TRENDING:

আধুনিকতা আর অবক্ষয়ের সংস্কৃতি ভুলে আজও বাংলায় চলছে গাজন উৎসব

Last Updated:

চৈত্র শেষের সোনালি আলো সবে মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে । ধীরে ধীরে সোনালি আভার সঙ্গে মিশতে শুরু করেছে কালো আধার । কোথা থেকে যেনে ভেসে আসছে ‘ঢ্যাং কুরা কুর’ ঢাকের আওয়াজ ।

impactshort
ইমপ্যাক্ট শর্টসলেটেস্ট খবরের জন্য
advertisement
#কলকাতা: চৈত্র শেষের সোনালি আলো সবে মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে । ধীরে ধীরে সোনালি আভার সঙ্গে মিশতে শুরু করেছে কালো আধার । কোথা থেকে যেনে ভেসে আসছে ‘ঢ্যাং কুরা কুর’ ঢাকের আওয়াজ । পুজো তো শেষ হয়েছে কবেই, এখন আবার ঢাকের বাদ্যি কেন ? মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্নরা ভিড়ে জমাতে শুরু করেছে ।
advertisement

আওয়াজটা কিন্তু ক্রমশই গাঢ় হচ্ছে । জানলা দিয়ে উঁকি মারতেই দেখা গেল কারা যেন বিভিন্ন রকম সেজে বাড়ির সামনে দিয়ে নাচতে নাচতে যাচ্ছে । সঙ্গে বাবা তারকনাথের চরণে সেবা লাগে...’ ধ্বনি ৷ ব্যাপারখানা কী ? দেখতেই হচ্ছে এবার ।

আরও পড়ুন: চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন নীল পুজোতে মাতেন সন্তানবতী হিন্দু নারীরা

advertisement

দলের একজনকে জিজ্ঞাসা করতে উত্তর এল, ‘আরে দাদা এ তো গাজন পুজোর সং নাচ’ । আরে হ্যাঁ সামনেই তো পয়লা বৈশাখে ৷ আর তার আগে চৈত্র্ মাসে গাজন উৎসবে মেতে উঠবেন ‘গাজন সন্ন্যাসীরা’ ৷ শহুরে চাল-চলনের দাপটে ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হতে চলেছে বাংলার কিছু পুরনো রীতি নীতি । তবে এই বিশেষ উ‍ৎসব এখনও জিইয়ে রয়েছে এ রাজ্যের কোথাও কোথাও ৷ বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে মিলে মিশে রয়েছে এমন ধরনের বহু উৎসব ৷ একটা নতুন বাংলা বছর শুরু হয় আরেকটা পুরনো বাংলা বছরের চলে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে ৷ আর সেই বাংলা বছরের শেষ উৎসব হল ‘গাজন’ ৷

advertisement

যা কিনা প্রকৃত অর্থেই একটা মিলনের উৎসব ৷ থাকে না কোনও জাতপাতের ভেদাভেদ ৷ সামাজিক কৌলীন্য ভেঙে যে কেউ এই উৎসবে সামিল হতে পারেন।

‘গাজন’ উৎসবটি মূলত মহাদেবকে তুষ্ট করতেই করা হয় ৷ তবে আরও একটি মতে ধর্মরাজের পুজোও হয় এ সময় ৷ এই দুইয়ের আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যেও প্রচুর মিল আছে। এই উৎসবের সূত্রপাত নিয়ে বহুমত প্রচলিত রয়েছে।

advertisement

আরও পড়ুন: দ্বারকেশ্বর নদীর পাশে এক্তেশ্বরের মেলায় ভিড় জমান বহু মানুষ

‘গাজন’ শব্দটির উৎপত্তি গর্জন থেকে ৷ অনেকে মনে করেন সন্ন্যাসীদের হুঙ্কার রব শিবসাধনায় গাজন রূপেই প্রচলিত। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে প্রকৃতিখণ্ডে উল্লেখ মেলে ‘‘চৈত্র মাস্যথ মাঘেবা যোহর্চ্চয়েৎ শঙ্করব্রতী। করোতি নর্ত্তনং ভক্ত্যা বেত্রবানি দিবাশিনম্।। মাসং বাপ্যর্দ্ধমাসং বা দশ সপ্তদিনানি বা। দিনমানং যুগং সোহপি শিবলোক মহীয়তে।।’’ এর অর্থ হল-চৈত্রে কিংবা মাঘে এক-সাত দশ-পনেরো কিংবা তিরিশ দিন হাতে বেতের লাঠি নিয়ে শিবব্রতী হয়ে নৃত্য ইত্যাদি করলে মানুষের শিবলোক প্রাপ্ত হয়। পুরাণের এই উল্লেখ চড়ক কিংবা গাজন উৎসব রূপে পালিত হয়। আবার কারও মতে গাজন উৎসবে রয়েছে বৌদ্ধ প্রভাব। তেমনই বাংলার মঙ্গলকাব্যেও গাজনের উল্লেখ মেলে। যেমন-ধর্মমঙ্গল কাব্যে উল্লেখ মেলে রানি রঞ্জাবতী ধর্মকে তুষ্ট করতে গাজন পালন করেছিলেন।

advertisement

গাজন উৎসবের সূচনা নিয়ে লোককথায় শোনা যায় নানা কাহিনি। শোনা যায়, বান রাজা ছিলেন শিবভক্ত। তিনি শিবকে তুষ্ট করতে কৃচ্ছ্বসাধনের মধ্য দিয়ে তপস্যা করেছিলেন। শিবভক্তির সেই সূত্র ধরেই চড়কের সন্ন্যাসীরা আজও বান ফোঁড়ান, নানা ধরনের ঝাঁপ দেন। গাজনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে আছে নানা প্রকার কৃচ্ছ্বসাধন। যেমন আগুনঝাঁপ, কাঁটাঝাঁপ, বঁটিঝাঁপ, ঝুলঝাঁপ, বানফোঁড়া, কপালফোঁড়া ইত্যাদি। সম্প্রদায় ভেদে কোথাও কোথাও কালাগ্নিরুদ্রের আরাধনাও করা হয়। বাংলার কোনও কোনও অঞ্চলে গাজনে নরমুণ্ড নিয়ে নৃত্যের প্রচলন দেখা যায়।

এক সময় চড়ক প্রথাটিকেই অমানুষিক আখ্যা দিয়েছিল খ্রিস্টান মিশনারিরা। ১৮৬৩ থেকে ১৮৬৫-র মধ্যে ছোটলাট বিডন এই প্রথা রোধ করেছিলেন। শোনা যায়, সেই থেকেই সন্ন্যাসীরা চড়কগাছে পাক খেতে পিঠে গামছা বেঁধে উঠতে শুরু করে। সে কালের কাঁসারিপাড়ায়, কাঁসারিরা সং বের করতো। অশ্লীলতার দায়ে এক সময় তা-ও বন্ধ হয়ে যায়।

আধুনিকতা আর অবক্ষয় সংস্কৃতিতে যতই গ্রাস করুক না কেন, গ্রামবাংলায় আজও দেখা যায় গাজনের বৈচিত্রপূর্ণ ছবি। চৈত্রের শুরু থেকেই ধ্বনিত হয় ‘বাবা তারকনাথের চরণে সেবা লাগে...’। এই সময় অন্ত্যজ শ্রেণির নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সন্ন্যাস পালন করেন। কেউ কেউ আবার শিব-পার্বতী সেজে হাতে ভিক্ষা পাত্র নিয়ে বের হন। সারাদিন বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে আতপচাল, রাঙালু, কাঁচাআম, কাঁচকলা এবং অর্থ সংগ্রহ করে সন্ধ্যায় তাঁরা পাক করা অন্ন গ্রহণ করেন।

গাজন উৎসবের মূলত তিনটি অংশ— ঘাট-সন্ন্যাস, নীলব্রত ও চড়ক। আগে মূলত চৈত্রের প্রথম দিন থেকেই ভক্তরা সন্ন্যাস পালন করতেন। এখন কেউ চৈত্র সংক্রান্তির সাত দিন আগে, কেউ বা তিন দিন আগে থেকে কঠোর নিয়ম পালন করেন। সন্ন্যাস পালন করা হয় বলে গেরুয়া বস্ত্র ধারণ, হবিষ্যি গ্রহণ আবশ্যিক। একটি দলের মধ্যে এক জন মূল সন্ন্যাসী এবং এক জন শেষ সন্ন্যাসী রূপে গণ্য হন। উৎসবে এই দু’জনেরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। বাংলার এক এক প্রান্তে দেখা যায় গাজনের আঞ্চলিক বৈচিত্র।

যেমন মুখোশ নৃত্য আর সং সাজার প্রচলন। মুখোশ নৃত্যের প্রচলন দেখা যায় বর্ধমান, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, নদিয়া, বীরভূম জেলাগুলিতে। প্রথা অনুসারে পূজারীর কাছ থেকে শিবের পুজোর ফুল গ্রহণ করে প্রতীকী শিবলিঙ্গ মাথায় করে ঢাক ঢোল কাঁসর বাজিয়ে পরিক্রমায় বের হন ব্রতধারী সন্ন্যসীরা। এ ছাড়াও মুখোশ নৃত্যে ফুটে ওঠে পৌরাণিক নানা চরিত্র, দেব-দেবী, রাক্ষস, এমনকী পশুদের রূপও। এ ছাড়াও হয় কালী সেজে, মুখোশ পরে এক ধরনের নাচ, যাকে বলা হয় ‘কালীনাচ’।

গাজনের পরের দিন পালিত হয় নীল পুজো। গ্রামবাংলার মহিলারা সন্তানের মঙ্গল কামনায় এ দিন গাজনের সন্ন্যাসীদের ফল, আতপচাল, ও অর্থ দান করেন। চৈত্রের শেষ দিনে উদ্‌যাপিত হয় চড়ক উৎসব। এই উৎসবেরও বেশ কিছু নিয়ম আছে। যেমন, চড়ক গাছটিকে শিবমন্দিরের কাছের কোনও পুকুরে ডুবিয়ে রাখা হয়। সন্ন্যাসী সেটিকে তুলে আনেন গাজনতলায়। তার পরে চড়কগাছ পুজো করে তা চড়কতলায় পোঁতা হয়। এর পরে শুরু হয় মূল চড়কের অনুষ্ঠান। প্রকাণ্ড কাষ্ঠদণ্ডের উপরে অনেকটা উঁচুতে আংটায় ঝুলে থাকা জনা দু’য়েক সন্ন্যাসীর ক্রমাগত ঘুরপাক খাওয়ার পরিচিত দৃশ্য। ঘুরপাক খেতে খেতে আচমকাই ঝুলে থাকা সেই দুই সন্ন্যাসী নীচে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের উদ্দেশে ছুড়ে দিচ্ছেন বেল, কাঁচা আম ইত্যাদি ফল। সেই ফল কে ধরবে সেই নিয়ে শুরু হয় হুড়োহুড়ি, ধাক্কাকাক্কি। সেই ফল হাতে ধরা নাকি ভাগ্যের ব্যাপার! এমনটাই বিশ্বাস মানুষের।

সেরা ভিডিও

আরও দেখুন
শীতের মরশুম এলেই গৃহবধূদের উপরি রোজগার! সংসার সামলে ছুটছেন মোয়ার দোকানে
আরও দেখুন

ছবি : দেবমাল্য দাস ৷

Click here to add News18 as your preferred news source on Google.
দেশের সব লেটেস্ট খবর ( National News in Bengali ) এবং বিদেশের সব খবর ( World News in Bengali ) পান নিউজ 18 বাংলায় ৷ দেখুন ব্রেকিং নিউজ এবং টপ হেডলাইন নিউজ 18 বাংলার লাইভ টিভিতে ৷ ডাউনলোড করুন নিউজ 18 বাংলার অ্যাপ অ্যান্ড্রয়েড এবং আইওএস-এ ৷ News18 Bangla-কে গুগলে ফলো করতে ক্লিক করুন এখানে ৷
বাংলা খবর/ খবর/দেশ/
আধুনিকতা আর অবক্ষয়ের সংস্কৃতি ভুলে আজও বাংলায় চলছে গাজন উৎসব