মাঞ্জার দুনিয়ায় চৈনিক পরিব্রাজনের আগের অধ্যায়ের কথা মনে পড়ে নিবেদিতা রায়ের ৷ পড়ুয়াদের মধ্যে তাঁর নিজের শৈশব খুঁজে পান না এই সরকারি স্কুলের শিক্ষিকা ৷ ‘‘বিশ্বকর্মা পুজো (Vishwakarma Puja 2021) এলেই মন ফিরে যায় ছোটবেলায় ৷ দাদাকে সাহায্য করতাম মাঞ্জা দিতে ৷ তখন কাচের গুঁড়ো কিনতে পাওয়া যেত না ৷ পুরনো টিউবলাইট গুঁড়ো করে নিতে হত ৷ তবে যে সে ভাবে করলে হবে না ৷ খুব মিহি গুঁড়ো চাই ৷ তার পর অ্যারারুট জ্বাল দেওয়ার পালা ৷ সঙ্গে মিশত আগে থেকে ভিজিয়ে রাখা সাবুদানা, শুকনো গদের আঠা এবং ইসবগুল ৷ অ্যারারুটের এই মিশ্রণে আঠাল ভাব তৈরি হলে মিশিয়ে দিতাম পছন্দসই রং ও কাচের গুঁড়ো ৷’’
advertisement
পরীক্ষার যেমন প্রস্তুতি, ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য সেই পর্ব হল মাঞ্জা দেওয়া ৷ মাঞ্জা শুধু বানালেই হবে না ৷ সুতোয় তার প্রলেপ দেওয়াও এক পর্ব ৷ সেও মনে পড়ে নিবেদিতার ৷ জানালেন, তিন জনকে লাগত মাঞ্জা দিতে ৷ কড়া রোদে দুটো খুঁটিতে সুতো জড়িয়ে দেওয়া হত মাঞ্জা ৷ প্রথমে এক জন লাটাই থেকে সুতো ছাড়তে ছাড়তে এগিয়ে যেত ৷ তার পিছনে এক জন মাঞ্জা মাখাতে মাখাতে যেত ৷ তৃতীয় জনের নাম ছিল ‘টিপধরা’ ৷ তার কাজ ছিল দেখা যে সুতোর সর্বত্র মাঞ্জা সমান ও মসৃণ ভাবে লাগছে কিনা ৷ কোথাও বেশি কম হয়ে গেলে সুতোয় মাঞ্জায় ডেলা পেকে গেলেই বিপদ ৷ সেখান থেকে ঘুড়ি কেটে যাবে ৷
আরও পড়ুন : শিশুসন্তান অকারণে কাঁদছে বা রেগে যাচ্ছে ? ফল হতে পারে ভয়ঙ্কর! বাবা মাকে প্রথম থেকেই সতর্ক হতে হবে
যার মাঞ্জায় যত ধার, তার ‘ভোকাট্টা’ বলার সুযোগ তত বেশি ৷ ধারের তীব্রতা নির্ধারণে বড় ভূমিকা ছিল সূর্যদেবের ৷ কড়া রোদ না হলে মাঞ্জা কড়কড়ে হবে না ৷ এখনও রোদের ঝাঁঝ কড়া হয় ঠিকই ৷ কিন্তু রাস্তার ধারের লাইটপোস্টের ডিউটি গিয়েছে ৷ তাদের গায়ে সুতো জড়িয়ে কেউ আর মাঞ্জা দেয় না ৷
সব জিনিসে ‘রেডিমেড’, ‘রেডি টু কুক’ সুযোগ থাকলে মাঞ্জাই বা বঞ্চিত হবে কেন? দোকানে হাজির মাঞ্জা দেওয়া সুতো ৷ রিল থেকে বৈদ্যুতিক যন্ত্রের সাহায্যে পছন্দসই লাটাইয়ের গায়ে সুতো জড়িয়ে দেওয়া কিছু মুহূর্তের অপেক্ষামাত্র ৷ তার পর সেই সুতো অন্য ঘুড়িও কাটতে পারে, বাইকআরোহীর গলাতেও বসে যেতে পারে ঠগীর রেশমি ফাঁসের মতো ৷
আরও পড়ুন : গোবরজলের ছড়া দিয়ে মাটির উঠোন তকতকে করে শুরু দিন, ঠাকুমা পুষ্পরানি জানালেন সুস্থতার চাবিকাঠি
টিভি, ল্যাপটপ এবং মোবাইলের পর্দায় আটকে থাকা শৈশব কৈশোর ফাঁস পরিয়েছে ঘুড়ির উড়ানে ৷ নিবেদিতার মনে পড়ে, আগে কার ঘুড়ির লেজ কত বাহারি হবে, সে নিয়েও প্রতিযোগিতা চলত ৷ বাড়ির ছাদে কুড়িয়ে পাওয়া ঘুড়ির গায়ে লেখা থাকত নাম ঠিকানাও!
এখন নাম ঠিকানা জানানোর জন্য ঘুড়ির দরকার পড়ে না ৷ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছেন হর্ষ দত্তর গল্পের ঘুড়িমামা এবং মিষ্টিমামির মতো পড়শিরাও ৷ কিন্তু বয়স বারো কি তেরো বা বড়জোর চোদ্দর আকাশে চোখ রাখা কিশোরকে আজও বাধ্য করা হয় তার দৃষ্টি নামিয়ে নিতে ৷ তার রিকশার বাবু হয়তো এখন অ্যাপক্যাবের সওয়ার ৷ কিন্তু কেরিয়ারের হুমকিও যথেষ্ট চাপ দেওয়ার জন্য ৷ বিচ্ছু ছেলেকে আজও মুক্তির খবর পাঠায় আকাশের ময়ূরপঙ্খী এবং মুখপোড়ার দল ৷ কিন্তু তার কাছে সে খবর পৌঁছয় না ৷ ইন্টারনেটের নেটওয়ার্ক খুব খারাপ যে!