কিন্তু পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়া ১ নম্বর ব্লকের বীজনগর গ্রামে পুজোর আবহ একেবারেই আলাদা। এখানে দুর্গাপুজোয় আলো জ্বলে, মণ্ডপ সাজে, ধূপধুনোর গন্ধ ভেসে আসে ঠিকই, কিন্তু গ্রামের মহিলাদের চোখে আনন্দের ঝিলিকের বদলে লুকিয়ে থাকে অপেক্ষার ছায়া। কারণ দুর্গাপুজোয় এই গ্রাম থাকে প্রায় পুরুষশূন্য! উৎসবের কয়েক মাস আগে থেকেই গ্রামের পুরুষেরা ছুটে যান দেশের নানা প্রান্তে। কেউ বেঙ্গালুরু, কেউ হরিদ্বার বা বৃন্দাবন, কেউ পঞ্জাব, কেউ হরিয়ানা আবার কেউ উত্তরাখণ্ড, বিহারে। সেখানে মাটির প্রতিমা তৈরির কাজ করেন বীজনগর গ্রামের পুরুষেরা। অনেকে আবার ভিন রাজ্যে কারখানাও গড়ে তুলেছেন। এখনকার শিল্পীদের হাতের ছোঁয়ায় উজ্জ্বল হয় ভিনরাজ্যের বহু দুর্গাপুজো। গ্রামের বাসিন্দা আনন্দ পাল বলেন, একশোর বেশি ছেলে এখন গ্রামের বাইরে কাজ করে। পুজোর সময় গ্রামের অর্ধেক ছেলেরা বাইরে থাকে।
advertisement
বীজনগরের পালপাড়ার অধিকাংশ পুরুষই পেশায় মূর্তিশিল্পী। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তাঁদের হাতের ছোঁয়ায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে দেবী দুর্গা। কিন্তু দুঃখের বিষয়, নিজেদের গ্রামের দুর্গোৎসবেই তাঁরা থাকেন না। পরিবারের কাছে ফিরতে পারেন না সবচেয়ে আনন্দের এই সময়ে। স্বামী, ছেলেকে ছেড়ে মনখারাপের পুজো কাটান মহিলারা। গ্রামবাসী মিঠু পাল বলেন, ” আমার স্বামী উত্তরাখণ্ডে মাটির প্রতিমা তৈরির কাজে গিয়েছে। দুর্গাপুজোতেও বাড়ি আসবেনা। মন খারাপ তো হয়ই, কিন্তু মন খারাপ করলে আমাদের হবে না। সারা বছর খাব কী?”
পুজোর সময় গ্রামে ঢাক বাজে, আলো জ্বলে, কিন্তু স্বামী বা ছেলের মুখ দেখতে পান না মহিলারা। সংসার চালাতে গ্রামের ছেলেদের বাইরে যেতেই হয়। তাই পুজোয় এই গ্রামের মহিলাদের সম্বল শুধু অপেক্ষা আর অপেক্ষা! গ্রামবাসী মোনালিসা পাল বলেন, ” আমার স্বামী বাইরে কাজে গিয়েছে, আবার বাড়ি আসবে অগ্রহায়ণ মাসে নবান্নের সময়। তখনই আমরা একসঙ্গে আনন্দ করে সময় কাটাই। দুর্গাপুজোয় বাড়ি আসে না, মন খারাপ হয়। পুজোর দিনগুলো আনন্দ, মন খারাপ নিয়েই কেটে যায়। এখানে কিছুই করার নেই।”
এই অপেক্ষাই বীজনগরের চেনা ছবি। কালীপুজো বা জগদ্ধাত্রী পুজোর পর অনেকেই ঘরে ফেরেন, কিন্তু দুর্গাপুজোতে নয়। কারণ তখনই সবচেয়ে বেশি কাজ থাকে শিল্পীদের হাতে। অন্য রাজ্যের পূজা-প্যান্ডেলে তাঁদের গড়া মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়, ঢাক বাজে, আনন্দে ভরে ওঠে শহর-গ্রাম। অথচ শিল্পীর নিজের বাড়ি তখন খালি, আলো-আনন্দের ভিড়েও শূন্যতার দীর্ঘশ্বাস ঘিরে থাকে বীজনগরকে। কাটোয়ার বীজনগর এমন এক গ্রাম যেখানে উৎসব মানে মিলন নয়, শুধু অপেক্ষা!
বনোয়ারীলাল চৌধুরী