অভিযুক্ত মেদিনীপুরের মাটি সবসময় গর্জে উঠেছে শাসন শোষণের বিরুদ্ধে। স্বাধীনতাকামী এই মাটি শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই বারবার গর্জে উঠেছে দৃঢ় চেতায়। বিদ্রোহ আর আন্দোলনের অন্যতম পীঠস্থান এই মেদিনীপুরের সমুদ্র উপকূলবর্তী খেজুরি। 'মলঙ্গী বিদ্রোহ' দিয়ে খেজুরীর আন্দোলন ও বিদ্রোহ শুরু। পরবর্তীকালে অসহযোগ আন্দোলন আইন অমান্য আন্দোলন লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে খেজুরি বারবার গর্জে ওঠে বীর চেতায়।
advertisement
আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক ও প্রবন্ধক প্রবাল কান্তি হাজরা প্রবন্ধে লিপিবদ্ধ করা আছে খেজুরির মলঙ্গী বিদ্রোহের কথা। ''নিমাক মহলের মলঙ্গী বিদ্রোহ" প্রবন্ধ অনুযায়ী ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে খেজুরি তে প্রায় দশ হাজার শ্রমিক নায্য মজুরি ও কাজের সময় কমানোর দাবিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। যা ইতিহাসে 'মলঙ্গী বিদ্রোহ' নামে স্থান লাভ করে। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা বিহার উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করে। দেওয়ানি লাভের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি "সোসাইটি অফ ট্রেড" গঠন করে। "সোসাইটি অফ ট্রেড" মেদিনীপুরের সমুদ্র ও নদী উপকূলবর্তী খেজুরি, হিজলি, নন্দীগ্রাম, বীরকুল (দিঘা), মহিষাদল ও তমলুকের এলাকায় একচেটিয়া লবণ তৈরি ও বিক্রির ব্যবসা শুরু করে। লবন তৈরীর কাজে নিযুক্ত করা হতো স্থানীয় মানুষদের। লবণ তৈরি কাজে যুক্ত থাকা মানুষদের মলঙ্গী নামে পরিচিত ছিল। মলঙ্গী অর্থাৎ ময়লা ও নোংরা শ্রেণীর মানুষ। ১৮০৪ সালে মলঙ্গীরা খেজুরিতে প্রথম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শোষন ও শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে।
১৯০৫ সালে বাংলা জুড়ে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের আজ এসে পড়ে বন্দর নগর খেজুরিতে। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাধারণ মানুষ থেকে সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারের সদস্যরা। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের স্বপক্ষে সভা আয়োজিত হয় জানকা বাজারে। পিকেটিং করে স্বদেশী দ্রব্যের প্রচার ও বিদেশি দ্রব্য বর্জন ও আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে খেজুরিতে। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়েই স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলন শুরু হয় খেজুরিতে। ১৯২১ সালে গাঁধীজির বিদেশি বর্জন আন্দোলনে উত্তাল সারাদেশ। খেজুরি বাদ যায়নি, ব্রিটিশ অনুমোদিত স্কুল ছেড়ে দলে দলে বেরিয়ে এসেছিল ছাত্রছাত্রীরা। সরকারি স্কুলের চাকরি ছেড়ে নিকুঞ্জ মাইতি ও আইন ব্যবসা ছেড়ে দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমল সেই আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। খেজুরির কলাগেছিয়া গ্রামের জমিদার জগদীশচন্দ্র মাইতির উদ্যোগে ১৮৪৫সালে প্রতিষ্ঠিত কলাগেছিয়া মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয় রূপান্তরিত হয় দেশের প্রথম জাতীয় বিদ্যালয়ে। দেশের প্রথম জাতীয় বিদ্যালয় উদ্বোধন করেন বীরেন্দ্রনাথ শাসমল। বিপ্লবী নিকুঞ্জবিহারী মাইতি ছিলেন দেশের প্রথম জাতীয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।
১৯৪২ আগস্ট আন্দোলন বা ভারত ছাড়ো আন্দোলনে উত্তাল সারাদেশ। দিকে দিকে ধ্বনিত হচ্ছে ইংরেজ ভারত ছাড়ো। এই আন্দোলন শুধুমাত্র বিপ্লবীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এই আন্দোলনের আগুন। সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ এই আন্দোলনে শামিল হয়। আর এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতাকামী মেদিনীপুরের অবিভক্ত তমলুক মহাকুমার মাটিতে গঠিত হলো জাতীয় সরকার "তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার"। কিন্তু "তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার" গড়ে ওঠার আগেই খেজুরিতে দেশের প্রথম জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনে খেজুরি থানা দখল করে স্বদেশীরা। 'মহাভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র' সিলমোহর দিয়ে তিন মাস স্বাধীনভাবে সরকার পরিচালিত হয়েছিল খেজুরিতে।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে পটভূমিকায় ১৯৪২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মেদিনীপুরের অবিভক্ত তমলুক মহাকুমা ও কাঁথি মহকুমার থানা দখলের দিন নির্ধারিত হয়। ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৪২ সালে মেদিনীপুরের তমলুক ও কাঁথি মহাকুমার মাটি রক্তে লাল হয়। থানা দখল অভিযানের সামিল হওয়া স্বদেশীদের ওপর ব্রিটিশ পুলিশ নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। প্রাণ হারান অনেক স্বদেশী হতাহতের সংখ্যা অগুনতি। ২৯ সেপ্টেম্বর তমলুক থানা অভিযানে ইংরেজ বাহিনীর গুলিতে প্রাণ গান্ধী বুড়ি মাতাঙ্গিনি হাজরা।
বিপ্লবী পূর্ণেন্দু শেখর ভৌমিক, কৌস্তভ কান্তি করণ ও বিভূতিভূষণ দিন্ডার নেতৃত্বে বিনা রক্তপাতে খেজুরি থানা সহ সমস্ত সরকারি অফিস দখল করে নেয় স্বদেশীরা। অবিভক্ত কাঁথি মহাকুমায় ২৯ সেপ্টেম্বর সমস্ত থানা দখল অভিযানের দিন ধার্য হলেও পূর্ণেন্দু শেখর ভৌমিক, কৌস্তভ কান্তি ও বিভূতিভূষণ দিন্ডার নেতৃত্বে স্বদেশী বিপ্লবীরা খেজুরি থানা সহ সমস্ত সরকারি অফিস দখল অভিযান করে ২৮ সেপ্টেম্বর। ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনী কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাজার হাজার স্বদেশী থানা ঘিরে ফেলে। বাধ্য করে ব্রিটিশ পুলিশকে আত্মসমর্পণ করতে। এই ঘটনার মধ্যদিয়ে খেজুরিতে স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় "মহাভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র" সিলমোহর নিয়ে। এই সরকার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তিন মাস পর এই সরকার বিলুপ্তি হয়। কারণ হিসেবে বলা হয় ঐ বছর ঝড় বৃষ্টি ও প্রবল বন্যায় ব্যাপক ভাবে বিপর্যস্ত হয় সমুদ্র উপকূল খেজুরি। এছাড়াও ইংরেজদের বর্বরোচিত অত্যাচার ও লুটপাটে সাধারণ মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছিল।
১৯৪৬ সালে ৩ জানুয়ারি গান্ধিজি হিজলি টাইডাল খাল দিয়ে খেজুরিতে আসেন। ইংরেজ বাহিনীর দমন পিড়নে অত্যাচারিত খেজুরির সাধারণ মানুষের দুর্দশা নিজের চোখে দেখেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে বারবার গর্জে উঠেছে খেজুরি। স্বাধীনতা আন্দোলনে খেজুরির অগ্রণী ভূমিকায় খেজুরিকে ‘বাংলার হলদিঘাট’ বলে অভিহিত করেছিলেন চারণকবি মুকুন্দ দাস। উপকূল ভূমি খেজুরি তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ইতিহাস। খেজুরি হয়ে উঠতে পারত বাংলার অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। কিন্তু অবহেলা অনাদরে আবৃত হয়ে পড়ে আছে আজও।
সৈকত শি