TRENDING:

গাভী পুজো আর সধবা পুজো... ১৬৪ বছরের শীলবাড়ির দুর্গা পুজোয় প্রকৃতি জ্ঞানে পুজো করা হয় মা’কে

Last Updated:
impactshort
ইমপ্যাক্ট শর্টসলেটেস্ট খবরের জন্য
advertisement
#কলকাতা: এই শহর কলকাতা অনেক পাল্টে গিয়েছে ৷ ঘোড়ায় টানা ছড়ি গাড়ি, তেলের বাতি, সন্ধে হলেই বাবু বাড়িতে আতরের গন্ধ, দুর্গা পুজোয় বাড়ির দালানে কয়েক হাজার লোকের পাত, নীলকণ্ঠ পাখির পায়ে বিজয়ার সন্দেশ পাঠানো...এসব এখন অতীত ৷ তবু পুরনো সেই গন্ধটা জাপটে ধরে রাখার চেষ্টায় আজও মুখ্য সূত্রধর হয়ে রয়েছে এই দুর্গাপুজো ৷ যেমন এই চোরবাগানের শীলবাড়ি ৷ এখনও ১৫০ জনের একান্নবর্তী পরিবার ৷
advertisement

আজও এই পরিবারে টিকে রয়েছে সেই ঐতিহ্য। উৎসাহী কয়েকজনের ঐতিহ্য বহনের বাসনা টিকিয়ে রেখেছে পুজোর সেই চেনা ছন্দ ৷ যেমন এই চোরবাগানের শীলবাড়ির দোল ৷ মুক্তরাম বাবু স্ট্রিটে মার্বেল প্যালেসের ঠিক পরেই শীলদের ঠাকুরবাড়ি ৷ এখানেই হয় তাঁদের ১৬৪ বছরের পুরনো দুর্গোৎসব ৷

শুরুটা রামচাঁদ শীলের হাত ধরে ৷ রামচাঁদ ও তাঁর সহধর্মিনী ক্ষেত্রমণিদেবী এই পুজোর সূচনা করেন ৷ সেটা ১৮৫৫ সাল ৷ সে বছরই প্রথম শুরু হল দোল ৷ তার ঠিক এক বছর পর ১৮৫৬-তে শুরু হয় দুর্গাপুজো ৷ বৈষ্ণব মতে পুজো হয় এখানে। ভোগে থাকে লুচি, ফল, মিষ্টি। অষ্টমীর সকালে ধুনো পোড়ান বাড়ির মহিলারা, অষ্টমীর দুপুরের গাভী পুজো এই বাড়ির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নবমীতে কুমারী পুজোর পাশাপাশি সধবা পুজোও সেভাবে আর অন্য কোথাও দেখা যায় না। সন্ধিপুজোয় বলির বদলে ধ্যান করেন পরিবারের সদস্যরা। ষষ্ঠী থেকে নবমী নিরামিষ। বিশেষত্ব হিসেবে শুক্তোয় পাটপাতা দেওয়া হয়, থাকে পানিফল ও পাঁপড়ের ডালনা। আগে কাঁধে চেপে বিসর্জন হত প্রতিমা ৷ এখন অবশ্য গাড়িতে হয় ৷

advertisement

নবমীতে সবধা ও কুমারী পুজোর আগে আলতা পরানো হচ্ছে ৷

তবে শীলবাড়ির এই প্রভাব-প্রতিপত্তি তা কিন্তু একদিনে হয়নি ৷ অত্যন্ত আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে শৈশব কাটিয়েছেন এ পরিবারের প্রাণপুরুষ রামচাঁদ শীল ৷ হুগলির ঘুটিয়া বাজারে থাকতেন রামচাঁদ ৷ বাবা হলধর শীলের অবস্থা ভাল না থাকায় মা রেবতীমণির সঙ্গে চন্দননগরের মামার বাড়িতে চলে এসেছিলেন রামচাঁদ ৷ এখানেই তাঁর বড় হয়ে ওঠা ৷ পরে মাসতুতো ভাই মদনমোহনের সহায়তায় গ্ল্যাডস্টোন কোম্পানিতে চাকরি পান রামচাঁদ ৷ তবে রামচাঁদ ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান, কর্মনিষ্ঠ ও সুদক্ষ ৷ তাই সহজেই উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নেক নজরে পড়েন তিনি ৷ ওই কোম্পানিরই বেনিয়ান নিযুক্ত হন ৷

advertisement

ধীরে ধীরে কলকাতায় স্থাপন করেন বসতবাড়ি, ঠাকুরবাড়ি, প্রতিষ্ঠা করেন কুল দেবতা দামোদর জিউ-র ৷ শুরু করেন দোল-দুর্গোৎসব ৷ কিন্তু বিত্তশালী হওয়ার পরেও কোনওদিন নিজের অতীত ভুলতে পারেননি রামচাঁদ ৷ আর্ত মানুষের শুকনো মুখ তাঁকে আজীবন পীড়া দিয়েছিল ৷ তাই চোরবাগানের শীলবাড়ির দরজা খুলে দিয়েছিলেন গরীব-দুঃখী, অভাবী মানুষদের জন্য ৷ তাঁর হিসাবের খাতা খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, সেখানে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ থাকত পীড়িত মানুষদের জন্য ৷ সে সময়ের গোঁড়া হিন্দু সমাজ ৷ কিন্তু তাঁর কাছে জাতপাত নিয়ে কোনও ছুৎমার্গ ছিল না ৷

advertisement

চোরবাগানের শীলবাড়িতে সন্ধিপুজোর সময় হয় ধুনো পোড়ানো ৷

নিজের উইলেও ১০০ টাকা পরিচারিকার জন্য বরাদ্দ রেখেছিলেন ৷ লোকমুখে প্রচলিত আছে, রামচাঁদ শীল নাকি নিজের পারলৌকিক ক্রিয়া কর্মের জন্য অর্থ বরাদ্দ করে রেখেছিলেন ৷ তবে মার পূর্বেই তিনি গত হন ৷ পরবর্তীকালে রেবতীমণি দেবী-র মৃত্যুর পর রামচাঁদ শীলের ছেলেরা পিতামহীর শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের জন্য সেই টাকা তাঁদের কাকা অর্থাৎ রামচাঁদের দুই ছোট ভাই দ্বারকানাথ শীল ও নন্দলাল শীলের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ৷ কিন্তু কাকারা সেই অর্থ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন ৷ এবং নিজেরাই মায়ের শ্রাদ্ধ সম্পন্ন করেন ৷ শুধু তাই নয়, দ্বারকানাথ ও নন্দলাল ওই টাকা দানধ্যানের জন্য ব্যবহার করতে উপদেশ দেন ৷

advertisement

তখন রামবাবুর ছেলেরা ওই টাকা ঋণপত্রে রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ৷ তার অর্চিত সুদ থেকে শুরু হয় খয়রাতি প্রদান ৷ দারিদ্রসীমার নীচে থাকা মানুষদের নাম নথিভুক্ত করা হয় ৷ যাঁদের নাম নথিভুক্ত থাকত, তাঁদের একটি করে পিতলের টিকিট দেওয়া হত ৷ সেই টিকিটটি দেখিয়ে টাকা পাওয়া যেত ৷ বহুদিন পর্যন্ত এই প্রথা টিকে ছিল ৷

সন্ধি পুজোর সেই মুহূর্ত ৷

রামবাবু যখন কলকাতায় পুজোর সূচনা করছেন তখন বাংলায় রামমোহনের যুগ ৷ নিরাকার ব্রহ্মের সাধনা আর পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে প্রচার করে যিনি সারা দেশে তখন নতুন যুগের ঢেউ আনছেন ৷ বাংলায় নবজাগরণ আনলেন তিনি ৷ ১৮২৭-এ তৈরি হয়েছে ব্রাহ্ম সমাজ ৷ তার মধ্যেই নতুন করে পুজোর আয়োজন করলেন রামচাঁদ ৷ কুল গুরুর পরামর্শে ও ঈশোপনিষদের মতাদর্শকে সামনে রেখে দেবীর আকারে শুরু হল প্রকৃতির আরাধনা ৷ সেই থেকে আজও এ বাড়িতে চলছে মায়ের পুজো ৷

রথের দিন হয় কাঠামো পুজো ৷ রাধাষ্টমীর দিন পুজোর সমস্ত মাঙ্গলিক জিনিসপত্র কেনা শুরু হয় ৷ এরপর মহালয়া থেকে শুরু হয় চণ্ডীপাঠ ৷ পিতৃপুরুষের তর্পণ করে ঘটে শুরু হয় অধিবাস ৷ এরপর ষষ্ঠীর দিন থেকে শুরু হয় পুজো ৷ সপ্তমীতে অগ্নিহোত্রী যজ্ঞের সূচনা আর নবপত্রিকার মহাস্নান হয় ৷ প্রকৃতি জ্ঞানে দেবীর পুজো হয় বলেই এখানে গাভী পুজোর চল রয়েছে অষ্টমীর দিন ৷ নবমীতে নারী ও জননীকে পুজো করা হয় এই শীলবাড়িতে ৷

এখনও এ বাড়ির দালানে প্রতি বেলা ১৫০-২০০ জনের পাত পড়ে ৷

সেরা ভিডিও

আরও দেখুন
​'শুভ বিজয়া' সন্দেশ স্পেশালে মন মজেছে জনতার! বর্ধমানের মিষ্টির দোকানে ভিড়
আরও দেখুন

ছবি সৌজন্যে: চোরবাগান শীলবাড়ি

বাংলা খবর/ খবর/ফিচার/
গাভী পুজো আর সধবা পুজো... ১৬৪ বছরের শীলবাড়ির দুর্গা পুজোয় প্রকৃতি জ্ঞানে পুজো করা হয় মা’কে