TRENDING:

রুপোর ছাতা মাথায় দিয়ে রাজবেশ পরেন শীলবাড়ির দমোদর জিউ, শুরু হয় ১৬৪ বছরের পুরনো দোল উৎসব

Last Updated:

শুরুটা রামচাঁদ শীলের হাত ধরে ৷ রামচাঁদ ও তাঁর সহধর্মিনী ক্ষেত্রমণিদেবী এই দোল উৎসবের সূচনা করেন ৷ সেটা ১৮৫৫ সাল ৷

impactshort
ইমপ্যাক্ট শর্টসলেটেস্ট খবরের জন্য
advertisement
#কলকাতা: সেই দিনগুলো বদলে গিয়েছে ৷ সময়ের স্রোতে গা ভাসাতে ভাসাতে সেই পালকিচলা, ঘোড়ার গাড়ির কলকাতা আর নেই... নেই সেই রাজকীয় খেয়াল, নেই বাবুয়ানির রোশনাই ৷ আজ আর রং লাগে না রুপোর পিচকিরিতে ৷ ঝাড়লন্ঠন মোছে না কোনও ওড়িয়া ভৃত্য। তানপুরার বোলে আজ আর রেওয়াজের সুর নেই। গহরজানরা হারিয়ে গিয়েছেন কবেই। তাই আজকের কলকাতার বাঙালি দোল নিজস্ব রং হারিয়ে অনেক ফিকে ৷
advertisement

একদিন কিন্তু বাঙালির এই দোলে মিশে ছিল আভিজাত্য ৷ মিশে ছিল দোলের শেষে গোলাপ জলে শরীর ভেজানোর খুসবু। আজও কিছু পরিবারে টিকে রয়েছে সেই ঐতিহ্য। উৎসাহী কয়েকজনের ঐতিহ্য বহনের বাসনা টিকিয়ে রেখেছে দোলের সেই চেনা ছন্দ ৷ যেমন এই চোরবাগানের শীলবাড়ির দোল ৷ মুক্তরাম বাবু স্ট্রিটে মার্বেল প্যালেসের ঠিক পরেই শীলদের ঠাকুরবাড়ি ৷ এখানেই হয় তাঁদের ১৬৪ বছরের পুরনো দোল উৎসব ৷

advertisement

আগেকার মানুষরা কোনও বর্ধিষ্ণু বাড়ির উল্লেখ করতে গিয়ে বলতেন, ‘‘ওঁদের বাড়ি দোল-দুর্গোৎসব হয় ৷’’ তার মানে দুর্গা পুজোর মতোই বড় ব্যাপার ছিল দোল উৎসব ৷ দেখা গিয়েছে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ১৭৮৭ খ্রীষ্টাব্দের সরকারি ছুটির তালিকায় অন্যান্য পরবে সরকারি আপিস যেখানে দু-একদিন বন্ধ রাখা হত, সেখানে দুর্গোৎসবে বন্ধ রাখা হত ৮ দিন ও দোলযাত্রায় ৫ দিন। সে সময় অনেক বাড়িতেই দোল চলত দশ-বারোদিন ধরে। ফলে পাঁচদিনের ছুটি তো তাঁদের কাছে অত্যন্ত কম।

advertisement

শুরুটা রামচাঁদ শীলের হাত ধরে ৷ রামচাঁদ ও তাঁর সহধর্মিনী ক্ষেত্রমণিদেবী এই দোল উৎসবের সূচনা করেন ৷ সেটা ১৮৫৫ সাল ৷ সে বছরই প্রথম শুরু হল দোল ৷ তার ঠিক এক বছর পর ১৮৫৬-তে শুরু হয় দুর্গাপুজো ৷ এ বাড়ির পুজো। বৈষ্ণব মতে পুজো হয় এখানে। ভোগে থাকে লুচি, ফল, মিষ্টি। অষ্টমীর সকালে ধুনো পোড়ান বাড়ির মহিলারা, অষ্টমীর দুপুরের গাভী পুজো এই বাড়ির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নবমীতে কুমারী পুজোর পাশাপাশি সধবা পুজোও সেভাবে আর অন্য কোথাও দেখা যায় না। সন্ধিপুজোয় বলির বদলে ধ্যান করেন পরিবারের সদস্যরা। ষষ্ঠী থেকে নবমী নিরামিষ। বিশেষত্ব হিসেবে শুক্তোয় পাটপাতা দেওয়া হয়, থাকে পানিফল ও পাঁপড়ের ডালনা। আগে কাঁধে চেপে বিসর্জন হত প্রতিমা ৷

advertisement

এ বাড়ি দোলের বৈশিষ্ট্যও একেবারে অন্যরকম ৷ একাদশী থেকে শুরু হয় দোল উৎসব, যা চলে প্রতিপদ পর্যন্ত। একাদশীতে নিবেদন করা হয় গোলাপজাম ও লকেট ফল-সহ শরবতের ভোগ। থাকে বেল, ডাব, তরবুজের শরবত। আর থাকে আমছেঁকা। এই সময় প্রতি দিন নিবেদিত হয় রাজভোগ, যা তৈরি হয় রসুইঘরে। ভোগে থাকে চার প্রকার কলাই ভোগ, ময়দার লুচি, ছানার পদ, সিঙাড়া, কচুরি, পটল-বেগুন-এঁচড়ের তরকারি ও চাটনি। এ ছাড়াও থাকে মালপোয়া। পূণির্মার দিন হয় চাঁচর। প্রতিপদের দিন হয় দেবদোল ৷ চাঁচরের দিন দামোদর জিউ-এর রাখাল বেশে ও দোলের দিন রাজ বেশে পুজো হয়। দোলের পরের দিন ভোর ৪টের সময় হয় দেবদোল।

advertisement

সেই দিন পরিবারের সকলেই মিলিত হন। আবির দেওয়া হয় দামোদর জিউকে । আগে দোলের কিছু বিশেষ প্রথাও ছিল। যেমন যাত্রা দেখা শেষে বাড়ির সকলে যেতেন নিজস্ব বাগানবাড়িতে। সেখানে কাদামাটি খেলার পর গঙ্গা কিংবা পুকুরে স্নান করা হত। তার পর দোলের বিশেষ খাওয়াদাওয়া শেষে সকলে ফিরে আসতেন বাড়িতে। এখন অবশ্য এই প্রথা উঠে গিয়েছে ৷

চাঁচরের দিন এবং দোলের দিন সারারাত চলে যাত্রানুষ্ঠান। আগে বসত বাইজিগানের আসর। কিছুদিন আগেও প্রতি বছর নিয়ম করে লেখা হত নতুন গান। গাওয়া হত দোলের অনুষ্ঠানে। দোল উৎসবের জন্য একবার একটি গান লিখেছিলেন নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ । দোলকে কেন্দ্র করে যে একটা সংস্কৃতি চর্চা গড়ে উঠতে পারে, এ পরিবারই বোধহয় গোটা কলকাতাকে তা শিখিয়েছে।

তবে শীলবাড়ির এই প্রভাব-প্রতিপত্তি তা কিন্তু একদিনে হয়নি ৷ অত্যন্ত আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে শৈশব কাটিয়েছেন এ পরিবারের প্রাণপুরুষ রামচাঁদ শীল ৷ হুগলির ঘুটিয়া বাজারে থাকতেন রামচাঁদ ৷ বাবা হলধর শীলের অবস্থা ভাল না থাকায় মা রেবতীমণির সঙ্গে চন্দননগরের মামার বাড়িতে চলে এসেছিলেন রামচাঁদ ৷ এখানেই তাঁর বড় হয়ে ওঠা ৷ পরে মাসতুতো ভাই মদনমোহনের সহায়তায় গ্ল্যাডস্টোন কোম্পানিতে চাকরি পান রামচাঁদ ৷ তবে রামচাঁদ ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান, কর্মনিষ্ঠ ও সুদক্ষ ৷ তাই সহজেই উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নেক নজরে পড়েন তিনি ৷ ওই কোম্পানিরই বেনিয়ান নিযুক্ত হন ৷

ধীরে ধীরে কলকাতায় স্থাপন করেন বসতবাড়ি, ঠাকুরবাড়ি, প্রতিষ্ঠা করেন কুল দেবতা দামোদর জিউ-র ৷ শুরু করেন দোল-দুর্গোৎসব ৷ কিন্তু বিত্তশালী হওয়ার পরেও কোনওদিন নিজের অতীত ভুলতে পারেননি রামচাঁদ ৷ আর্ত মানুষের শুকনো মুখ তাঁকে আজীবন পীড়া দিয়েছিল ৷ তাই চোরবাগানের শীলবাড়ির দরজা খুলে দিয়েছিলেন গরীব-দুঃখী, অভাবী মানুষদের জন্য ৷ তাঁর হিসাবের খাতা খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, সেখানে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ থাকত পীড়িত মানুষদের জন্য ৷ সে সময়ের গোঁড়া হিন্দু সমাজ ৷ কিন্তু তাঁর কাছে জাতপাত নিয়ে কোনও ছুৎমার্গ ছিল না ৷

নিজের উইলেও ১০০ টাকা পরিচারিকার জন্য বরাদ্দ রেখেছিলেন ৷ লোকমুখে প্রচলিত আছে, রামচাঁদ শীল নাকি নিজের পারলৌকিক ক্রিয়া কর্মের জন্য অর্থ বরাদ্দ করে রেখেছিলেন ৷ তবে মার পূর্বেই তিনি গত হন ৷ পরবর্তীকালে রেবতীমণি দেবী-র মৃত্যুর পর রামচাঁদ শীলের ছেলেরা পিতামহীর শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের জন্য সেই টাকা তাঁদের কাকা অর্থাৎ রামচাঁদের দুই ছোট ভাই দ্বারকানাথ শীল ও নন্দলাল শীলের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ৷ কিন্তু কাকারা সেই অর্থ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন ৷ এবং নিজেরাই মায়ের শ্রাদ্ধ সম্পন্ন করেন ৷ শুধু তাই নয়, দ্বারকানাথ ও নন্দলাল ওই টাকা দানধ্যানের জন্য ব্যবহার করতে উপদেশ দেন ৷

তখন রামবাবুর ছেলেরা ওই টাকা ঋণপত্রে রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ৷ তার অর্চিত সুদ থেকে শুরু হয় খয়রাতি প্রদান ৷ দারিদ্রসীমার নীচে থাকা মানুষদের নাম নথিভুক্ত করা হয় ৷ যাঁদের নাম নথিভুক্ত থাকত, তাঁদের একটি করে পিতলের টিকিট দেওয়া হত ৷ সেই টিকিটটি দেখিয়ে টাকা পাওয়া যেত ৷ বহুদিন পর্যন্ত এই প্রথা টিকে ছিল ৷

সেরা ভিডিও

আরও দেখুন
চিনি-গুড়ের রসে তো অনেক হল! রসগোল্লায় এবার মিলছে কাঁচা লঙ্কার ঝাল স্বাদ
আরও দেখুন

(ছবি সৌজন্য: চোরবাগান শীলবাড়ি)

বাংলা খবর/ খবর/ফিচার/
রুপোর ছাতা মাথায় দিয়ে রাজবেশ পরেন শীলবাড়ির দমোদর জিউ, শুরু হয় ১৬৪ বছরের পুরনো দোল উৎসব