আলিপুরদুয়ার জেলাশহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে বক্সা জঙ্গলের ধার ঘেঁষা ‘ডুয়ার্সের রানী (Queen of Dooars)’ জয়ন্তী। ভারত-ভূটান সীমান্তবর্তী পাহাড়ে ঘেরা জয়ন্তী নদীর ধারে এককালে কোনও গ্রাম ছিল বলে শোনা যায়। নানা রহস্যে মোড়া গা ছমছমে বক্সা দুর্গ ও উদ্যান জয়ন্তীর সৌন্দর্য্যকে মাত্রাতিরিক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছে।
আরও পড়ুন: পুজোয় একেবারে অন্যরকম বেড়ানোর প্ল্যান চান? ডেস্টিনেশন হোক 'মৌসুনি দ্বীপ'
advertisement
এ দিকে, জয়ন্তী বেড়াতে এসেছিলেন শিলিগুড়ি তরাই তারাপদ আদর্শ বিদ্যালয়ের (উঃ মাঃ) সহকারী শিক্ষক তথা আলোকচিত্রকর (Enthusiast Photographer) সুকান্ত সরকার। তিনি বলেন, ''জয়ন্তীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ সেই ১৯৮৮ সালে। বিশ্ববিদ্যালয়ের (University) ডিসার্টেশন (Decertation) পেপারের (paper) বিষয় ছিল জয়ন্তীর ডলোমাইট মাইনিং (Jayanti dolomite mining)। বক্সা মোড় (Buxa more) থেকে জয়ন্তী নদী (Jayanti River) পেরিয়ে নিবিড় অরণ্যের মধ্য দিয়ে কিমি পাঁচেক হেঁটে ছিলাম আমি আর এক সঙ্গী। সেই বেঙ্গল ডলোমাইট মাইনিং অফিস আজ অতীত। এরপর বহুবার জয়ন্তী যাওয়া হয়েছে। এখন পর্যটকদের ভিড়ে জয়ন্তীর নাভিঃশ্বাস অবস্থা। অরণ্য চিরে একের পর এক গাড়ি ছুটছে। বন্যপ্রাণী কালে-ভদ্রে দেখা মেলে। অজস্র প্রজাতির প্রজাপতি এখানকার সম্পদ। আর আছে নানারকম পাখি। 'আবার অরণ্যের' খাতিরে জয়ন্তীর বেড সবার চেনা এখন।''
আরও পড়ুন: পুজোয় একেবারে নিরিবিলি কোথাও বেড়াতে যেতে চান? ঘুরে আসুন পলাশবাসিনি-দ্বারবাসিনী মন্দির
কীভাবে যাবেন:
নিউ জলপাইগুড়ি (NJP) স্টেশন থেকে ট্রেন কিংবা প্রাইভেট গাড়িতে আলিপুরদুয়ার কিংবা নিউ আলিপুরদুয়ারে জংশনে পৌঁছতে হবে। সেখান থেকে সড়কপথে পৌঁছে যাওয়া যায় জয়ন্তী। অনেকে বিমানে বাগডোগরা (Bagdogra - Siliguri) নেমে সেখান থেকেও জয়ন্তী যাওয়ার গাড়ি ধরেন।
এই 'ডুয়ার্সের রানী (Queen of Dooars)' শুধু যে পর্যটকপ্রিয় স্থান তা নয়! সতীপীঠ জয়ন্তী পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার জেলায় পাহাড় জঙ্গল অতিক্রম করে ভুটান সীমান্তে অবস্থিত। এটি একান্ন সতীপীঠের একটি পীঠ। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, এখানে সতীর বামজঙ্ঘা পড়েছিল। এখানে অধিষ্ঠিত দেবীর নাম জয়ন্তী এবং এখানের ভৈরব হলেন ক্রমদীশ্বর। পৌরাণিক মতে, মাতা সতী নিজের বাপের বাড়িতে বাবার কাছে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে সেখানেই দেহত্যাগ করেছিলেন। মাতা সতীর দেহত্যাগের খবর মহাদেবের কাছে পৌঁছোতেই মহাদেব সেখানে উপস্থিত হন।
আরও পড়ুন: পুজোর ছুটিতে ঘুরে আসুন 'সুন্দরী' সাতকোশিয়া, রইল বেড়ানোর সমস্ত খুঁটিনাটি...
সতীর মৃতদেহ দেখে ক্রোধে উন্মত্ত মহাদেব সেই দেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য চালু করেন। মহাদেবের তাণ্ডব নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কায় শ্রীবিষ্ণু তাঁর সুদর্শন চক্র দ্বারা মাতা সতীর দেহ একান্নটি খণ্ডে খণ্ডিত করেন। সেই দেহখন্ডগুলোই যে যে স্থানে পড়েছিল সেখানে একটি করে সতীপীঠ প্রতিষ্ঠা হয়। বলা হয়, এখানে সতীর বামজঙ্ঘা পড়েছিল। আর মহাকাল সেই ভার ধরে রেখেছেন। এখানে দেবীর থেকে মহাকালের প্রাধান্যই বেশি। পুরাণ ও তন্ত্র মতে শক্তিই প্রকৃতি, সব শক্তি প্রকৃতিতেই বিরাজমান ও শিব ছাড়া কোনো শক্তিরই অস্তিত্ব নেই। আর জয়ন্তীতে প্রকৃতির সঙ্গে শক্তির মিলন হয়েছে। সর্বোপরি উল্লেখ করতে হয় পাহাড়ের উপর প্রকৃতির শোভা তথা পাহাড়ে পাহাড়ে সীমান্তে দুই দেশের মিলনে এক অপূর্ব সৌন্দর্য।
*কী দেখবেন জয়ন্তীতে এসে:
আলিপুরদুয়ার থেকে নাতিদূরে বক্সা জঙ্গলের ধার ঘেঁষা জয়ন্তী। গর্বের গতিপথ হারিয়েছে জয়ন্তী নদীও। পাহাড় ও জঙ্গলে ঘেরা নুড়ি-পাথরের শুকনো নদীপথেই বিরাজমান অপার শান্তি। সেই পথ বেয়ে গাড়ি যেখানে থামে, সেখানে এখনও অবশিষ্ট জলের কিছু লেশ। দু'দিকে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তার একটি উঠেছে ছোট মহাকালের দিকে এবং অন্যটির গন্তব্য বড় মহাকাল মন্দির। কাঁচের মতো স্বচ্ছ জল মাড়িয়ে ছোট মহাকাল মন্দির দর্শনের জন্য পথ পেরোতে। চড়াই-উতরাইয়ে ভরা দুর্গম পাহাড়ি পথ পেরিয়ে বিপজ্জনক খাড়া লোহার সিঁড়ি বেয়ে গন্তব্য যেখানে, সেখানে ছোট মন্দিরের কান ঘেঁষে নেমে আসা পাহাড়ি ঝরনা নীরবতা ভেঙে চলেছে অবিরাম। প্রায় ঘণ্টা খানেক সেখানেই কাটিয়ে দেওয়া যায় অনায়াসে। পাহাড়ের অনেকটাই ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা বড় মহাকাল মন্দিরের পথ আরও বেশি দুর্গম। ওখানে যেতে ট্রেকিংয়ের সরঞ্জাম থাকা আবশ্যক।
ভাস্কর চক্রবর্তী