গত দুবছর মার্কিনমুলুকে ঠাঁই নিয়েছি। প্রথম অক্টোবরে পুজো এসেছিল শুধু ফেসবুক জুড়ে।এখন শপিং মলে ভিড় উপচে পড়ছে। দেদার অফার চলছে শহর ও শহরতলিতে। থিমের দাপটে মহানগরীর ট্রাফিক বিপর্যস্ত। ডাকের সাজে প্রতিমাও মা-এর মত কাছের। রেস্টুরেন্ট থেকে স্ট্রীট ফুডকর্ণার -- পুরোনো প্যাকেটে নতুন চমক। স্ক্রোল করছি আর দেখে চলেছি কোনোরকম অঘটনের প্রত্যাশা ছাড়াই। হঠাৎ প্রবাসে, হয়তো দৈবেরই বশে, সদ্য পরিচিত বন্ধুদের ফোন। "কাল যাবি তো ঠাকুর দেখতে?"
advertisement
আনন্দে আট-ন-খানা হয়ে মনে হল এই প্রথম মহিষাসুরমর্দিনী উড়োজাহাজে আসছে। ক্যালিফোর্নিয়ার লস এঞ্জেলস কাউন্টির ছোট্ট পাহাড় ঘেরা শহর উডল্যান্ডহিলস আমার বর্তমান ঠিকানা। সাদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ায় তিনটে বড়ো বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন আছে। এছাড়াও ভারত সেবাশ্রমের পুজো বেশ পপুলার। দুর্গা পুজোর নির্ঘন্ট মেনে সেই দিনে পুজো এখানে সম্ভব হয় না। বেছে নেওয়া হয় সপ্তাহান্তগুলোকে।
অ্যাসোসিয়েশনগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ডেট ঠিক করে। একে, সীমিত পুজো, তায়, প্যান্ডেল হপিং এর সুযোগ কম থাকায় কেউ কারোর ডেটে পারতপক্ষে পুজো করেন না।অঞ্চল ভিত্তিক কোনো একটি স্কুল বা কলেজ ভাড়া নেওয়া হয় দুদিনের জন্য। শনি এবং রবিবার জুড়ে ষষ্ঠী টু দশমী পুজো হয়। অম্বিকা এখানে তিলে তিলে গঠিত হন না। নাটকীয় গ্ল্যামারে ম্যাজিকের মত মোড়ক ছিন্ন করে বেরিয়ে আসেন।স্বস্থানে অধিষ্ঠিত হন। সময় বড়ো দায় হলেও বোধন, নবপত্রিকা স্নান, অষ্টমীর অঞ্জলী, সন্ধিপুজো, সিঁদুরখেলা কোনোকিছুরই খামতি থাকে না।
পুজোর পাশাপাশি কমিটির সদস্যরা দিনের বেলায় আয়োজন করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। নাচ, গান, কবিতা পাঠে জমজমাট হলঘর। রাতে বাংলার জনপ্রিয় কোনো শিল্পী বা ব্যান্ডের পোগ্রাম থাকে।
কমিটির সদস্যরা ছাড়াও দেশী-বিদেশী সকলের সাদর আমন্ত্রণ থাকে এ পুজোয়। ধর্ম যার যার; উৎসব সবার -- এমন বার্তায় আবিশ্ব কাছে টানার প্রয়াসও অমিল নয়। এই দুদিন দুচোখের পাতা এক করার নিয়ম নেই, নাওয়ার ঠিক নেই, বাড়ি যাওয়ার ঠিক নেই। তবে পাত পেড়ে ভুরিভোজ অবশ্যই আছে।লুচি, ছোলার ডাল, ইলিশ ভাপা, মটন্ কষা, লাল দই, মিষ্টি, পান নিয়ে পুরো এলাহী আয়োজন।হই হই কান্ডে দিন দুই কর্পূরের মত উবে যায়।
দেবী এখানে বিসর্জিত হন না। দর্পণে মায়ের মুখ দেখার পর দর্পণ বিসর্জিত হয়। মহিলারা লাইন করে তাতে সিঁদুর-সন্দেশের প্রথাগত বরণ সেরে নেন। এরপর দুর্গা, কার্তিক-গণেশ, লক্ষ্মী-সরস্বতী লেখা কাঠের মোড়কগুলোকে এগিয়ে দেয় সামনে। সর্বংসহা সন্তানসহ সমাহিত হন আসছে বছরের প্রতীক্ষায়।
কর্মব্যস্ত প্রথমবিশ্বে মহামায়ার পুজো ঘিরে উৎসবমুখরতার যে বেনোজল ঢোকে তাতে অবগাহন করে সমগ্র বাঙালি হৃদয়। এপার বাংলা ওপার বাংলা এক হয়ে যায় কোলাকুলি আর মিষ্টিমুখে। অপেক্ষা অনন্ত জেনে কমলাকান্তীয় সুরে বিষাদ ছেয়ে থাকে..."ওরে নবমীনিশি! না হৈওরে অবসান"...সে কি একটা রাতেরই কথা নাকি হে কবি!
অনসূয়া চন্দ্র