তুলসিবাবুর মতো সখাহীন হতে হয়নি অসমঞ্জবাবুকে৷ তাঁর ভুটিয়া কুকুর ব্রাউনিকে পালন করা বিশেষ খরচসাপেক্ষ ছিল না৷ হাসিখুশি ব্রাউনির মতো স্বল্পে সন্তুষ্ট ছিলেন তার মালিকও৷ তাই ধনকুবের আমেরিকান সাহেবের কাছে ব্রাউনির হাসি বিক্রি করার লোভনীয় প্রস্তাব তিনি হেলায় উড়িয়ে দিতে পারেন৷ তাঁর নিঃসঙ্গ নিস্তরঙ্গ জীবনে পোষা কুকুরছানার অলৌকিক হাসি বিলাসিতার অবলম্বন নয়৷ বরং দিনের শেষে বাড়িতে ফিরে প্রিয়জনের সান্নিধ্য৷ প্রিয়জনকে কাছে পাওয়ার এই আকাঙ্ক্ষা থেকে যায় মৃত্যুর পরও৷ তাই ব্যাঙ্গালোরে সাহেব স্কুলমাস্টারের পরিত্যক্ত বাংলোয় আজও ফিরে আসে অশরীরী সাইমন৷ ফায়ারপ্লেসের পাশে তার প্রিয় কেদারায় কুণ্ডলী পাকিয়ে বসতে৷ পরপার থেকে ফিরে আসেন ব্রাউন সাহেবও৷ আজও তাদের খুনসুটি জমে ওঠে৷ ঠিক যেমন জমে উঠত উনিশ শতকের ঔপনেবেশিক সন্ধ্যাগুলোয়৷ মালিক এবং পোষ্য বিড়াল-দুজনেরই বয়স থমকে আছে একই জায়গায়৷ ব্রাউন সাহেবের বাড়ির নামের মতো তারাও ‘এভারগ্রিন’৷
advertisement
ব্রিটিশ সাহেবদের পোষ্যপ্রেমের সুতোয় বাঁধা পড়ে ব্যাঙ্গালোর থেকে বীরভূম৷ সেখানে আবার ব্রিটিশ আমলের নীলকুঠি থেকে হওয়া ডাকবাংলোয় ফিরে আসেন এক অত্যাচারী নীলকর সাহেব৷ উনিশ শতকে দোর্দণ্ডপ্রতাপ ওই সাহেবের নির্যাতনে নাভিশ্বাস উঠেছিল গ্রামবাসীদের৷ এদিকে তীব্র আন্দোলনে ক্রমশ কোণঠাসা হচ্ছিল নীলচাষ৷ সেইসঙ্গে ম্যালেরিয়ার সাঁড়াশি আক্রমণ। পূর্বাভাস বুঝতে পেরে নীলকর সাহেব আত্মঘাতী হন৷ গ্রামবাসীদের হাতে পর্যুদস্ত হতে হবে-এটা তিনি মেনে নিতে পারেননি৷ নিজেকে শেষ করার আগে সেরেছিলেন আরও একটা দরকারি কাজ৷ গুলি করে চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে দেন পোষা কুকুর রেক্স-কে৷ কারণ তিনি জানতেন তাঁর অবর্তমানে এই বিলিতি হাউন্ডকেও বাঁচতে দেবে না গ্রামবাসীদের রোষ৷ গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত অবাক চোখে সাহেবের দিকে তাকিয়ে ছিল প্রভুভক্ত রেক্স৷ নির্মম অত্যাচারকারী নীলকর সাহেবও কী পরম স্নেহে ভাবতে পারেন প্রবাসে তাঁর একমাত্র সঙ্গী পোষা চতুষ্পদের কথা৷
খাঁটি ব্রিটিশ সাহেব হোক বা রাজস্থানের ভরতপুরের সাধুবাবা ইমলিবাবা-পোষা প্রাণীর সঙ্গে তার পালকের ভালবাসা মাপার কোনও নির্দিষ্ট একক নেই৷ যে তীব্রতায় তিনি বিষধর কালকেউটেকে পোষ মানিয়ে ‘বালকিষণ’ নাম দেন, ঠিক সেই গাঢ় প্রতিহিংসাতেই পোষ্যের হত্যাকারীকে চরম শাস্তি দেন৷ তাঁর শাপে শেষ পর্যন্ত সাপে রূপান্তরিত হন ধূর্জটিবাবু৷ অন্ধবিশ্বাস নয়, স্রষ্টার মুনসিয়ানায় এখানে মন ছুঁয়ে যায় সাপের মতো ভয়ঙ্কর সরীসৃপের প্রতি মানবিকতাই৷ সাপ যে দর্শনমাত্রই নিধনযোগ্য নয়, বরং তারও যে কাঠপিঁপড়ের কামড়ে যন্ত্রণা হয়, সেকথাই শিখিয়ে যান ‘খগম’-এর ইমলিবাবা৷
কিন্তু পিঁপড়েও কি শুধুই দংশনে জ্বালা ধরায়? সে নিজেও তো যন্ত্রণায় পিষ্ট হয় অনবরত৷ যখন মানুষ নির্দ্বিধায় তাদের মারিয়ে চলে যায়৷ কিংবা খেলার ছলে ভেঙে তাদের বাসা৷ সে কথাটাই অন্য কাউকে বোঝাতে পারে না সদানন্দ৷ তার খুদে জগতের বাসিন্দা হল পিঁপড়ের দল৷ তাদের যন্ত্রণাবিদ্ধ চিৎকারে রক্তাক্ত হয় সদানন্দর অপাপবিদ্ধ কিশোর মন৷ সদানন্দর মতো সমস্যা সুজনেরও৷ সদানন্দ পিঁপড়ের কথাবার্তা, হাসিকান্না শুনতে পায়৷ আর সুজন পাখি-সহ সবরকম পশুর ডাক ডাকতে পারে৷ সে হরবোলা৷ লেখাপড়ায় তার মন নেই৷ পাঠশালায় গিয়ে শেখে পাশের পুকুরে চড়তে আসা হাঁসের দলের ডাক৷ বইয়ের পড়ায় ব্যর্থ হলেও প্রকৃতিপাঠের আসরে তার মতো ভাল ছাত্র আর একজনও নেই৷
সুজন তো হরবোলা হয়েই বিদূষী রাজকন্যার বরমাল্যবিজয়ী হতে পেরেছিল৷ কারান্ডিকার কিন্তু কোনও রাজকন্যার পাণিপ্রার্থী হননি৷ তিনি তাঁর বাধ্য ছাত্র সুলতানের মতোই একা৷ সুজনের মতোই অল্প বয়সে ঘর ছেড়েছিলেন তিনিও৷ কর্নেল সুরেশ বিশ্বাসকে আদর্শ করে জীবনের পথে ট্র্যাপিজ খেলতে খেলতে বাঘ প্রশিক্ষক হিসেবে থিতু হন গ্রেট ম্যাজেস্টিক সার্কাসে৷ সার্কাসের রিং-এ রয়্যাল বেঙ্গল বাঘ সুলতানের হাঁ মুখে অবলীলায় ঢুকিয়ে দেন নিজের মাথা৷ সেইসঙ্গে জলাঞ্জলি দেন নামী আইনজীবী মহেশ চৌধুরীর ছেলে বীরেন্দ্র চৌধুরীর পরিচয়ও৷ রিং মাস্টার কারান্ডিকারের কাছে বহুমূল্য স্ট্যাম্প অ্যালবামের থেকেও দামি হল সন্তানসম সুলতানের প্রাণরক্ষা৷
সেই সার্কাসও নেই৷ সেই পশুপ্রাণীর খেলাও সেখানে নেই৷ তবে আজও বহাল তবিয়তে আছে পাখি পোষার শখ৷ তাই খুদে অনিরুদ্ধকে খাঁচাবন্দি চন্দনা কিনে দেন তার বাবা৷ কিন্তু সার্কাসের বাঘ সুলতানের মতো সেই চন্দনাও একদিন খোয়া গেল৷ বলা ভাল, তাকে চুরি করা হয়েছিল৷ সেই চন্দনা উধাওকে ক্লু করেই ফেলুদা উদ্ধার করে খোয়া যাওয়া দুষ্প্রাপ্য নেপোলিয়নের চিঠি৷ পাওয়া যায় ‘সাধু সাবধান’ বলা চন্দনা পাখিকেও৷ কিন্তু এ চন্দনার মতো ভাল কপাল ছিল না ঘুরঘুটিয়ার টিয়ার৷ শুধু তো ‘সাধু সাবধান’-এর মতো সহজ শব্দবন্ধ নয়৷ সে মনে রেখেছিল ‘ত্রিনয়ন ত্রিনয়ন একটু জিরোও’-এর মতো কঠিন পাসওয়ার্ড৷ এই বুলিই যেন কাল হল৷ টিয়ার মালিক কালীকিঙ্কর মজুমদারকে খুন হতে হল৷ গল্পের শেষে ফেলুদা যখন নকল কালীকিঙ্করের কাছ থেকে নেওয়া দামি ও দুষ্প্রাপ্য গোয়েন্দা বই ফেরত দিয়ে আসছে, তখনও বেচারি পাখি ফাঁকা বাড়িতে দাঁড়ে বসে সেই ত্রিনয়নকে একটু জিরোতে বলছে৷
এভাবেই পালকের অবর্তমানে পোষ্য এবং পোষ্যর অনুপস্থিতিতে তার মালিক অসহায় হয়ে পড়ে৷ এই ভাবনা থেকেই পোষা বিড়াল নিউটনকে নিজের সঙ্গে ব্যোমযাত্রী করে নিয়েছিলেন প্রোফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু৷ শেষ অভিযানে মহাশূন্যের পথে হারিয়ে যাওয়ার সময়ও তিনি নিজেকে প্রাণপ্রিয় নিউটনের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেননি৷ কারণ তর্কে বহুদূর হলেও মনের এই বন্ধন ছাপিয়ে যায় জন্মান্তরের পরাবাস্তব সীমানাকেও৷ তাই রাজস্থানি মণিকারের ছেলে সাড়ে সাতশো বছর পর কলকাতার ছাপোষা বইবিক্রেতার ছেলে হয়েও বুঝতে পারে নিরপরাধ ময়ূরের দিকে পিস্তল তাক করা ডক্টর হাজরা আসলে ‘দুষ্টু লোক’৷ তখনই বিশ্বাস ভঙ্গ হয় তার৷ আর সুকুমারপুত্রের কলমে আমাদের বিশ্বাস তৈরি হয়৷ যে, নিশ্চয়ই প্রতি পূর্ণিমার রাতে বিষ্ণুরাম দাসের সাদা ঘোড়া রূপান্তরিত হয় রূপকথার পক্ষীরাজ ঘোড়ায়৷ তার পিঠে চেপেই গোলাপিবাবুর সঙ্গে আমরা পাড়ি দিই অন্তহীন ভালবাসার পথে৷
( সব ছবি : সত্যজিৎ রায়ের আঁকা প্রকাশিত বিভিন্ন স্কেচ থেকে সংগৃহীত)