অবিভক্ত মেদিনীপুরের তমলুক ও কাঁথি মহাকুমা বা বর্তমানে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস মূলত মহাত্মা গান্ধীর আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। কিন্তু তার আগেও সারা বাংলা জুড়ে এক আন্দোলন তৎকালীন ব্রিটিশ শক্তির ভিত নড়িয়ে দিয়েছিল তা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ আইন কার্যকর করে। এর প্রতিবাদে সারা বঙ্গপ্রদেশ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। যার আঁচ এসে পড়েছিল বর্তমান পূর্ব মেদিনীপুর জেলার খেজুরিতে। খেজুরিতে এই আন্দোলনেই জড়িয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামী মহেন্দ্রনাথ করণ।
advertisement
মহেন্দ্রনাথ করণ খেজুরির প্রত্যন্ত ভাঙ্গনমারী গ্ৰামে জন্মগ্ৰহণ করেন ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৯ নভেম্বর। পিতা ক্ষেমানন্দ ও মাতা সুভদ্রামনি দেবী। জালিয়াঘাটা মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়ে পাঠ সমাপন করে মহেন্দ্রনাথ কাঁথি হাইস্কুলে ভর্তি হন। মেধাবী ছাত্র হিসাবে খ্যাতি ছিল। কাঁথি হাইস্কুলে পড়াকালীন মাত্র ১৮ বছর বয়সে সারাবাংলা জুড়ে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন শুরু হলে তিনি ঐ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। দক্ষ সংগঠক মহেন্দ্রনাথ করণ বাংলার মানুষের মধ্যে দেশমাতৃকার কথা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য 'বঙ্গলক্ষী ব্রতকথা' নামে একটি বই রচনা করেন। যা ব্রিটিশ বাহিনীদের কাছে চক্ষুশূল হয়ে ওঠে।
ওই সময়ে তিনি এলাকার সমবয়সীদের নিয়ে 'বন্দে মাতরম' ভিক্ষু সম্প্রদায় গঠন করে নিজ মাতৃভূমি খেজুরি থানার গ্ৰামে গ্ৰামে স্বদেশী দ্রব্যের প্রচার চালান। ১৯০৫ সালে খেজুরীর জানকায় আজানবাড়ী হাটে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী সমাবেশ সংগঠিত হয়। মহেন্দ্রনাথ করনের নেতৃত্বে বিপুল সংখ্যক জনগণ ওই সমাবেশে সামিল হয়। এর ফলস্বরূপ ব্রিটিশ পুলিশ মহেন্দ্রনাথ করণকে গ্রেফতার করে। পরে ব্যক্তিগত জামিনে মুক্তি পায়।
মহেন্দ্রনাথ শুধু খেজুরিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য কখনও বাংলার চট্টগ্রাম বরিশাল কখনও বা অবিভক্ত ভারতের লাহোর পাঞ্জাব সহ বিভিন্ন এলাকায় ব্রিটিশ বিরোধী সংগঠন গড়ে তুলতে মুখ্য ভূমিকা নেয়। তার নেতৃত্বেই অধুনা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও বরিশালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন অন্য মাত্রা পায়।
শুধু ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন বাংলার মানুষকে মুক্তি দিতে পারে না তা তিনি উপলব্ধি করেন। তাই তিনি খেজুরির সাধারণ মানুষের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের দিকেও নজর দেন। তিনি একটি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে তোলে। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল গ্রামেগঞ্জে মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা না যায়।
আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক ও আলোচক সুদর্শন সেনের মতে মহেন্দ্রনাথ করণ শুধুমাত্র একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন না। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি সঙ্গীত ও সাহিত্য চর্চা করতেন নিয়মতি। তাঁর লেখা অনেক বই রয়েছে। তিনি ছিলেন দক্ষ সংগঠক। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপ্লবী অগ্নিযুগে তিনি দক্ষ সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। বিপ্লবীদের একত্রিত করার প্রয়াসে তিনি অবিভক্ত ভারতবর্ষে নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন।
জমিদার বংশের সন্তান হয়েও এক ব্যতিক্রমী চরিত্রর অধিকারী ছিলেন মহেন্দ্রনাথ করণ। বাংলার মানুষ তথা দেশ মাতৃকার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন ব্রিটিশ অত্যাচার সহ্য করেও নিজের লক্ষ্য থেকে সরে দাঁড়াননি। মাত্র ৪২ বছর আট মাস বয়সে কয়েকদিনের রোগভোগে তিনি ১৯২৮ খ্রীষ্টাব্দের ১৭ জুলাই প্রয়াত হন।
* তথ্যসূত্র: খেজুরির স্বাধীনতার ইতিহাস।
-Saikat Shee