TRENDING:

কলকাতার পয়লা: বাঙালি মেয়েরা প্রথম মডার্ন ধাঁচে শাড়ি পরতে শিখল

Last Updated:

খালি গায়ে শাড়ি জড়ানো। এই ছিল আট থেকে আশির বাঙালি মেয়েদের সাজ। সেই শাড়ির কায়দাকে বলা হত আটপৌরে ধাঁচে শাড়ি পরা। কালের অবশ্যম্ভাবী নিয়মে সেই পুরানো ট্রেন্ডই আবার ফিরে এসেছে বাঙালির ড্রেসিংরুমে।

impactshort
ইমপ্যাক্ট শর্টসলেটেস্ট খবরের জন্য
advertisement
#কলকাতা: খালি গায়ে শাড়ি জড়ানো। এই ছিল আট থেকে আশির বাঙালি মেয়েদের সাজ। সেই শাড়ির কায়দাকে বলা হত আটপৌরে ধাঁচে শাড়ি পরা। কালের অবশ্যম্ভাবী নিয়মে সেই পুরানো ট্রেন্ডই আবার ফিরে এসেছে বাঙালির ড্রেসিংরুমে।
advertisement

তবে সে যুগের কথা ছিল অন্য। সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে-বউ হলে গা ভরে উঠত সাবেকি গয়নায়। মাথায় এক গলা ঘোমটা।অন্দরমহলে সেই ঘোমটার বাড়বাড়ন্ত একটু কম হলেও, চোকাঠের অপর পারে নারী জাতির মুখ দেখতে পেত এমন মানুষের সংখ্যা থাকত হাতে গোনা।

সুতরাং আজকের কলকাতার সঙ্গে সে কলকাতার বিস্তর ফারাক। যেন কুম্ভ মেলার হারিয়ে যাওয়া কোনও সহোদর। চেহারায়,অবস্থানে তারা এক হলেও যোজন যোজন দুরত্ব তাদের। পর্দা প্রথা, রক্ষণশীলতা,শিক্ষার অভাব, কুসংস্কার তখন পায়ে বেড়ি হয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছে মেয়েদের। তবু তারই মধ্যে অন্যরকম ভাবতে শুরু করল কেউ কেউ। আভিজাত্য আর সংস্কৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে উদারমনস্কতাতেও সকলকে পিছনে ফেলে দিল জোড়াসাঁকোর স্বনামধন্য সেই পরিবার। বাংলা নবজাগরণের মুখ হয়ে একের পর এক দৃষ্টান্ত তৈরি করল ঠাকুরবাড়ি।

advertisement

এই সময়েই ঠাকুরবাড়িতে গৌরী দান হল সাত বছরের এক মেয়ের। তখন তার অক্ষর পরিচয় সবে শুরু হয়েছে। গ্রামের পাঠশালা থেকে পুতুল খেলা করা সেই মেয়েটা হঠাৎই ঢুকে পড়ল বড় বড় থামওয়ালা, চক মেলানো এক বিশাল রাজপুরীতে। পায়ে পায়ে গুজরি-পঞ্চম, মাথায় এক গলা ঘোমটা। তিনি ভারতের প্রথম সিভিলিয়ান অফিসার সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। কে জানত এই লজ্জাশীলা ছোট্ট মেয়েই একদিন এই বাংলার মাটিতে নারী স্বাধীনতায় নতুন দিগন্ত খুলে দেবে! এই মেয়েই সুদূর ইরান বা তদানীন্তন পারস্য থেকে বয়ে আ‌নবে নতুন এক শাড়ি পরার ধরন, নানা রকম জামা পরাও শুরু তাঁরই আমলে, তখন আর কে জানত এ সব কথা?

advertisement

তবে এ সব কিছু তাঁর একার চেষ্টায় হয়নি।যোগ্য স্বামীর, যোগ্য সহধর্মিনী ছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী। একদিকে সত্যেন্দ্রনাথ যখন উচ্ছ্বল, উদ্দাম, পরিবর্তনের জোয়ারে ভেসে যেতে চাওয়া যুবক, সমাজের সমস্ত অন্ধকারগুলোকে ঠেলে বের করতে উদ্যত— তখন অন্তপুরে তাঁর অর্ধাঙ্গিনী তাঁকে প্রকৃত সঙ্গত করলেন। একই সুর, তাল, ছন্দ হলে যেমন চড়ার সুরের সুক্ষতাও সুচারুভাবে কানে এসে আরাম দেয়, তেমনই সত্যেন্দ্র আর জ্ঞনদানন্দিনী একই লয়ে বাঁধা পড়লেন। গানটি হল সর্বাঙ্গসুন্দর।

advertisement

সাত বছরের বালিকা বধূটিকে প্রথম থেকেই অন্যরকম ভাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন সত্যেন্দ্র। ভারতীয় নারীর আদর্শ দিয়ে একেবারে মনের মতো করে। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিতে মাত্র ১৮ বছর বয়সে সত্যেন্দ্র চললেন বিলেতে। বাড়িতে তখন এক গলা ঘোমটা টানা বালিকা বধূ। চিঠিতে তিনি লিখতে লাগলেন, ‘‘তুমি যে পর্যন্ত প্রাপ্তবয়স্ক,শিক্ষিত ও সকল বিষয়ে উন্নত না হইবে, সে পর্যন্ত আমরা স্বামী-স্ত্রী সম্বন্ধে প্রবেশ করিব না।’’ এ সব চিঠি পরে কেঁপে যেত বালিকার হৃদয়। তবু কম যান না জ্ঞানদানন্দিনীও।সত্যেন্দ্র লিখতেন, ‘‘আমাদের স্ত্রীলোকের যা কিছু আচার, যত লজ্জা, যত ভীরুতা তুমি যেন তার মূর্তিমতী ছিলে। এখনও কি তোমার সেইরূপ ভাব আছে?’’ তখন থেকেই শুরু হল কঠোর সাধনা। স্বামীর যোগ্য হয়ে ওঠার জন্য ধীরে ধীরে নিজেকে বদলাতে লাগল ১৩ বছরের বালিকা। সিভিল সার্ভিসে পাস করে সত্যেন্দ্র চাকরি নিয়ে ফিরে এলেন দেশে। প্রথমেই মুম্বই(তৎকালীন বোম্বাই)-এ পোস্টিং। নিয়ে যেতে চান স্ত্রীকেও। অনেক ওজর-আপত্তির পর বাবামশায়ের কাছ থেকে মিলল অনুমতি।চেয়েছিলেন অন্তপুর থেকে একসঙ্গে বেরিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে গাড়িতে উঠতে। কিন্তু গেল গেল রব পরে গেল চতুর্দিকে। শেষমেশ সে বারের মতো রণে ভঙ্গ দিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। বৌ গেল ঘেরা পালকিতে।সেই সময় থেকেই পোশাক নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ঘুরতে লাগল জ্ঞানদানন্দিনীর মনে।তার কারণ অবশ্যই রয়েছে।

advertisement

জ্ঞানদানন্দিনী ও সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ৷

স্বামীর সঙ্গে দূর দেশে যাবে ঘরের বৌ। কিন্তু কী পরবে? আগে তো যা হোক একখানা কাপড় জড়িয়ে নিলেই হত। কিন্তু বাইরে বের হলে তো তা চলে না। এ দিকে ভদ্র সমাজে বেরনোর মতো একখানা ভাল পোশাক কই বাঙালি নারীর? ফরাসি দোকানে অর্ডার দিয়ে বানানো হল কিম্ভূতকিমাকার ওরিয়েন্টাল ড্রেস। কিন্তু তা পরা এমনই কষ্টকর যে জ্ঞানদানন্দিনী একা পরতে পারলেন না। সত্যেন্দ্রনাথ সাহায্য করলেন। তার পরেও এই পোশাক অত্যন্ত বিব্রত করেছিল জ্ঞানদানন্দিনীকে। তখন থেকেই বাঙালি মেয়েদের জন্য নতুন কিছু ভদ্র পোশাকের কথা তাঁর মাথায় ঘুরতে থাকে।

গাড়ি চড়ে যে বাড়ি থেকে বেরতে পারেননি জ্ঞানদানন্দিনী, দু’বছর পর সেই বাড়িতেই তিনি ঢুকলেন গাড়ি চড়ে। বোম্বাইয়ে দু’বছর থাকার পর যখন ফিরে এল ঠাকুরবাড়ির মেজ বৌ তখন সে আর আগের জ্ঞানদানন্দিনী নয়। মেমের মতো বাড়ির সদরে গাড়ি থেকে তাঁকে নামতে দেখে ঝরঝর করে চোখ দিয়ে জল পড়েছিল বাড়ির পুরনো চাকরদের। কিন্তু ততদিনে যা‘অঘটন’ ঘটার ঘটে গিয়েছে। কলকাতায় ফিরেই জ্ঞানদানন্দিনী মেতে উঠলেন একের পর এক রুদ্ধদ্বার ভাঙার খেলায়।

অবিশাস্য এক কাণ্ড ঘটিয়ে স্বামীর সঙ্গে গেলেন লাটভবনে, নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে।প্রথম বাঙালি নারী হিসাবে লাটভবনে পা রাখলেন সত্যেন্দ্র-ঘরণী। সত্যেন্দ্রনাথ নিজে লিখেছেন, ‘‘সে কী মহা ব্যাপার! শত শত ইংরেজ মহিলার মাঝখানে আমার স্ত্রী সেখানে একমাত্র বঙ্গবালা!’’জ্ঞানদানন্দিনীকে দেখে সবাই ভেবেছিল বুঝি ‘ভূপালের বেগম’। কারণ সে সময় একমাত্র তিনিই জনসমক্ষে বেরতেন।

জনতার হাটের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালেন জ্ঞানদানন্দিনী। কলকাতার বুকে প্রচলন করলেন ‘হাওযা খেতে যাওয়া’। বিকেল হলেই গাড়িতে চড়ে গড়ের মাঠ বা গঙ্গার ধার— সে যুগে ছিল নিদারুণ কষ্ট কল্পনা।তবু পিছু হটলেন না। আর পিছিয়ে যাওয়ার পাত্রী যে তিনি নন বোঝা গেল আর ক’দিন পরেই। যেখানে একলা যেতে পুরুষদেরও বুক কাঁপে, সেই কালাপানি পার করে একলা তিনটে শিশু নিয়ে জ্ঞনদানন্দিনী গেলেন স্বামীর কাছে, বিলেতে। হাঁ হয়ে দেখল বাংলা, গোটা ভারত। কিন্তু বিলেতে কেন গেলেন তিনি? শুধুমাত্র স্বামীর ইচ্ছের মান রাখতে? না। শুনতে অবাক লাগলেও জ্ঞানদানন্দিনীর বিলেত সফর শুধুমাত্র স্ত্রী-স্বাধীনতার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য।

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ৷

দেশে ফিরে আবারও মেয়েদের পোশাক-আশাক নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করেন জ্ঞানদা। বোম্বাইয়ে গিয়ে প্রথমেই তিনি যবরযং ওরিয়েন্টাল ড্রেসটিকে বাদ দিয়েছিলেন। গ্রহণ করেছিলেন পার্সি মেয়েদের ছিমছাম শাড়ি পরার ধরনটি। তার মধ্যে আবার নিজস্ব কিছু অদল-বদল আনলেন। বোম্বাই থেকে আনা বলে এর নাম হল ‘বোম্বাই দস্তুর’। তাঁর দেখাদেখি ঠাকুরবাড়ির সকলে শিখে নিল এই ধাঁচের শাড়ি পরা। বাইরে থেকে মেয়ে-বৌরাও আসত শাড়ি পরা শিখতে। দেখতে দেখতে সকলের কাছে এর নাম হল ‘ঠাকুরবাড়ির শাড়ি।’ শাড়ির সঙ্গে জ্ঞানদানন্দিনী সায়া-সেমিজ-ব্লাউজ-জ্যাকেট পরার প্রচলন করলেন। তবে বোম্বাই দস্তুরে মাথায কাপড় দিতে অসুবিধা হত। সে জন্য প্রচলন হল এক ধরনের টুপির।

তব এখন যে ধরনটি আমরা অনুসরণ করি সেটি পুরোপুরি ভাবে এনেছিলেন কুচবিহারের মহারানি কেশব-কন্যা সুনীতি দেবী। আঁচলে ব্রোচ লাগিয়ে তা আটকানোর ব্যবস্থা করেন। মাথায় পরতেন ছোট্ট একটি ত্রিকোণ চাদর।

শুধু বেশবাসেই নয়, জ্ঞানদানন্দিনী এই বঙ্গদেশে প্রথম নিয়ে এলেন আরও দু’টি জিনিস। সান্ধ্যভ্রমণ ও জন্মদিন পালন। দেওর জ্যোতিরিন্দ্রনাথের লেখায় প্রকৃত জ্ঞানদানন্দিনীকে খুঁজে পাওয়া যায়।

সেরা ভিডিও

আরও দেখুন
শীতের মরশুম এলেই গৃহবধূদের উপরি রোজগার! সংসার সামলে ছুটছেন মোয়ার দোকানে
আরও দেখুন

তিনি লিখেছেন, ‘‘এখন যে মেয়েরা গাড়ি করে বাহিরে যাচ্ছেন, পুরুসদের সঙ্গে মেলামেশা করছেন— তোমাদের কাছে এ সমস্ত ভারী সহজ ও স্বাভাবিক মনে হতে পারে— কিন্তু বাস্তবিক ধরতে গেলে এ সমস্ত বড় সহজে হয়নি। এই নিয়ে অনেক নিন্দাবাদ সহ্য করতে হয়েছে। আপনাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ও মনান্তর হবার উপক্রম হয়েছে— অনেক মনকষ্ট ভোগ করতে হয়েছে। অল্পে অল্পে একটু একটু করে— এক পা এক পা অগ্রসর হয়ে এতদূর এসে পড়া গেছে।’’ তাঁর এই পুরো রচনাটিই আদরের মেজ বৌঠানকে নিয়ে। পরবর্তীকালে যাঁর সহচর্যে এসে রক্ষণশীল জ্যোতিরিন্দ্রনাথও উদারমনস্ক হয়ে উঠেছিলেন।

Click here to add News18 as your preferred news source on Google.
স্বাস্থ্য এবং লাইফস্টাইলের (Lifestyle News in Bengali)সব খবরের আপডেট পান নিউজ 18 বাংলাতে ৷ যেখানে থাকছে হেলথ টিপস, বিউটি টিপস এবং ফ্যাশন টিপসও ৷ দেখুন ব্রেকিং নিউজ এবং টপ হেডলাইনগুলি অনলাইনে নিউজ 18 বাংলার লাইভ টিতে ৷ এর পাশাপাশি ডাউনলোড করুন নিউজ 18 বাংলার অ্যাপ অ্যান্ড্রয়েড এবং আইওএস-এ সব খবরের আপডেট পেতে ! News18 Bangla-কে গুগলে ফলো করতে ক্লিক করুন এখানে ৷
বাংলা খবর/ খবর/লাইফস্টাইল/
কলকাতার পয়লা: বাঙালি মেয়েরা প্রথম মডার্ন ধাঁচে শাড়ি পরতে শিখল