দেউলপুরের বাগ বাড়ি! মাটির উঠানে ডাঁই করা চেলা কাঠ। পাশেই মাঝারি একটা পুকুর। পুকুরে গায়ে চালাঘর। সেখানেই একজন বসে একমনে পোলো বল তৈরি করে চলেছেন। এই বাড়িটাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল পোলো গ্রাম। তবে এখন নামেই পোলো গ্রাম! সেই রমরমা আর নেই! শেষ হয়ে যাওয়ার মুখে পোলো বল তৈরির ঘর। তিন পুরুষেই শেষ হতে চলেছে ব্যবসা।
advertisement
গোড়া থেকে শুরু করা যাক! সে অনেক কাল আগের কথা! স্বাধীনতার বহু আগে! তখন ইংরেজ আমল। দু-চারটে ইংরেজি শব্দ জানলেই চাকরি বাঁধা। এমনই এক ভদ্রলোক থাকতেন দেউলপুরে। কয়েকটা ইংরেজি শব্দ রপ্ত করে চাকরি জুটিয়ে নিলেন ইংরেজ দফতরে ! প্রতি শনিবার কলকাতা থেকে গ্রামে ফিরতেন । সেই ভদ্রলোকের প্রিয় বন্ধু ছিলেন বিপিনবিহারী বাগ নামে দেউলপুরেরই এক বাসিন্দা। পেশায় সামান্য চাষী। ভদ্রলোক একদিন বিপিনবাবুকে কথায় কথায় বললেন, ইংরেজদের পোলো খেলার গল্প। সঙ্গে এও জানালেন, ওরা যে বলটা দিয়ে খেলে, সেটা কাঠের। সেই বলে নাকি খেলাটা জমে না! গতী আসে না!
ভদ্রলোকের মাথায় তখন ঘুরছিল ইংরেজদের খুশি করার মতলব। বিপিনের মাথায়ও তা ঢুকে গেল। চাষের ফাঁকে বিপিন বসে ভাবেন, কী করে এমন বল তৈরি করা যায় যা কাঠের বলের থেকে জোড়ে ছুটবে! হঠাৎ তাঁর মাথায় এল এক ফন্দি! ঝাড়ে বাঁশ কাটার পর শিকড় সমেত পড়ে থাকে গোড়াটা। এই শিকড়ের গোড়াকে চলতি ভাষায় বলে জর। তা দিয়ে তো পোলো বল তৈরি করা যেতে পারে! কথাটা বললেন বন্ধুকে! তাঁরও মনে ধরল! সে বিপিনকে কলকাতা থেকে একটি কাঠের পোলো বল এনে দিলেন। সেটা দেখে, জর কেটে-কুরে বিপিন একদিন তৈরি করলেন পোলো বল।
বিপিনের বন্ধু সেই বলটি নিয়ে শহরে এসে তুলে দিলেন ইংরেজদের হাতে। বাঁশের তৈরি বলে পোলো খেলে ইংরেজরা তো মহা খুশি। গ্রামে ফিরে ভদ্রলোক সেই খবর জনালেন বিপিনকে। এবার বিপিনের চাষবাস শিকেয় উঠল। বাঁশের জর নিয়ে এসে শুধু পোলো বল তরি করতে লাগলেন। কীভাবে? প্রথমে জরটাকে লম্বা করে কাটতে হবে। তারপর কেটে কেটে গোল করতে হবে। গোল হয়ে গেলে শিরিষ কাগজ দিয়ে মসৃণ করার পালা। এবার সাদা পাউডার আর শিরিষ আঠা দিয়ে একটা মিশ্রণ তৈরি করে বলের গায়ে সমান ভাবে মাখাতে হবে। শুকিয়ে গেলে আবার শিরিষ কাগজ দিয়ে ঘষতে হবে। এরপর এনামেল বা তেল রং দিয়ে রং করে, শুকিয়ে নিলেই তৈরি পোলো বল! সেই বল যেতে লাগল কলকাতায়। ইংরেজদের কাছে।
বিপিনের বানানো পোলো বল এতটাই উচ্চমানের হল যে, অন্য কোনও বলে পোলো খেলা বন্ধ হয়ে গেল। ইংরেজরা বিপিনের পোলো বল বিক্রির জন্য খুলে বসলেন কোম্পানি। ১৬৮ ধর্মতলা স্ট্রিটে। নাম-- Eroom & co. । এক মেমসাহেব ছিলেন মালকিন। তাঁর নামেই কোম্পনাইর নাম। বছরে আড়াই লক্ষ বল সরবরাহ করতেন বিপিন। ১৯৪৭-এ স্বাধীনতার পর দেশ ছাড়লেন মেমসাহেব। যাওয়ার সময় কোম্পনিটি বিক্রি করতে চাইলেন বিপিনকে! দাম? মাত্র ৫৫০ টাকা। কিন্তু কেনেননি বিপিন। কেন? কারণটা অজানা!
বিপিনবিহারী বাগের মৃত্যুর পর তাঁর দুই ছেলে সতীশচন্দ্র আর যুগলকৃষ্ণ হাল ধরলেন ব্যবসার। ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠল। ওঁরা সোজাসুজি বিলেতে বল রফতানি করতে লাগলেন। বিলেতের J.Salter&co. ওদের সমস্ত বল কিনে নিত। দেউলপুরের এই জায়গাটার নামই হয়ে গেল পোলো গ্রাম। রাতভর কাজ করতেন ১৫জন কর্মী!
কিন্তু এখন? নামটাই শুধু রয়ে গিয়েছে। প্লাস্টিকের বল চলে আসায় আর বাঁশের জর দিয়ে তৈরি বল কিনতে চায় না কেউ। কারণ? ওই যে গতী! যে গতীর লোভে ইংরেজরা কাঠে বল ছেড়ে বাঁশের জরের বল বেছেছিলেন, এখন সেই গতীর লোভেই বাঁশের জরের বলের জায়গায় এসেছে প্লাস্টিকের বল! পাশাপাশি জঙ্গলও যাচ্ছে কমে! বাঁশ কম হচ্ছে। বেশি সংখ্যায় বল বানানোও সম্ভব হচ্ছে না!
তাহলে? অক্ষরজ্ঞানহীন এক গ্রাম্য বাঙালির আবিষ্কার করা পোলো বল কী তা হলে বিলুপ্তির পথে?
প্রশ্নটা সহজ, উত্তরটাও জানা!
