানায় হোল্ডিং এরিয়া সক্রিয় করতে হবে, হোল্ডিং এরিয়ায় আটকে থাকা লোকজনকে সময়মতো এগিয়ে যেতে দিতে হবে। প্রতিটি হোল্ডিং এলাকায় খাবার, পানীয় জল ও বিদ্যুতের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
৩. প্রয়াগরাজ সংলগ্ন সমস্ত জেলাগুলোতেও সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত বলে নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। গুরুত্বপূর্ণ রুটে যানচলাচল ব্যাহত করা উচিত নয় বলে মত তাঁর। সেই মতো অযোধ্যা-প্রয়াগরাজ, কানপুর-প্রয়াগরাজ, ফতেপুর-প্রয়াগরাজ, লখনউ-প্রতাপগড়-প্রয়াগরাজ, বারাণসী-প্রয়াগরাজ রুটে যান চলাচল মসৃণ রাখার নির্দেশ জারি হয়েছে। . টহল বাড়ানো হয়েছে যাতে কোনও ধরনের বাধার মুখে কাউকে না পড়তে হয়।
৪. মেলা এলাকাতেও যানচলাচলে মসৃণতা বজায় রাখতে হবে এবং কোনও অপ্রয়োজনীয় বাধা সৃষ্টি করা চলবে না। এর জন্য রাস্তার বিক্রেতাদের সংগঠিত স্থানে স্থানান্তরিত করা হবে যাতে জ্যাম সৃষ্টি না হয়। ভিড় নিয়ন্ত্রণে ব্যারিকেডিং ও মনিটরিং বাড়াতে হবে।
৫. ৩ ফেব্রুয়ারি বসন্ত পঞ্চমীর অমৃত স্নানের জন্য বিশেষ প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। মুখ্য সচিব এবং পুলিশ মহাপরিচালককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে মহাকুম্ভ মেলা পরিচালনার পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনার। নিরাপত্তা এবং সুবিধার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিটি বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া উচিত বলে জানিয়েছেন যোগী।
৬. মেলা পরিস্থিতি আরও উন্নত করার জন্য উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মোতায়েন করা হয়েছে। ২০১৯ সালের কুম্ভের সময়ে প্রয়াগরাজের বিভাগীয় কমিশনার এবং প্রাক্তন এডিএ ভিসি ভানু গোস্বামীকে বিশেষভাবে মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়াও ৫ জন বিশেষ সচিব স্তরের আধিকারিক এবং পুলিশ সুপার স্তরের আধিকারিকরাও ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রয়াগরাজে দায়িত্বে থাকবেন।
৭. বারাণসী, অযোধ্যা, চিত্রকূট এবং মির্জাপুরেও সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত, এই প্রধান তীর্থস্থানে ভিড় পরিচালনা এবং ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা উচিত। হোল্ডিং এলাকা তৈরি করতে হবে, ব্যারিকেড ব্যবহার করতে হবে এবং যথাযথ পার্কিং ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
বুধবার সকালে মহাকুম্ভে যখন ভক্ত ও সাধুরা পবিত্র স্নানের জন্য সঙ্গমের দিকে যাচ্ছিলেন তখনই পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনা ঘটে। হঠাৎ ভিড়ের কারণে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। অনেকে পবিত্র ত্রিবেণী সঙ্গমে পৌঁছনোর জন্য ব্যারিকেড ভেঙে দেন, যার ফলে অন্যদেরা পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনা ঘটে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে যে ভক্তদের এই নতুন নিয়মগুলি অনুসরণ করা উচিত এবং কোনও ধরনের গুজবে কান দেওয়া উচিত নয়।