Abu Obaidha Arin
ঢাকা: বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর পরিবারের সদস্যরা এবং যুক্তরাজ্যের সাংসদ টিউলিপ সিদ্দিককে রাজুক পূর্বাচল প্লট মামলায় দোষী সাব্যস্ত করার ঘটনাকে মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিজেদের সাফল্য হিসেবে দেখানো হচ্ছে। কিন্তু আসলে তা নয়। এই পদক্ষেপ স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে, বাংলাদেশে আইনের শাসন রাজনৈতিক সুবিধার জন্য ধ্বংস করা হয়েছে, আর International Crimes Tribunal (ICT)—যেটা ১৯৭১ সালের রক্তের বিনিময়ে গড়ে উঠেছিল—তা ফাঁকা করে ঘরোয়া শাস্তির যন্ত্রে পরিণত করা হয়েছে।
advertisement
আইন আসলে কী বলে, সেটা পরিষ্কার করা দরকার। ICT গঠিত হয়েছিল International Crimes (Tribunals) Act, ১৯৭৩ অনুযায়ী, একটাই উদ্দেশ্য নিয়ে – মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা। এটা গড়ে উঠেছিল মানবতার শত্রুদের বিচার করার জন্য, জমির প্লট নিয়ে প্রশাসনিক বিরোধ মেটানোর জন্য নয়। একটা সিভিল জমি বরাদ্দের বিষয়কে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে টেনে এনে, রাষ্ট্র ন্যায়বিচারকে শক্তিশালী করেনি; বরং পুরো প্রক্রিয়াকে বেআইনি করে তুলেছে।
এই বিষয়ে প্রক্রিয়াগত অন্যায়ও স্পষ্ট। এই বিচারগুলো হচ্ছে অভিযুক্তদের অনুপস্থিতিতে, কোনও জেরা ছাড়াই এবং কার্যকরী প্রতিরক্ষা ছাড়াই। টাকা কোথায় গেল? অপরাধমূলক দুর্নীতির জন্য ব্যক্তিগত লাভের প্রমাণ দরকার। কিন্তু কোনও প্রমাণ নেই যে শেখ হাসিনা বা টিউলিপ সিদ্দিক এই প্লটগুলো বিক্রি করে সম্পত্তি বাড়িয়েছেন। যদি ব্যক্তিগত সম্পদ অর্জনই উদ্দেশ্য হত, তাহলে হাসিনা কেন ধানমন্ডি ৩২—ঢাকার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পত্তি—একটা পাবলিক মিউজিয়াম হিসেবে রেখে দিলেন, ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে রাখলেন না? আচরণ যখন উল্টো কথা বলে, তখন উদ্দেশ্য ধরে নেওয়া যায় না। এখন যারা অভিযোগ তুলছেন, তাদের ইতিহাস দেখলে এই ভণ্ডামি আরও স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
পূর্বাচল প্রকল্পে হাজার হাজার প্লট বরাদ্দ হয়েছে, বিভিন্ন সরকারের সময়। তাহলে শুধু একটা পরিবারকেই কেন টার্গেট করা হচ্ছে? এরশাদের আমলের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে যখন গুলশানের প্রধান জমি খালেদা জিয়াকে মাত্র এক টাকায় জমি বরাদ্দ করা হয়েছিল। ওটা ছিল খোলাখুলি রাজনৈতিক লেনদেন, যেখানে রাষ্ট্রের সম্পদ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তখন কি তাঁকে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে তোলা হয়েছিল? তখন কি খালেদাকে অপরাধী বানানো হয়েছিল? না। তখন আইন নড়েনি। এখন নড়ছে, কারণ এটা রাজনৈতিক প্রতিশোধের খেলা হচ্ছে।
রাষ্ট্র এমন জমির জন্য শেখ হাসিনার বিচার করছে, যেগুলো তিনি কখনও বিক্রি করেননি। মুহাম্মদ ইউনূসের অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসার কয়েক সপ্তাহ পরেই, রাষ্ট্রযন্ত্র তার ব্যক্তিগত স্বার্থে কাজ করতে শুরু করে। এক অভাবনীয় সিদ্ধান্তে, হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ গ্রামীণ কল্যাণের বিরুদ্ধে ৬৬৬ কোটি টাকার ট্যাক্স দাবি করা রায় প্রত্যাহার করে নেয়, যেটা ইউনূসের নেটওয়ার্কের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান। এই বিশাল অর্থ মেটানো হয়নি, বরং বিচার বিভাগের সুবিধাজনক হস্তক্ষেপে মুছে ফেলা হয়েছে, যেটা এখন তার প্রশাসনের ছায়ায় চলছে।
কিন্তু সুবিধা এখানেই থেমে থাকেনি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরে গ্রামীণ ব্যাঙ্ককে পাঁচ বছরের জন্য ট্যাক্স ছাড় দিয়েছে। এটা এমন রাষ্ট্রীয় সুবিধা, যা আর কোনও নাগরিক পায় না। যখন একজন নেতা নির্বাহী ক্ষমতা ব্যবহার করে শত শত কোটি টাকার ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক দায় মুছে দেয়, আর আগের নেতাদের প্রশাসনিক অনিয়মের জন্য বিচার করে, তখন এটা ন্যায়বিচার নয়। এটা রাষ্ট্রকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বানানোর প্রক্রিয়া।
ইতিহাসের দিকে যদি চোখ মেলা যায়, দেখা যাবে ২০০৮ সালের ৩ অগাস্ট গ্রামীণ ব্যাঙ্কের ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে ইউনূস এমন একটা চক্রাকার ব্যবস্থা করেছিলেন, যেখানে ১১,০০০ বর্গফুটের অফিস স্পেস মাত্র ১,০০০ টাকায় ভাড়া দেওয়া হয়েছিল। এটা ছিল নিজের প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বার্থের সংঘাতের দারুণ উদাহরণ। কিন্তু তার জন্য কোনও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল হয়নি। ক্ষমতা শুধু তখনই অপরাধ, যখন সেটা প্রতিপক্ষের হাতে থাকে। তবে সবচেয়ে বিপজ্জনক পরিবর্তন আর্থিক নয়, আদর্শিক।
International Crimes Tribunal গড়ে উঠেছিল যুদ্ধাপরাধী—বিশেষ করে জামাত-এ-ইসলামি নেতাদের বিচার করার জন্য। যারা বাংলাদেশের জন্মের বিরোধিতা করেছিল। এই ট্রাইব্যুনালই গণহত্যার পরিকল্পনাকারীদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। আজ, ইতিহাসের এক বিকৃত রূপে, সেই ট্রাইব্যুনাল দখল করেছে তারাই, যাদের বিচার করার জন্য এটা গড়ে উঠেছিল।
অভিযোগ উঠেছে, এই ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা হাইকোর্টের প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা ও মর্যাদা ছাড়াই নিয়োগ পেয়েছেন। বিচারিক দক্ষতার বদলে আদর্শিক মিল দেখে বাছাই করা হয়েছে এই বিচারকদের। যখন আগের যুদ্ধাপরাধীদের আইনজীবীরা আজকের মুক্তিযোদ্ধা নেতাদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউটর হয়, তখন আদালত আর ন্যায়বিচারের যন্ত্র থাকে না। এটা প্রতিশোধের অস্ত্র হয়ে যায়। এই ইতিহাস বিকৃতি আকস্মিক নয়। এটা আরও গভীর, ব্যক্তিগত ইতিহাসের প্রতিধ্বনি। এই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিগুলোর পুনর্বাসন প্রধান উপদেষ্টার বংশের সঙ্গেও মিলে যায়। জনমত ও ঐতিহাসিক নথিতে বহুদিন ধরেই ইউনূসের বাবা হাজি দুলা মিয়ার কথা উঠে এসেছে, যিনি পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে মনোভাব পোষণ করতেন।
(Abu Obaidha Arin is a Bangladeshi thinker and writer focused on politics, governance, and the societal impact of digital systems. His work engages with questions of democracy, secularism, and power in Bangladesh. Views expressed in the above piece are personal and solely those of the author. They do not necessarily reflect News18’s views.)
