বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের পথপ্রদর্শক বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। আপাত রক্ষণশীল পরিবারে জন্মেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার নানা বাধা ও নিষেধাজ্ঞা অতিক্রম করে পাণ্ডিত্যে রেখে গিয়েছেন স্বতন্ত্র ও উজ্জ্বল ছাপ। একের পর এক সাহিত্যকর্মে তিনি সৃষ্টি করেছেন অনন্য নজির। নারীকুলকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করাই ছিল তাঁর আজীবনের সাধনা।
ওপার বাংলার মানুষ হয়েও তাঁর চিন্তা ও কর্মে সমৃদ্ধ হয়েছে এপার বাংলাও। শিক্ষা, যুক্তি ও মানবিকতার মাধ্যমে নারী উন্নয়নের যে পথ তিনি দেখিয়েছিলেন, তা আজও সমান প্রাসঙ্গিক। সেই প্রাতঃস্মরণীয়, শিক্ষাব্রতী ও নারী উন্নয়নের পথিকৃৎ ব্যক্তিত্বকেও রেহাই দিল না অশান্ত বাংলাদেশের হিংস্রতা।
advertisement
বাংলাদেশে চলতে থাকা অশান্তির আবহে বেগম রোকেয়ার ছবিতেও পড়ল কালির পোঁচ। শুধু তাই নয়, তাঁর নামের উপর অশ্লীল শব্দ লিখে দেওয়ার ঘটনাও সামনে এসেছে। নারী জাগরণের প্রতীক এক মহীয়সী নারীর স্মৃতিতে এই আঘাত ঘিরে তীব্র ক্ষোভ ও বেদনা ছড়িয়েছে সমাজের সর্বস্তরে।
বৃহস্পতিবার রাত আনুমানিক ১টা নাগাদ ঢাকার ধানমন্ডিতে অবস্থিত সাততলা ছায়ানট ভবনে হামলা চালায় একদল উন্মত্ত বিক্ষোভকারী। ভবনের একের পর এক কক্ষে ঢুকে নির্বিচারে ভাঙচুর চালানো হয়। চেয়ার, টেবিল, বেঞ্চ ভেঙে ফেলা হয়, লাঠি দিয়ে ভাঙা হয় দরজা-জানলা। পরে একাধিক জায়গায় আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ছাই হয়ে যায় বহু মূল্যবান সরঞ্জাম। ভেঙে আছড়ে ফেলা হয় হারমোনিয়ামও।
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ছায়ানটের প্রতিটি তলায় ঘুরে ঘুরে তাণ্ডব চালানো হয়। সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবি ও ভিডিয়োয় দেখা গিয়েছে, কক্ষের মেঝে জুড়ে কালো ছাই, ভাঙা আসবাব এবং পোড়া দেওয়াল। বিক্ষোভকারীরা ছিঁড়ে ফেলেছে ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত সন্জীদা খাতুনের ছবি। লালনের ছবিও ছেঁড়া হয়েছে বলে দেখা গিয়েছে। দল বেঁধে এই হামলা চালানো হয়। যদিও এই ছবি ও ভিডিয়োর সত্যতা নিউজ ১৮ বাংলা স্বাধীনভাবে যাচাই করেনি।
রাত ৩টে নাগাদ ছায়ানটের তরফে সমাজমাধ্যমে জানানো হয়, এই ঘটনার পর সংগঠনের সমস্ত কার্যক্রম অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত রাখা হচ্ছে। ভবনে চলা সঙ্গীতচর্চা ও অন্যান্য ক্লাস আপাতত বন্ধ থাকবে বলে জানানো হয়েছে।
উল্লেখ্য, ছায়ানট শুধু একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান নয়, এটি বেগম রোকেয়ার আদর্শে অনুপ্রাণিত এক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক পীঠস্থান। নারী শিক্ষা, সামাজিক সাম্য এবং সাংস্কৃতিক চেতনা জাগ্রত করার ক্ষেত্রে ছায়ানট দীর্ঘ দিন ধরে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। বেগম রোকেয়ার ‘সোলতানার স্বপ্ন’-এর মতো সাহিত্যকর্ম এবং তাঁর দর্শন আজও নারী মুক্তি আন্দোলনের পথপ্রদর্শক বলে মনে করা হয়।
এ দিকে, ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ওসমান হাদির মৃত্যুর পর থেকেই বাংলাদেশজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে। ভাঙচুর চালানো হয় একাধিক সংবাদপত্রের দফতরেও। সেই আগ্রাসনের হাত থেকে রেহাই পায়নি ছায়ানটও।
শুধু ছায়ানট নয়, একই রাতে ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতেও হামলা চালানো হয়। এর আগেও ওই বাড়িতে ভাঙচুর হয়েছিল। বৃহস্পতিবার রাতে অবশিষ্ট দেওয়াল ও কাঠামোও ভেঙে দেওয়া হয় বলে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের ফুটেজে দেখা গিয়েছে।
জানা গিয়েছে, জুলাই আন্দোলনের অন্যতম ছাত্রনেতা হাদি গত ১২ ডিসেম্বর ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হন। সরকারি উদ্যোগে তাঁকে চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হলেও ছ’দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইয়ের পর বৃহস্পতিবার রাতে মৃত্যু হয় তাঁর। মাথায় গুলি লেগেছিল হাদির। তাঁর মৃত্যুর খবর প্রকাশ্যে আসতেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে, যার জেরে এই হিংসাত্মক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
