দেখুন, শীতকালে আবহাওয়া পরিবর্তনের সময় মরশুমি অসুখ (seasonal disease) প্রতি বছরই কমবেশি হয়৷ এ সময় মানিয়ে নিতে অনেকেরই সমস্যা হয়৷ এ বছর ছবিটা অবশ্য আলাদা৷ এর কারণ হতে পারে গত প্রায় দু’ বছর আমরা করোনা ভাইরাস (coronavirus) নিয়ে স্ট্রাগল করছি৷ তার একটা প্রভাব থাকতে পারে৷ তাছাড়া ভাইরাল ইনফেকশনে খুব মিউটেশন হয়-অ্যান্টিজেনিক শিফ্ট, অ্যান্টিজেনিক ড্রিফ্ট৷ যেটা ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনে হয় না৷ সেক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনে (bacterial infection) আমরা সংক্রমণের ধরণ বা তীব্রতা হয়তো আগে থেকেই আঁচ করতে পারি৷
advertisement
আর ভাইরাল ইনফেকশনের ক্ষেত্রে?
ভাইরাল ইনফেকশনের ক্ষেত্রে অনেক বেশি মিউটেশন (mutation of virus) পর্যায় চলে৷ ফলে এক বছরের থেকে অন্য বছরে সংক্রমণের তীব্রতা, ধরন বা কত ঘন ঘন সংক্রমণ হচ্ছে-সেটা পাল্টে যায়৷ আমার মনে হয় সেই পরিবর্তনের ফলে এ বার ইনফেক্টিভিটি রেট অনেক বেড়ে গিয়েছে৷ সংক্রমণ অনেক দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে৷
এই পরিস্থিতিতে বাচ্চাদের কীভাবে ভাল রাখব? আগে আমরা বলতাম স্কুল থেকে সংক্রমিত হয়ে ফিরেছে৷ কিন্তু এখন তো দু’ বছর হতে চলল অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বাচ্চারা ঘরবন্দি৷ ঘরে বসে থেকেই জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে৷ কীভাবে ওদের ভাল রাখব?
এখন আমাদের মূল করণীয় হল, সংক্রমণ থেকে বাচ্চাদের দূরে রাখা৷ বাড়িতে বড়রা সংক্রমিত হলে তাঁরা বাচ্চাদের থেকে দূরে থাকুন৷ হাঁচি বা কাশির সময় রুমালে মুখ ঢেকে রাখুন৷ খুব ভাল হয় সংক্রমণের পরে যদি বাড়িতেও বড়রা মাস্ক পরে থাকতে পারেন৷ কোভিড পজিটিভ কিনা, সেটা জানার আগে থেকেই সর্দিকাশি হলে বাচ্চার সামনে মাস্ক পরুন৷ বাচ্চার যিনি মূল কেয়ার গিভার, তিনি যেন সংক্রমিত না হন, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে (guidelines for keeping children healthy)৷
আরও পড়ুন : আপনার সন্তান ১৫-১৮ বছর বয়সি? জেনে নিন টিকা নেওয়ার জন্য কী কী করতে হবে
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বাচ্চাদের ডায়েট কীরকম হবে?
বাইরের খাবার একদমই নয়৷ বাড়িতে তৈরি কম মশলার খাবার বাচ্চাকে দিন৷ ডায়েটে রাখুন জিঙ্ক, ভিটামিন এ, ভিটামিন বি, ভিটামিন সি এবং ভিটামিন ডি৷ বাচ্চা যেন দুধ খায় রোজ৷ মরশুমি শাকসব্জির মধ্যে দিন গাজর, পেঁপে, বিনস, পালংশাক এবং প্রচুর কমলালেবু ও মুসম্বি৷ খুব ভাল হয় যদি সকালে ছোট কয়েক টুকরো আমলকি খেতে পারে (immunity power)৷
প্রথম থেকেই একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল যে তৃতীয় তরঙ্গে নাকি বাচ্চারা বেশি করোনা আক্রান্ত হবে৷ এখন ওমিক্রনের দাপটে কি ওই একই কথা বলা যাবে?
এই ভাইরাসের এত ঘন ঘন চরিত্রবদল হচ্ছে যে আগে থেকে কোনও কিছুই অনুমান করা অনুচিত৷ করোনার প্রথম দিকে কিন্তু আমরা দেখেছি বাচ্চাদের আক্রান্ত হওয়ার হার কম৷ কারণ ‘এ টি রিসেপ্টর’ যা দিয়ে মূলত করোনা ভাইরাস আমাদের শরীরে প্রবেশ করে, সেটি বাচ্চাদের ক্ষেত্রে কম৷ বড়দের বেশি৷ তবে গত দু’ সপ্তাহ ধরে কিন্তু বাচ্চাদের মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা সত্যি বেশি৷ হয়তো সংক্রমণের তীব্রতা কম, কিন্তু হার অনেক বেশি৷
আরও পড়ুন : ওমিক্রন আবহে সুরক্ষিত রাখতে চান আপনার সন্তানকে? ওকে দিন সহজ এই আয়ুর্বেদিক টোটকা
বাচ্চাদের জ্বর হলে কী করব?
প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনও ওষুধ দেবেন না নিজের থেকে৷ প্রচুর জল খাওয়ান৷ স্বাস্থ্যকর খাবার দিন৷ এভাবে দু’দিন দেখুন৷ তার পরও জ্বর ও অন্যান্য উপসর্গ না কমলে বা পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন৷ তবে এটা ১০-১২ বছর বয়সি বাচ্চাদের ক্ষেত্রে৷ সদ্যোজাতদের বা ১০ বছরের কম বাচ্চার ক্ষেত্রে কিন্তু অপেক্ষা করবেন না৷ জ্বর এলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন৷
বাচ্চাদের ক্ষেত্রে কোন কোন উপসর্গ উদ্বেগজনক?
যদি জ্বর বেশি আসে বা প্যারাসিটামল দিয়েও জ্বর না কমে তাহলে চিকিৎসকের কাছে যান৷ সেইসঙ্গে অতিরিক্ত ঘাম, ত্বকে সংক্রমণ, ডিহাইড্রেশন, প্রস্রাব কমে যাওয়া-এই উপসর্গগুলি দেখলে সতর্ক হোন৷ এটা এমন একটা সময় অনেক রকম ভাইরাল ইনফেকশন চলছে৷ ডেঙ্গুর প্রকোপও কিন্তু এখনও রয়েছে৷ ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডেঙ্গু এমনকি কোভিডের উপসর্গও কিন্তু কমবেশি একইরকম৷
আরও পড়ুন : ওমিক্রনের দাপটে সুস্থ থাকতে খাদ্যতালিকায় যে যে খাবার সম্পূর্ণ না থাকলেই ভাল
এ বার কি উপসর্গে কোনও পরিবর্তন এসেছে?
এ বার সাঙ্ঘাতিক গায়ে হাত পায়ে যন্ত্রণা হচ্ছে৷ যেন ত্বকের উপর হাত রাখলেও ব্যথা করছে৷ ১০-১২ বছর বয়সি বাচ্চারা এরকম উপসর্গ নিজেরাই মুখে বলছে৷
শীতকালে বা জ্বরের সময় বাচ্চাদের স্নান করানো নিয়ে আমাদের সব সময়ই দ্বন্দ্ব চলে৷ স্নান কি করানো উচিত?
অবশ্যই উচিত৷ ঈষদুষ্ণ জলে স্নান করান৷ জ্বর বেশি হলেও আমরা স্পঞ্জিং-এর কথা বলি৷ খুব সমস্যা না হলে শীতে স্নান করানোতে কোনও অসুবিধে নেই৷
সদ্যোজাত বাচ্চাদের কীভাবে ভাল রাখব? তারা তো মুখে কিছু বলতেও পারবে না৷
সাধারণত সদ্যোজাত শিশুর সবথেকে কাছে থাকেন তার মা৷ তাই মাকে সবার আগে সতর্ক হতে হবে৷ মা যদি করোনা সংক্রমিত হন, স্তন্যপান করানোর ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ এখনও অবধি গাইডলাইনে নেই৷ তবে হাত ধুয়ে, পাতলা কাপড়ে শিশুকে ঢেকে তবেই স্তন্যপান করাবেন৷ মা সংক্রমিত হলে অবশ্যই মাস্ক পরবেন৷ কোভিড পজিটিভ না হয়ে সাধারণ সর্দিকাশি হলেও মাস্ক পরতে হবে৷ তার পরও শিশুর সংক্রমণ হলে অবিলম্বে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান৷
নতুন যাঁরা মা হয়েছেন তাঁরা টিকা নেবেন তো?
অবশ্যই৷ যাঁরা স্তন্যপান করাচ্ছেন তাঁরা কোভিড টিকা নিতে পারেন৷ অন্তঃসত্ত্বারাও এই টিকা নিন৷ আপনার সন্তানের কথা ভেবে৷
১৫ থেকে ১৮ বছর বয়স অবধি বাচ্চাদের টিকা দেওয়া নিয়েও কোনও দ্বিধা করব না তো?
কোনও দ্বিধা নয়৷ টিকার গুরুত্ব আমরা বুঝেছি কোভিড পর্বে৷ বাচ্চাদের টিকা দেওয়ান৷ টিকা দেওয়ার পর হয়তো সামান্য জ্বর বা অন্য উপসর্গ আসতে পারে৷ তাতে চিন্তার কিছু নেই৷ আর সিনিয়র সিটিজেনরাও বুস্টার ডোজ নিন৷ একইসঙ্গে বলব ফ্লু ভ্যাকসিনের কথা৷ ৬ মাসের বেশি বয়স থেকে শুরু করে যে কেউ এই টিকা নিতে পারেন৷ বয়সের কোনও ঊর্ধ্বসীমা নেই৷ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ফ্লুয়ের টিকা নিতে পারেন৷ দেখা গিয়েছে, ফ্লুয়ের টিকা কোভিডের পূর্ববর্তী ভ্যারিয়্যান্টের বিরুদ্ধে ২০ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ অবধি প্রতিরোধ শক্তি গড়ে তোলে৷ তবে ওমিক্রন ভ্যারিয়্যান্টের ক্ষেত্রে এর দক্ষতা এখনও প্রমাণিত নয়৷
ভ্যাকসিন নিলেও তো কোভিডিবিধি অত্যাবশ্যক?
এটাই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ৷ মনে রাখুন, ভ্যাকসিন কোনও ওষুধ বা চিকিৎসা নয়৷ এটা আপনাকে লড়াই করার শক্তি দেবে৷ হয়তো ভ্যাকসিনের প্রভাবেই তৃতীয় ঢেউয়ের উপসর্গ মৃদু হয়ে দেখা দিল৷ তাই ভ্যাকসিন নিন এবং কোভিডবিধি মেনে চলুন৷ লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট, আতঙ্ক না করে সতর্ক থাকুন৷