১) হুগলির চন্দননগর বিখ্যাত জগদ্ধাত্রী পুজো ও চোখ ধাঁধানো আলোর জন্য। দুর্গাপূজাতে চন্দননগরের সেরকম আরম্ভর না থাকলেও হুগলি জেলার অন্যতম প্রাচীন একটি বনেদি বাড়ির পুজো হল চন্দননগরের বোস বাড়ির পুজো। এই বছর সেই পুজোর বয়স ৫১৫ বছর। আজও পুরাতন প্রথা মেনেই হয়ে আসছে এই বাড়ির দুর্গাপূজা।
advertisement
এই বোস পরিবার একসময় জমিদার ছিল চন্দননগরের। বাংলায় তখন নবাবদের শাসন। সেই সময় করুনময় বসু জমিদারির দায়িত্বভার তুলে নেন চন্দননগর অঞ্চলের। নবাবের শাসন থেকে পর্তুগিজ উপনিবেশ সবই দেখেছে এই জমিদার বাড়ি। কালের সঙ্গে জমিদারি ম্লান হয়ে গেলেও ম্লান হয়নি এই বাড়ির শারদীয় উৎসব। ১৫০৮ খ্রিস্টাব্দে করুনময় বসুর হাত ধরেই বৃহৎ এই অট্টালিকার নাট মন্দিরের শুরু হয় দেবী দুর্গার আরাধনা।
আজও প্রাচীন প্রথা মতেই পুজো হয়ে আসছে একচালা দুর্গা ঠাকুরের। বংশপরম্পরায় এই পুজোর ভার বহন করে আসছেন নব প্রজন্মের বংশধররা। বর্তমানে বাড়ির নবপ্রজন্মর অনেকেই কর্মসূত্রে বিদেশে থাকে। তবে পুজোর আগে সবাই চলে আসেন নিজের বাড়িতে। একান্ন বর্তি পরিবারে পুজোর মজাই আলাদা।
আরও পড়ুন Malda News: এ যেন খোদ রানী রাসমনির বাড়ি! মালদহের পুজো মণ্ডপ দেখে সকলে থ!
২) তখন দিল্লির তখতে রয়েছেন সুলতানরা৷ আলাউদ্দীন ফিরোজ শাহ রয়েছেন মসনদে৷ আনুমানিক সেই সময় থেকে শুরু বাংলার কোচবিহার বিশ্ব সিংহ রায় বাড়ির দুর্গাপুজো৷ এখানে মা দুর্গা বড়ো দেবী নামে পরিচিত৷ কোচবিহার বড় দেবীর দুর্গা পুজো সূচনা করা হয়েছিল ১৫৫৫ - ৮৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে।
অন্যান্য সকল পুজোর রীতি থেকে অনেকটাই আলাদা কোচবিহার বড় দেবীর দুর্গাপুজোর রীতি। এখানে দেবী দুর্গা, লক্ষ্মী কার্তিক স্বরসতী ও গণেশকে নিয়ে থাকেন না। এখানে দেবী দুর্গার পাশে বিরাজ করে জয়া ও বিজয়া। এছাড়া দেবীর বাহন এখানে বাঘ। এবং মূর্তি অন্যান্য দুর্গা প্রতিমার মূর্তি থেকে অনেকটাই উঁচু। কথিত আছে কোচবিহারের মহারাজা, একটা সময় স্বপ্ন দেশে পেয়েছিলেন এই দুর্গা পুজো। তারপর এই পুজোর সূচনা করা হয়।
দেবীর বিসর্জনের প্রথাও এখানে সম্পূর্ণ রকম আলাদা। অন্যান্য সকল দেবীর মূর্তি নদীতে বিসর্জন করা হলেও। বড় দেবীর প্রতিমা দেবী বাড়ির পেছনে থাকা লম্বা দীঘিতে বিসর্জন করা হয়। মূর্তিকে ছোট ছোট খণ্ডে কেটে তারপর করা হয় মূর্তির বিসর্জন।
আরও পড়ুন Murshidabad Durgapuja 2022: ৭৫ফুটের দুর্গা ঠাকুর! দেখতে লাইন পড়ছে প্রচুর
৩) ৪১৩ বছরে পা, কলকাতার সবচেয়ে আদি সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপুজো আজও অমলিন। ১৬১০ সালে লক্ষীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় যখন এই পুজো শুরু করেন তখন দিল্লিতে মুঘলরাজ চলছে। সম্রাট আখবরের মৃত্যুর পর জাহাঙ্গীরে রাজত্ব শুরু হয়েছে৷ অন্যদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি সবে সবে ভারতের ব্যবসা শুরু করেছে৷ মূলত পশ্চিম ভারতেই তারা প্রথম শুরু করে ব্যবসা৷ সেই সময় কলকাতার বুকে রায় চৌধুরী পরিবারে মোট ছয়টি দূর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
এছাড়া বাকি দুটি হয় নিমতা এবং বিরাটিতে। ট্রিধারা সঙ্গম ( বৈষ্ণব, শাক্ত, শৈব) রীতি মেনে চলে দুর্গার আরাধনা। পুজো শুরু হয় এক চাল চিত্রে, যা এখনও চলে আসছে। তবে তার মধ্যে থাকে তিন ভাগ। মাঝখানে সন্তানদের নিয়ে মা দুর্গা। একদিকে রামচন্দ্র অন্যদিকে মহাদেব। এই দুর্গা পুজোর অনন্য ব্যাপার মাসভক্তবলি।
সহজ বাংলায় বোঝাতে গেলে অপদেবতাদের তুষ্ট করার পুজো। মোট ১৮ টি অন্নভোগ নিবেদন করা হয় দুর্গাকে। বিদ্যাপতি রচিত দূর্গা ভক্তি তরঙ্গিনী রীতিনীতি মেনে হয় পুজো।
৪) ১৭৫৭ সাল৷ বাংলার নবাব সিরাজকে হারিয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি৷ বাংলা দখল করেছে ইংরেজরা৷ সে বছরই শুরু হল শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপুজো৷ শোনা যায় পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের জয়ের আনন্দেই শুরু হয়েছিল এই পুজো৷ রাজা নবকৃষ্ণ দেব তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র গোপীমোহন দেবকে পুত্র হিসেবে দত্তক নেন ৷ পরে নিজের ছেলেকে নিয়ে আদি বাড়ির দক্ষিণ দিকে আরও একটি ভবন তৈরি করে বসবাস শুরু করেন ৷
নবকৃষ্ণ দেবের মৃত্যুর পর শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো বড় তরফ ও ছোট তরফ, এই দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে ৷ তবে সেই প্রথম থেকে যে নিয়ম, আচার-অনুষ্ঠান রাজবাড়িতে শুরু হয়েছিল আজও তা অব্যাহত ৷ উত্তর কলকাতার বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজোর কথা উঠলেই, সবার প্রথমে উঠে আসে যে নামটি, তা হল শোভাবাজার রাজবাড়ি ৷ এই বাড়ির পুজো নিয়ে কতই না গল্প ৷রাজবাড়ির অলিতে-গলিতে, ঝাড়বাতিতে আজও চুঁয়ে পড়ে রাজ-অহংকার। আড়াইশো বছরের শরীরে সময়ের আঁচড়। তবুও বর্তমান, আজও অতীতে মজে। রীতি-নিয়মে আজও তিলোত্তমার অহংকার রাজা নবকৃষ্ণ দেবের শুরু করা শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপুজো।
আরও পড়ুন South24Parganas News: কোন রুটে গেলে পুজো দেখা সহজ হবে? সামনে এল গাইড ম্যাপ
৫) পুরুষ-শাসিত তখনকার কলকাতা ৷ ব্রিটিশরাজ সে সময় জাঁকিয়ে বসেছে এ শহরের অলিতেগলিতে ৷ সমাজে মেয়েদের অবস্থান তখন অন্দর মহলের গভীরে আরও গভীরে যেতে যেতে মাঝপথে যেন হারিয়েই গিয়েছে ৷ নারী স্বাধীনতায় তলানিতে পৌঁছে যাওয়া মধ্যযুগীয় কলকাতা দেখেছিল বিধবা জমিদার গিন্নির তেজ কাকে বলে ৷ লোকমাতা রানি রাসমণি শুরু করলেন দেবী দুর্গার আরাধনা ৷ যা আজও চলে আসছে৷ সেই যুগে মধ্য কলকাতার সুবৃহৎ হলদে-রঙা জানবাজারের প্রাসাদপম বাড়িটায় শুরু হল একেবারে ছক ভাঙা এক পুজো ৷ ১৮৬১ শুরু হওয়া এই পুজো যেমন মায়ের আরাধনা, তেমনই মহিলাদের সম্মান প্রদর্শনও ৷
বরাবরই এই পুজোয় মহিলাদের প্রাধান্য ৷ এই বাড়ির পুজোয় মহিলাদের অমানুষিক খাটুনি, সবার শেষে খাওয়া, সাধ্যাতীত পরিশ্রম করার রেওয়াজ এখানে নেই ৷ এখনও পুজোর কোনও জোগাড়ে হাত লাগান না বাড়ির মহিলা সদস্যরা ৷ সমস্ত কিছুর ভার দাস-দাসীদের ৷ তাঁরা পুজোর সময় ঠাকুর দালানে আসেন, বসে পুজো দেখেন, আমোদ-ফূর্তি করেন ৷ এ বাড়িতে মেয়েদের খাওয়া শেষ হলে তবে খেতে বসেন পুরুষরা ৷ আজও এই ধারাই বজায় আছে ৷ প্রতিপদ থেকে শুরু হয় পুজো ৷
রানিমার পুজোর অন্যতম বিশেষত্ব হল, এই পুজোয় রোজই হয় কুমারী পুজো ৷ আরও একটা বিষয় হল, কুমোররা নয় পুজোয় ঠাকুর গড়েন চিত্রকররা ৷ তবে মায়ের মুখের কোনও নির্দিষ্ট ছাঁচ নেই ৷ বংশপরম্পরায় চিত্রকররাই হাতের আদলে জীবন্ত করে তোলেন মায়ের মুখ ৷ দেবীর গাত্র বর্ণ হয় শিউলি ফুলের বোঁটার মতো ৷ আটচালায় আঁকা থাকে নানা পৌরাণিক কাহিনীর ছবি ৷ রানির আমলে এই পুজোর ধূমধাম ছিল চোখে পড়ার মতো ৷ তবে সে সময়ের অন্যান্য বড় বাড়ির পুজোর মতো এখানে কোনওদিন বাঈ নাচের আসর বসেনি, হাওয়ায় টাকা ওড়েনি, মদ-মাংসের ফোয়ারা ছোটেনি ৷ বরাবরই এই পুজো ছিল জনসাধারণের মনের পুজো ৷ আজও রানির সেই ভাবধারাকে সঙ্গী করে, নিষ্ঠা ভরে পুজো হয় এখানে ৷
এই পুজোতেই শাড়ি পরে, সখী বেশে মায়ের পুজো করতে এসেছিলেন রামকৃষ্ণদেব ৷ পাছে লোকের তাঁকে চিনে ফেলে হৈ-চৈ বাঁধিয়ে দেয়, সে কারণেই ছদ্মবেশ ধরতে হয়েছিল পরমহংসদেবকে ৷
একটাও ছেলে হল না তাঁদের৷ ফলে মেয়ে ও জামাইদের মধ্যে ভাগ হয়েছিল জমিদারি৷ সেই কারণে আজও তিনটি ভাগে চলছে এই পুজো ৷
